৯ জুলাই ২০২১, শুক্রবার, ৭:২৬

পৌনে ৪০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে হাজার কোটি আয় লক্ষ্য

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার দখলে মরিয়া পুরনো সিন্ডিকেট

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার ঘিরে দীর্ঘদিন ধরেই সক্রিয় দুষ্টচক্র। এদের বাড়াবাড়ি ও অতিলোভের কারণে দীর্ঘদিন ধরেই শ্রমবাজারটি বন্ধ হয়ে আছে। যদি সিন্ডিকেট না করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব, কুয়েত, কাতারসহ অন্যান্য দেশের মতো স্বাভাবিক নিয়মে কর্মী পাঠানো হতো তাহলে এত দিনে দেশটিতে ১০ লাখেরও বেশি শ্রমিক চলে যেত। বিনিময়ে আসত বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা।

এবারো করোনার মধ্যে দুষ্টচক্রের হোতা মালয়েশিয়ার বংশোদ্ভূত দাতো শ্রী আমিন নুরের ছকেই নতুনভাবে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে অভিনব সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে যদি শ্রমবাজার খোলা যায় তাহলে তারা বিনিয়োগের দ্বিগুণেরও বেশি টাকা তুলে নিয়ে যাবে। প্রাথমিকভাবে বিনিয়োগ করবে পৌনে ৪ শ’ কোটি টাকা। বিনিময়ে পাঁচ লাখ কর্মীকে পাঠানোর টার্গেট নিয়ে তারা ন্যূনতম এক হাজার কোটি টাকারও বেশি টাকা হাতিয়ে নেয়ার পরিকল্পনায় এগোচ্ছে বলে জনশক্তি প্রেরণকারী ব্যবসায়ীদের মধ্যে ব্যাপক গুঞ্জন উঠেছে।
শোনা যাচ্ছে এবার নতুন সিন্ডিকেটের সদস্য হবে ২৫ জন। তাদের মধ্যে বিশিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সি মালিকরা থাকতে পারেন। তবে কেউ যাতে সন্দেহ করতে না পারে সেজন্য কৌশলে আরো পাঁচশ রিক্রুটিং এজেন্সিকে দলে ভিড়িয়ে সাধারণ সদস্যদেরও সিন্ডিকেটের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছেন দাতো শ্রী আমিন নুর গংদের এদেশীয় এজেন্টরা। যদিও মালয়েশিয়ার অভিবাসন সেক্টরে কোনো রকম সিন্ডিকেট করা যাবে না মর্মে আপিল বিভাগ থেকে রায়ও প্রদান করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। কেস নম্বর- সিভিল পিটিশন ফর লিভ টু আপিল- নম্বর ৮৮২২০১৭।
সচেতন রিক্রুটিং এজেন্সি মালিকরা বলছেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে সিন্ডিকেট করে কর্মী পাঠালে বিদেশগামী কর্মীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। একই সাথে ব্যবসা হারাবে বেশির ভাগ সাধারণ রিক্রুটিং এজেন্সি মালিক। এর মধ্যে যারা ব্যবসা করবেন তাদের জিম্মি থাকতে হবে সিন্ডিকেটের কাছে। এই সুযোগে আবার আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে উঠবে সিন্ডিকেট নামধারী কিছু রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক ও তাদের বিদেশী বন্ধুরা।

গতবার মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে যে ১০ সদস্যের সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছিল তারা এখন দুই-তিনটি গ্রুপে বিভক্ত বলে জানা গেছে। এর মধ্যে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে সিন্ডিকেটের জনক দাতো শ্রী আমিন নুর গ্রুপের সদস্য হিসেবে পরিচিত ‘স’ আদ্যক্ষরের একজন রিক্রুটিং এজেন্সি মালিক নানা কৌশলে (ঢাকা এবং মালয়েশিয়ায়) সিন্ডিকেটকে নিয়ন্ত্রণের প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিছু মিডিয়াকেও নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। অপর দিকে সিন্ডিকেট থেকে বেরিয়ে যাওয়া গ্রুপটি এবার চাচ্ছে, যেকোনো উপায়েই হউক অন্তত মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে যাতে আমিন নুরের নেতৃত্বে কোনো ধরনের সিন্ডিকেট গড়ে না ওঠে। তাদের দাবি, নেপালসহ অন্যান্য সোর্স কান্ট্রিভুক্ত দেশ থেকে যেভাবে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক যাচ্ছে সেভাবেই যাতে বাংলাদেশের মার্কেটটি খুলে দেয়া হয়, তাহলে সাধারণ সদস্যরা তাদের নিজেদের মতো করে ব্যবসা করতে পারবে। এ নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে পক্ষ-বিপক্ষ গ্রুপের সদস্যরা মতবিনিময়ের নামে আলোচনা ও রুদ্ধদ্বার বৈঠক করছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। তবে গতবার যারা সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন, এবার তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ নতুন ২৫ সদস্যের সিন্ডিকেটে থাকতে নানাভাবে লবিং করছেন। তবে তাদের নাম চূড়ান্ত তালিকায় রয়েছে কি না তা জানতে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে বলে সূত্রগুলো জানিয়েছে, যদিও এখনো চার-পাঁচটি পদ খালি রয়েছে। পরিস্থিতি বুঝে ওই পদ পূরণ করা হবে।

গত বুধবার সিন্ডিকেটের বিপক্ষে থাকা একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে নয়া দিগন্তকে বলেন, মূলত ‘স’ আদ্যক্ষরের রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকের উদ্যোগে সিন্ডিকেট গোছানোর কার্যক্রম ইতোমধ্যে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এর মধ্যে আমার বন্ধুও আছে। তিনি বলেন, তাদের টার্গেট মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণ করা। এর জন্য তারা চাচ্ছে আগে বায়রাকে নিয়ন্ত্রণে নিতে। কারণ নতুন করে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে ২৫ সদস্যর যে সিন্ডিকেটের নামের খসড়া তালিকা চূড়ান্ত করার চেষ্টা চলছে সেখানে ২৫ জনের নেতৃত্বে আরো ৫০০ রিক্রুটিং এজেন্সি মালিককে সিন্ডিকেটে রাখা হবে। অর্থাৎ একজনের সাথে আরো ২০ জন এজেন্সি মালিক সম্পৃক্ত থাকবে। সেই হিসাবে (২৫+৪৭৫)=৫০০ জন সিন্ডিকেটের হয়ে মালয়েশিয়ায় ব্যবসার সুযোগ পাবে। এক প্রশ্নের উত্তরে ওই ব্যবসায়ী বলেন, এবার গতবারের পুরনো ১০ সদস্যের সিন্ডিকেটের মধ্যে চার-পাঁচজন ছাড়া বাকি সবাই সিন্ডিকেটের বিরোধিতা করছে। জানি না তারা পরবর্তীতে আবার যোগ দেয় কি না? তবে নতুন সিন্ডিকেটে যারা ঢুকবে তাদের প্রত্যেকের জন্য ১৫ কোটি টাকা করে নির্ধারণ করা হয়েছে। সত্য-মিথ্যা জানি না। এর মধ্যে ২৫ জনের একজন দেবে ১০ কোটি টাকা। আর তার (এক) সাথে ২০ জনের প্রত্যেকে দেবে ২৫ লাখ টাকা করে। তাহলে মোট পাঁচ কোটি টাকা। সেই হিসাবে ২৫ সিন্ডিকেটের শ্রমবাজারে মোট বিনিয়োগ করতে হবে পৌনে ৪ শ’ কোটি টাকা। তবে এই সিন্ডিকেট নতুন সিস্টেমে শ্রমবাজার যদি খুলতে সক্ষম হয়েই যায় তাহলে তাদের টার্গেট রয়েছে, এই বাজার থেকে ন্যূনতম এক হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়ার। এটা আরো বেশিও হতে পারে। যেমন প্রতি শ্রমিক বাবদ কমিশন ২০ হাজার টাকা করে কেটে রেখে যদি ফান্ড তৈরি করা হয় তাহলে পাঁচ লাখ কর্মী পাঠানোর টার্গেটে তাদের এক হাজার কোটি টাকা উঠে আসবে। এই টাকার একটি অংশ দিয়ে গতবারের মতো এবারো তারা সবাইকে ‘ম্যানেজ’ করার চেষ্টা করবে। গতবার অবশ্য ফান্ডে প্রতি শ্রমিকের নামে রাখা হতো ১৫ হাজার টাকা করে। সেই ফর্মুলা নিয়ে সিন্ডিকেট সদস্যদের মধ্যে কখনো সামনাসামনি আবার কখনো টেলিফোন, হোয়াটসঅ্যাপে মিটিং চলছে।

নতুন সিন্ডিকেট হলে সেখানে থাকতে পারেন এমন দুই-তিনজন সদস্যের সাথে এ প্রতিবেদকের কথা হয়েছে আগেই। তারা রাখডাক না রেখেই বলেন, ‘গতবার সিন্ডিকেটের বিরোধিতা করেছিলাম। আমরা কী পেয়েছি, বরং আমরা এজেন্সি মালিক হওয়ার পরও আমাদেরকে দালাল হিসেবে কর্মী পাঠানোর অফার দিয়েছিল তারা। তাই এবার যদি সিন্ডিকেট করে কর্মী পাঠানো হয় তাহলে চিন্তাভাবনা করছি আমরা সেই সিন্ডিকেটে থেকে ব্যবসা করব। এমনটাই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছি। আর যদি সিন্ডিকেট না হয় তাহলে সবাই যেভাবে ব্যবসা করবে আমরাও সেভাবেই ব্যবসা করব। বরং সবাই ব্যবসা করলে সেক্ষেত্রে আমরাই বেশি লাভবান হবো। আমরাও চাই না মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে কোনো সিন্ডিকেট হউক। তাদের মতে, সরকার যদি কঠোর মনিটরিং করে তাহলে কেউ সিন্ডিকেট করার সাহস দেখাবে না। এমনিতেই মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলার কিছুদিন পরপরই বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের থাকতে হয় আতঙ্কে। এতে ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। তারা বলেন, শুধু ব্যবসায়ীরা নয়, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ও চাচ্ছে না, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে কোনো সিন্ডিকেট গড়ে উঠুক।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/593687