৯ জুলাই ২০২১, শুক্রবার, ৭:২৫

চট্টগ্রামে জাহাজীকরণের অপেক্ষায় ১২ হাজার টিইইউএস

রফতানিপণ্যের মাদারভেসেল কানেকশন পাচ্ছে না

সিঙ্গাপুর, কলম্বো ও পোর্ট কেলাংসহ ট্রান্সশিপমেন্ট হাব-পোর্টগুলোতে জটের কারণে সহজেই মাদারভেসেল (বড় জাহাজ) কানেকশন পাচ্ছে না বাংলাদেশের রফতানিপণ্যবাহী কনটেইনারগুলো। উদ্ভূত সমস্যার কারণে চট্টগ্রাম-সিঙ্গাপুর ও চট্টগ্রাম-কলম্বো রুটে চলাচলকারী ফিডার জাহাজগুলো ধারণক্ষমতার প্রায় ৩০ শতাংশ কম কনটেইনার নিয়েই চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে যাচ্ছে। ফলে এক দিকে সময়মতো রফতানিপণ্য বৈশ্বিক ক্রেতাদের কাছে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে, অন্য দিকে দিনের পর দিন অপেক্ষার কারণে গুনতে হচ্ছে কনটেইনারের বাড়তি ভাড়া। পাশাপাশি অফ-ডকগুলোতে (বেসরকারি আইসিডি) সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ জট। তাছাড়া অফ-ডকগুলোতে বিপুলসংখ্যক খালি কনটেইনার থাকলেও বৈশ্বিক ক্রেতাদের মনোনীত এমএলওর (মেইন লাইন অপারেটর) কনটেইনারেও সঙ্কট দেখা দিয়েছে। অবশ্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, বিভিন্ন এমএলও এবং ফিডার অপারেটরদের মধ্যে কমন ক্যারিয়ার অ্যাগ্রিমেন্ট ও কনটেইনার ডাইরেক্ট ইন্টারচেঞ্জ (ডিআই) প্রথা চালু করতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় এই সঙ্কটের সমাধান সম্ভব।
শিপিং সংশ্লিষ্টদের মতে, কোভিড পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক মন্দার কারণে শিপিং কোম্পানিগুলো মাদারভেসেল কমিয়ে দিয়েছে। তাছাড়া এমএলওরা ভাড়া কনটেইনার ছেড়ে দিয়েছে। পাশাপাশি চট্টগ্রাম-সিঙ্গাপুর, চট্টগ্রাম-কলম্বো ও চট্টগ্রাম-পোর্ট কেলাং রুটে চলাচলকারী ফিডার জাহাজগুলোও কনটেইনার পরিবহন কমিয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্ট সিঙ্গাপুর, কলম্বো ও পোর্ট কেলাং বন্দরে মারাত্মক জটের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে এক দিকে বড় জাহাজের (মাদারভেসেল) শিডিউল মিলছে না, অন্যদিকে কনটেইনার ভাড়াও বাড়ছে। এসব ট্রান্সশিপমেন্ট হাব-পোর্টে চট্টগ্রাম থেকে রফতানিপণ্যবাহী কনটেইনার পৌঁছানোর পর মাদারভেসেলের শিডিউল পেতে দুই সপ্তাহের অধিক সময় লাগছে। ফলে সময়মতো পণ্য রফতানি করা যাচ্ছে না। এমনি পরিস্থিতিতে বেসরকারি আইসিডিগুলোর শেডে প্রায় ১২ হাজার ২২৩ টিইইউএস রফতানিপণ্যবাহী কনটেইনার জাহাজীকরণের অপেক্ষায় বসে আছে।
বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোস অ্যাসোসিয়েশনের সচিব রুহুল আমিন সিকদার নয়া দিগন্তকে জানিয়েছে, চট্টগ্রামের ১৯টি বেসরকারি আইসিডিতে বর্তমানে প্রায় ৫৫ হাজার টিইইউএস কনটেইনারের স্তূপ জমেছে। এর মধ্যে প্রায় ৩৯ হাজার টিইইউএস খালি কনটেইনার। এছাড়া বেসরকারি আইসিডিতে রফতানির জন্য কনটেইনারজাত করতে রফতানিপণ্যবাহী বিপুলসংখ্যক ট্রাক আইসিডির বাইরে অপেক্ষমাণ রয়েছে। তিনি জানান, অফ-ডকগুলোতে সর্বমোট কনটেইনার ধারণক্ষমতা ৭৭ হাজার টিইইউএস হলেও রফতানি কনটেইনার তিন হাইয়ের (প্রতি ভাঁজে তিনটি) বেশি রাখা যায় না, কিন্তু খালি কনটেইনার পাঁচ হাই (প্রতি ভাঁজে পাঁচটি) রাখা যায়। ফলে ইয়ার্ডগুলো কলাপ্স হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তাছাড়া পণ্য রাখার ওয়্যারহাউজগুলোতে জায়গা খালি নেই বলেও তিনি জানান। গত দুই-তিন সপ্তাহ ধরে পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করেছে জানিয়ে তিনি এটি বৈশ্বিক সমস্যা হওয়ায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে দীর্ঘ সময় লেগে যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন। অফ-ডকে কনজেশনের জন্য তিনি মার্চ-এপ্রিলের তুলনায় জুন মাসে প্রায় ১০ হাজার টিইইউএস পণ্য বাড়তি রফতানি হওয়াও একটি কারণ বলে মন্তব্য করেন।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক গতকাল বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, সম্প্রতি কোভিড মহামারীর কারণে বিভিন্ন দেশে লকডাউনের জন্য সিঙ্গাপুর, কলম্বোসহ বিশ্বের বিভিন্ন বন্দরে জাহাজ এবং পণ্যের জট সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা যায়। এ মহামারীর কারণে বিশ্বব্যাপী গত এক বছরে বিভিন্ন দেশে লকডাউনের ফলে শ্রমিকসঙ্কট, আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা, বিশ্বের বিভিন্ন বন্দরে কনজেশনজনিত কারণে পণ্য পরিবহন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বৃহৎ বন্দরগুলো যথা: সিঙ্গাপুর, কলম্বো এবং চীনের বিভিন্ন বন্দরে কনজেশনের কারণে ওই সব বন্দরের জেটিতে জাহাজ ভিড়তে ৮-১০ দিন সময় লেগে যাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ, ভারত, কম্বোডিয়ার মতো ছোট বন্দর হতে ট্রান্সশিপমেন্ট হাব-পোর্টের মাধ্যমে মাদারভেসেলের রফতানিযোগ্য কনটেইনারের কানেকশন পেতে বিলম্ব হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর হতে কনটেইনার সিঙ্গাপুর, কলম্বো বন্দরে পৌঁছানোর পর মাদারভেসেল কানেকশন পেতে প্রায় দুই সপ্তাহ সময় লাগছে। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরে কোভিড মহামারীকালীনও আমদানি রফতানি কার্যক্রম নির্বিঘেœ পরিচালিত হয়েছে এবং চটগ্রাম বন্দর ২৪ ঘণ্টা চালু রয়েছে। ফলে ২০২০-২১ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দরে কার্গোতে ১১.৯৮ শতাংশ, কনটেইনার ৩.০৯ শতাংশ এবং জাহাজে ৭.৯২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। তিনি জানান, প্রতিদিন চট্টগ্রাম বন্দর হতে আমদানি রফতানি পণ্য নিয়ে ১০-১২টি জাহাজ বন্দরে আগমন ও নির্গমন করছে। তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে দেখা যায় প্রতিটি জাহাজেই তাদের প্রকৃত ধারণক্ষমতার চেয়ে ২৫-৩০ শতাংশ স্লট খালি নিয়ে যাওয়া আসা করছে। এতে প্রতীয়মান হয়, পণ্য পরিবহনে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজের কোনো ঘাটতি নেই। বহির্নোঙরে সাম্প্রতিককালে কনটেইনার জাহাজের অবস্থানকাল দুই-তিন দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে। বিভিন্ন এমএলও এবং ফিডার অপারেটরদের মধ্যে কমন ক্যারিয়ার অ্যাগ্রিমেন্ট ও কনটেইনার ডাইরেক্ট ইন্টারচেঞ্জের (ডিআই) প্রথা চালু না থাকায় বা দু-একটি এমএলও এবং ফিডার অপারেটরের মধ্যে অ্যাগ্রিমেন্ট থাকলেও তার ফলপ্রসূ প্রয়োগ না থাকায় রফতানিপণ্য পরিবহনে সমন্বয়হীনতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। পরস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে একে অপরের কনটেইনার ব্যবহার করতে পারলে এবং একে অপরের জাহাজের অব্যবহৃত স্লট ব্যবহার করলে আমদানি রফতানিপণ্য পরিবহন আরো সহজ হবে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/593697