৮ জুলাই ২০২১, বৃহস্পতিবার, ৭:১৬

৬৪ জেলায় সমাজসেবা কমপ্লেক্স নির্মাণ

চৌকাঠে ফাটল দেয়ালে নোনা

নির্মাণকাজ ও সামগ্রী নিম্নমানের; ফিজিবিলিটি স্টাডি ও বেইজলাইন সার্ভে করা হয়নি; সঠিক ব্যবস্থাপনা

যথাযথ তদারকির অভাবে দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। প্রকল্পের নির্মাণকাজ এবং সামগ্রীর মান নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। মানসম্পন্ন নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার না করায় কাজ চলাকালেই দেয়াল সাদা সাদা, প্লাস্টারে উঁচু-নিচুসহ বিভিন্ন অসামঞ্জস্যতার তথ্য পাওয়া গেছে ৬৪ জেলায় সমাজসেবা কমপ্লেক্স নির্মাণের প্রথম পর্যায়ে ২২ জেলায় ভবন নির্মাণ প্রকল্পে। এসব তথ্য পরিকল্পনা কমিশনের খোদ আইএমইডির প্রতিবেদনেই রয়েছে। আইএমইডি বলছে, প্রকল্প বাস্তবায়নে সঠিক ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিংয়ের অভাব এবং অদক্ষতার কারণে সময়মতো দরপত্র আহ্বান করতে পারেনি বাস্তবায়নকারী সংস্থা। ডিপিপি যথাযথভাবে প্রণয়ন না হওয়ায় এবং ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার কারণে বাস্তবায়ন বিঘিœত হচ্ছে। আর প্রকল্প পরিচালক বলছেন, তাদের প্রতিবেদন আমি দেখিনি। কোথায় তারা কাজের মান খারাপ পেলেন সেটা দেখতে হবে। পরিকল্পনা কমিশন থেকে দুই বছর সময় বাড়ানো হয়েছে।

উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) থেকে জানা গেছে, সমাজসেবা অধিদফতরের জেলা পর্যায়ে নিজস্ব কোনো ভবন না থাকায় তাদের কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটছে। অন্যদিকে ভাড়া করা ভবনের ব্যয় পরিশোধ করতে সরকারকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ব্যয় করতে হচ্ছে। সে জন্যই ৬৪ জেলায় সমাজসেবা কমপ্লেক্স নির্মাণের প্রথম পর্যায়ে ২২ জেলায় ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। এতে ৩২৯ কোটি ২১ লাখ ৮০ হাজার টাকা খরচে তিন বছরে বাস্তবায়নের জন্য ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট একনেক থেকে অনুমোদন দেয়া হয়। ২০২০ সালের জুনে প্রকল্পটি সমাপ্ত করার কথা ছিল। ২০২০ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ব্যয় বাড়িয়ে ৩৬৬ কোটি ৩৪ লাখ ৫১ হাজার টাকা এবং মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত অনুমোদন দেয়া হয়।

প্রকল্পের এলাকাগুলো হলো- ঢাকা, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালী, সিলেট, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, রংপুর, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, খুলনা, বরিশাল ও ঝালকাঠি। প্রকল্পের প্রধান কাজগুলো হলো- ৬৪ হাজার ১২৯.১৮ বর্গমিটার অনাবাসিক ভবন নির্মাণ, দু’টি মোটর যান ক্রয়, পাঁচ হাজার ৪৯৩টি আসবাবপত্র ক্রয় এবং ৫৪৫টি কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক ক্রয়। ৬ তলা ফাউন্ডেশনের ওপর ৬ তলা কমপ্লেক্স নির্মাণ করাই মূল কাজ। কারণ বছরে অফিস ভাড়া বাবদ রাজস্ব খরচ হচ্ছে পাঁচ কোটি টাকা।
কাজের বর্তমান অগ্রগতি হলো- চলতি ২০২১ সালের মে পর্যন্ত ১৬৮ কোটি ৯১ লাখ ৭০ হাজার টাকা খরচ করে বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ, যা সন্তোষজনক নয় বলে পরিকল্পনা কমিশন অভিমত দিয়েছে। ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত অগ্রগতি ছিল মাত্র ২৫ শতাংশ। অথচ প্রকল্পটি তখন সমাপ্ত হওয়ার কথা ছিল। এখন ২০২১ সালেও প্রকল্পটি সমাপ্ত হবে না।

কাজের গুণগতমান পর্যালোচনার প্রতিবেদনে দেখা যায় রাজশাহী, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, রংপুর, খুলনা, সিরাজগঞ্জ, লালমনিরহাট ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত ইটের মান সন্তোষজনক নয়। আবার অনেক জায়গা বিশেষ করে নেত্রকোনা, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, খুলনা, রাজশাহীতে ৬তলা ভবনের দেয়ালজুড়ে প্লাস্টারের অনেক জায়গায় সাদা সাদা লোনা ভেসে উঠেছে। প্লাস্টার করার সময় ভালো মানের বালু ব্যবহার না করায় এই ধরনের লবণাক্ততা হয়ে থাকে। কোথাও কোথাও এলসির মাধ্যমে ভারতীয় পাথর ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার কোথাও কোথাও বুড়িমারি, সোনামসজিদ, পঞ্চগড় থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে। নোয়াখালী, হবিগঞ্জ, সিলেটে মূল স্ট্রাকচারের ঢালাই কাজে যে পাথর ব্যবহার করা হচ্ছে তা সন্তোষজনক নয়। পাথরে অনেক ধরনের ময়লা বা আবর্জনা দেখা যায়।

অবকাঠামোর ক্ষেত্রে দেখা যায়, নেত্রকোনায় বারান্দার রেলিংয়ে একপাশ থেকে অন্যপাশে এক ইঞ্চি বাঁকা রয়েছে। অর্থাৎ রেলিংয়ের কাজ ঠিকভাবে করা হয়নি। বিম ও কলামে দুইবার প্লাস্টার করার কারণে জয়েন্টে উঁচু বা নিচু দেখা যায়। কলাম ও বিমে চিপিং সঠিকভাবে করা হয়নি। বেশির ভাগ লিন্টেলের ঢালাই ঠিকভাবে করা হয়নি। ভাইব্রেটর সঠিকভাবে ব্যবহার না করায় বেশির ভাগ লিন্টেলের ঢালাইয়ে ফাঁকা দেখা দিয়েছে এখনই। দরজার জন্য ব্যবহৃত চৌকাঠের গুণগত মান সন্তোষজনক নয়। কিছু কিছু চৌকাঠে চিড় বা ফাটল দেখা দিয়েছে। চৌকাঠের সাইটে ওয়ালের সংযোগ স্থানে অনেকটুকুই ফাঁকা। এমনকি ইলেকট্র্রিক্যাল বক্সও সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয়নি। আবার সেপটি ট্যাংকি ঢালাই করার সময় কোনো সংযোগ দেয়া হয়নি। ফলে ঢালাই ভাঙার সময় মূল স্ট্রাকচার বা কাঠামো নষ্ট হতে পারে।

ময়মনসিংহে নির্মাণ কাজে ঢালাইয়ে পলিথিন ব্যবহার করার পর তা অপসারণ করা হয়নি। এমতাবস্থায় চিপিং ছাড়া প্লাস্টার করলে তা হবে হুমকিস্বরূপ। বারান্দায় রেলিং হিসেবে যে ইটের গাঁথুনি করা হয়েছে তাতে কোনো ধরনের সাপোর্ট দেয়া হয়নি, যা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। রেলিং পরিমাপ করে দেখা যায় একপাশ থেকে অন্যপাশে এক থেকে দুই ইঞ্চি বাঁকা। দরজার চৌকাঠের কাঠ ভালো না। কিছু কিছু চৌকাঠে চিড়ল বা ফাটল দেখা দিয়েছে। চৌকাঠের সাইটে ওয়ালের সংযোগ স্থানে অনেকটুকুই ফাঁকা। এমনকি ইলেকট্র্রিক্যাল বক্সও সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয়নি।
সিরাজগঞ্জের কাজে দেখা যায়, বারান্দার রেলিংয়ে ইটের যে গাঁথুনি করা হয়েছে তাতে কোনো ধরনের সাপোর্ট দেয়া হয়নি, যা ঝুঁকিপূর্ণ। রডগুলো খোলা জায়গাতে রাখায় গুণগত মান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া বেশির ভাগ জেলায় গাঁথুনিতে ব্যবহার করা ইটের মান ও বালুর মান ভালো না থাকায় ওয়াল এখনই সাদা সাদা হয়ে পড়েছে।

আইএমইডি বলছে, ২২ জেলার মধ্যে সাত জেলায় যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই ভেরিয়েশন করা হয়েছে। এখানে ফরিদপুরে ১২.১২ শতাংশ, চট্টগ্রামে ১৭.২৪ শতাংশ, দিনাজপুরে ৪.৪৮ শতাংশ, নেত্রকোনায় ২১.২১ শতাংশ, রংপুরে ৬.৪৭ শতাংশ, ময়মনসিংহে ১৪.৫৪ শতাংশ, কিশোরগঞ্জে ৯.৩৯ শতাংশ ভেরিয়েশন করা হয়েছে।
নির্মাণের সাথে সংশ্লিষ্ট গণপূর্ত অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে যথাসময়ে বিল প্রদান করতে পারছেন না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বর্তমানে ভেরিয়েশন প্রয়োজন। কারণ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি অনুযায়ী যে টাকা বরাদ্দ ছিল, সেই টাকার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এখন বাকি কাজ সম্পন্ন করতে ভেরিয়েশন অনুমোদন প্রয়োজন। এ ছাড়া ফিনিশিং কাজ শেষের দিকে। এখনো টাইলসের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত স্থাপত্য অধিদফতর থেকে আসছে না। ফলে কাজে বিলম্ব হচ্ছে। স্থাপত্য অধিদফতর থেকে ডিজাইন পেতে বিলম্ব হওয়ার কারণে নির্মাণকাজেও ব্যাঘাত ঘটে।

আইএমইডি বলছে, জেলা পর্যায়ে কর্মরত সব মা ও শিশুর জন্য সমাজসেবা কমপ্লেক্স ভবনে কোনো নির্দিষ্ট জায়গা রাখা হয়নি। অথচ প্রকল্পের একটি উদ্দেশ্য এটি ছিল। প্রকল্পে ফিজিবিলিটি স্টাডি ও বেইজলাইন সার্ভে করা হয়নি। ফলে প্রকল্প গ্রহণকালীন প্রকল্পের চাহিদা সম্পর্কিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। প্রকল্প বাস্তবায়নে সঠিক ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিংয়ের অভাবের কারণে সময় মতো দরপত্র আহ্বান করতে পারেনি বাস্তবায়নকারী সংস্থা। প্রকল্প বাস্তবায়নের অর্ধেকের বেশি সময় অতিবাহিত হওয়ার পরেও বাগেরহাট, কুমিল্লা ও কক্সবাজারে জমি প্রাপ্তির জন্য চেষ্টা চালানো হয়। তারও ৯ মাস পর বাগেরহাট জেলা পরিবর্তন করে সুনামগঞ্জ জেলাকে নির্বাচন করা হয়। এসবই ব্যবস্থাপনার অদক্ষতার পরিচয়। প্রকল্পটি যথাসময়ে সমাপ্ত করতে না পারলে যেমন বিভিন্ন অঙ্গের ব্যয় বৃদ্ধি পাবে, তেমনিভাবে অফিস ভাড়া বাবদ প্রতি মাসে গড়ে ৬০ হাজার টাকা ব্যয় হবে। নতুন ভবন থেকে ভাড়া বাবদ সরকার রাজস্ব আয় থেকেও বঞ্চিত হবে।

প্রকল্পের ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ড. অঞ্জন কুমার দেব রায়ের সাথে গতকাল বুধবার ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রকল্পটি ভালোভাবেই চলছে। মেয়াদ আরো দুই বছর বাড়ানো হয়েছে। আগামী ২০২৩ সালের জুনে শেষ হবে। জমি প্রাপ্তি নিয়ে জটিলতা ও বিলম্বের কারণেই মূলত প্রকল্পের কাজ শুরু এবং সমাপ্ত করতে সময় লাগছে। তবে এখন পর্যন্ত অগ্রগতি ভালো।

অন্যদিকে আইএমইডি নির্মাণকাজে বেশ কিছু অনিয়ম ও কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ড. অঞ্জন কুমার দেব রায় বলেন, তাদের প্রতিবেদন আমি দেখিনি। কোথায় তারা কাজের মান খারাপ পেলেন সেটা দেখতে হবে।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/593490/