৮ জুলাই ২০২১, বৃহস্পতিবার, ৭:১৮

হাসপাতালেও অসহায় তারা

মহাখালী বাস টার্মিনাল। লকডাউনে নীরব নিস্তব্ধ। সড়কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকদের
সরব উপস্থিতি। সড়কের পাশের দোকানগুলো বন্ধ থাকলেও গলির দোকানগুলো খোলা। রাজধানীসহ গোটা দেশের করোনাভাইরাসের সব থেকে বড় হাসপাতাল ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড হাসপাতাল। এই হাসপাতালে গত সোমবার রাতে সরজমিন দেখা যায়, চারদিকের নীরবতা ভেঙে এক এক করে আসছে এম্বুলেন্স। আর স্বজনরা ছুটছেন সেবার আশায়। কোনো রোগীকেই ফিরতে হয়নি।
রোগী আসার সঙ্গে সঙ্গেই ভর্তি হতে পারছেন, মাত্র ১০ টাকা টিকিটে। সেইসঙ্গে হাসপাতালের সকল চিকিৎসা মিলছে বিনামূল্যে। টাকা লাগছে শুধুমাত্র বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য।
হাসপাতালের তিন তলায় সাধারণ ওয়ার্ড, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। একেকটি কক্ষে রাখা হয়েছে একেকটি বেড। এছাড়াও বড় স্থানে আটটি বেডের রুমও আছে। প্রত্যেকটি রোগীর জন্য আছে সেন্ট্রাল অক্সিজেন। এক বেডের রুমে রোগীর সেবার জন্য সবই রয়েছে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বেড-চাদর, সেন্ট্রাল অক্সিজেন, ডাস্টবিন, উপরে পুরোদমে ঘুরছে ফ্যান, আছে দুটি লাইট। রোগীদের ওয়াশরুমে যাওয়ার প্রয়োজনে ডাকলেই মিলছে স্ট্রেচার, হুইল চেয়ার, অক্সিজেন সিলিন্ডার। সেই সিলিন্ডারের অক্সিজেন থেকে নামিয়ে আবার পরিয়ে দেয়া হচ্ছে সেন্ট্রাল অক্সিজেন।
এতো সুবিধার মাঝেও ভালো নেই কেউ। হাসপাতালের বিশ্রামের স্থানে ছুটে বেড়াতে দেখা যায় ছোট্ট হাবিবকে। সবে দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী সে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে মায়ের সঙ্গে এসেছে। ১২ দিন ধরে অবস্থান করছে সে। সঙ্গে আছে বড় ভাই ও বোন। মায়ের পাশেই থাকে বোন। আর বড় ভাই হাবিবকে সামলাতেই ব্যস্ত। এই একবার মাস্ক খুলে রাখছে, আরেকবার এদিক-সেদিক দৌড় দিচ্ছে। হাবিবদের পাশে আর কেউ নেই। তাদের বাবা প্রবাসী। পরিবারের সবাই খোঁজ নিলেও পাশে আসছেন না কেউই।
হাবিবের বড় বোন একাদশ ও ভাই নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ছোট্ট তিনজনই মায়ের জন্য লড়াই করছে। গত সোমবার রাতে হাসপাতাল থেকে দেয়া খাবার খাইয়ে দিচ্ছিলেন হাবিবের বড় বোন। হাবিব মায়ের সঙ্গে খুনসুটি করলেও কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছিলেন না মা। ভাই তাকে উড়োজাহাজ কিনে দিয়েছেন। এক পর্যায়ে তার মা রওশন ইসলামকে হাবিব বলে, আম্মা এমন উড়োজাহাজে কইরা কী আব্বায় আইবো? এই কথা হাবিব বলার পরই কান্না শুরু করে দেন তিনি। বাড়তে থাকে অক্সিজেনের চাপ। খাওয়া ফেলে ফের তুলে নেন অক্সিজেন মাস্ক। নার্স এসে পালস অক্সিমিটার দিয়ে মেপে ওষুধ খাওয়ালেন। এর প্রায় ১০ মিনিট পর স্বাভাবিক তিনি। ততক্ষণে হাবিবেরও কান্না থামলো। মায়ের জন্য আনা সুপ হাবিবকে খাইয়ে দিলেন বোন। রাত আনুমানিক ১১টা। হাবিব ওয়ার্ডের বাইরে খেলছে বড় ভাইয়ের সঙ্গে। আর মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছিলেন বোন।
করোনা ইউনিটের চারদিক খোলা। গ্রিলের মাঝে দিয়ে হুহু করে আসছে বাতাস। কিন্তু মাস্ক পরা স্বজনরা কই আর সেই বাতাস নিতে পারেন। করোনা আক্রান্ত স্বজনদের সেবায় নিয়োজিত থেকে নিজে আক্রান্ত না হওয়ার ভয়ে অবলম্বন করেন সর্বোচ্চ সতর্কতা। কিন্তু পুরাতন ভর্তি রোগীদের সেই সতর্কতার মাত্রা নতুন রোগীদের ক্ষেত্রে অনেকটাই কম। মাস্ক ছাড়াই চলাফেরা করেন অনেকেই। পারভেজ ইসলাম সিরাজগঞ্জ থেকে বাবাকে নিয়ে এসেছেন। বলেন, বাবার পাশ থেকে এক মুহূর্তের জন্য নড়া যায় না। এখন বাধ্য হয়ে এখানেই খেতে হয়। মাস্ক পরে তো আর খাওয়া যায় না। তিনি আরও বলেন, অনেক সময় অস্বস্তিতে ভুগী। সারা দিন মাস্ক পরে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে যাই।
আপনার পায়ে ধরি আমারে বিষ দেন। আমারে মেরে ফেলেন। আমি আর কষ্ট সহ্য করতে পারছি না। এভাবেই কান্নাজড়িত কথাগুলো বলছিলেন প্রায় ৬০ বছর বয়সী রোকেয়া বেগম (ছদ্ম নাম)। মা-ছেলে আক্রান্ত। ২০ পা সামনে ছেলে, ছেলের বউ থাকলেও দেখার কেউ নেই তার। তার ছেলে ২৮ বছর বয়সী অর্জন (ছদ্ম নাম) প্রায় সুস্থ। ছেলের বউ স্বামীর সঙ্গে থাকলেও মায়ের কাছে আসে না। রোকেয়ার এই কষ্ট দেখে মায়ের পাশে বেডের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন ডাক্তার। আগে কিছুটা দূরে থাকলেও রোববার রাতে শাশুড়ি ও স্বামী ছিলেন পাশাপাশি। মাঝে শুধু দেয়াল। এতো পাশে থাকার পরও একবারও আসেননি মায়ের পাশে।
রাতে অক্সিজেনের পানি শেষ হয়ে গিয়েছিল। পাশে নেই কেউ। দীর্ঘ সময় চিৎকার করার পর বিপরীতে থাকা স্বজনের নজরে পড়ে। এরপর নার্সকে ডেকে দেয়া হয়। কান্না করে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন রোকেয়া।
কোনো কারণ ছাড়াই রোকেয়ার ছেলে সোমবার চলে যান অন্য ওয়ার্ডে। তার স্বজনরা সারা দিন থাকলেও রাতে থাকতে পারেন না। কিন্তু ছেলের বউ থাকার পরও ১২ ঘণ্টা ওয়াশরুমে যেতে পারেননি তিনি। সোমবার তার স্বামীর ছোট ভাই রাত ১০টার দিকে নিয়ে গিয়েছিলেন ওয়াশরুমে। এরপর ফের সকালে এসে ১০টায় ওয়াশরুমে নিয়ে যান তিনি। তার স্বামীর ছোট ভাই বলেন, তার মা অসুস্থ। বউকে দোষ দিয়ে কী লাভ?
পাশেই আরেক বেডে মেলে ভিন্ন চিত্র। রাত ২টার দিকে হঠাৎ চিৎকার করে ডাকতে থাকেন নার্সকে। নার্সের সঙ্গে এগিয়ে গিয়ে দেখা যায়- অক্সিজেন মাস্কের ভিতরেই বমি করেছেন বৃদ্ধা শাশুড়ি। মাস্ক খুলে রেখেছেন কিন্তু অক্সিজেন স্বল্পতার কারণে হয়তো হেঁচকি উঠতে থাকে। নার্স এসে দ্রুত আরেকটি সিলেন্ডারের অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে দেন। প্রায় ৫-৬ মিনিট পর থামে হেঁচকি। বমি পরিষ্কার করে ফের আগের মাস্ক পরে শুয়ে পড়েন তিনি।
সদা হাস্যোজ্জ্বল শিক্ষক ইতি মনি এসেছেন রংপুর থেকে। তিনি বলেন, আমি আমার স্বামীকে আসতে না করেছি। এখনতো স্কুল বন্ধ। আমার একটা মেয়ে, ওকে নিয়েই আছে। এখানে মায়ের (শাশুড়ি) সেবা করতেছি। আল্লাহর রহমতে এখনো আক্রান্ত হইনি। সারা দিন মায়ের কাছে থাকি আর কিছু লাগলে বাইরে থেকে নিয়া আসি। দিনে দু’বার গেলেই হয়। এখন আল্লাহর রহমতে মা সুস্থ হওয়ার পথে। বয়স হওয়ার কারণে একটু কাবু হয়ে গেছে। ইনশাআল্লাহ আমি একাই সুস্থ করে নিয়ে যাবো।
রাত ২টা। হাসপাতালের বাইরে হাঁটছিলেন কেরানীগঞ্জ থেকে আসা আসাদুল ইসলাম। তার মেয়ের জামাই ৮ দিন ধরে ভর্তি। হাঁটছিলেন আর কেঁদে কেঁদে মেয়ের সঙ্গে কথা বলছিলেন। রাখার আগে বলেন, ‘তোর আইবার দরকার নেই মা। এহানে আমি আছি। জামাইরে সুস্থ কইরাই বাড়ি ফিরুম। তুই খালি আল্লাহ আল্লাহ কর।’
আসাদুল ইসলাম জানান, তার মেয়ের জামাই ট্রাক চালক। হঠাৎ জ্বর-সর্দি নিয়ে বাড়িতে আসেন। হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। এরপর নিয়ে আসেন এখানে। সারা দিনরাত ভালো থাকে। অধিকাংশ সময় অক্সিজেন মাস্ক ছাড়াই থাকে। কিন্তু ভোর হলেই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। ভোর ৪টা থেকে ৬টা এই সময়টা পাশে থাকতেই হয়। তিনি আরও জানান, জামাইয়ের পাশে থাকার জন্য তার মেয়ে, দুই ছেলে আসতে চায়। কিন্তু তিনি রাজি হন না। বলেন, ‘আল্লাহ লইলে আমারে লউক। মাইয়াডা, জামাই, নাতি দুডার জন্য নিজে মরি হ্যারা সুস্থ থাক।’
রাত বাড়ে, দীর্ঘ হয় নীরবতা। কিন্তু আশেপাশের ফার্মেসির দোকানগুলোতে ভিড় লেগেই থাকে। করোনা ওয়ার্ডগুলোতে থাকতে থাকতে শোনা যায়, রোগী অক্সিজেন পাচ্ছে না। বুকে ব্যথা হচ্ছে।

https://mzamin.com/article.php?mzamin=282560&cat=3