৮ জুলাই ২০২১, বৃহস্পতিবার, ৭:১৫

করোনার এতো রোগীর ঠাঁই হবে কোথায়?

কঠোর বিধি নিষেধের মধ্যেও গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে মৃত্যু এবং শনাক্ত একের পর এক রেকর্ড ভেঙে চলেছে। গত এক সপ্তাহে শনাক্তের সংখ্যা অর্ধ লক্ষ ছাড়িয়েছে। আর মৃত্যু প্রতিদিন গড়ে দেড় শতাধিক। প্রশ্ন হচ্ছে প্রতিদিন যে এতো রোগী বাড়ছে তাতে হাসপাতালের স্থান সংকুলান বাড়ছে না। বাড়ছে না চিকিৎসক সংখ্যা। না বাড়ছে নার্স এবং অন্যান্য জনশক্তি। এমতাবস্থায় অক্সিজেনের ব্যবস্থাপনা নিয়েও বাড়ছে উদ্বেগ। সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো দেশের বড় বড় হাসপাতালগুলোতে কোন সিট নাই। ফলে নতুন করে রোগী ভর্তি নিতে ভাবতে হচ্ছে। বলা হচ্ছে রোগীর অবস্থা বেশি খারাপ না হলে ভর্তিই নিচ্ছে না।

গতকাল দেশে করোনায় এ যাবৎকালের সকল রেকর্ড ভেঙে ২০১ জনের মৃত্যু হয়েছে। দেশবাসী এর আগে একদিনে এত মৃত্যু দেখেনি। দেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে ক্রমাগত ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে করোনা। এ ছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে করোনা শনাক্ত হয়েছেন ১১ হাজার ১৬২ জন। যা দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শনাক্ত। এ নিয়ে দেশে মোট করোনা শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়াল ৯ লাখ ৭৭ হাজার ৫৬৮ জনে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার তৃতীয় ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে-গ্রামেগঞ্জে। দিন যতই গড়াচ্ছে; পরিস্থিতির ভয়াবহতার দিকে যাচ্ছে। ঢাকার বাইরে উচ্চঝুঁকিতে রাজশাহী, খুলনা, কুষ্টিয়া, টাঙ্গাইল ও সাতক্ষীরা জেলা। গতকাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় দুইশ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। ২৪ ঘণ্টায় ২৫ জেলায় ১৯৭ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও বলছে, দেশে করোনার মৃত্যু ও সংক্রমণের ৫০ শতাংশই ঘটছে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা শহরে।
এদিকে জেলাগুলোতে করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়া স্থানীয় হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার সংকুলান হচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়েই রাজধানী ঢাকার দিকে ছুটছেন মানুষ করোনা আক্রান্ত রোগী নিয়ে। ফলে গ্রাম থেকে আসা রোগীর চাপ বাড়ছে শহরের হাসপাতালগুলোতে। স্থান সংকুলান না হওয়ায় এখান থেকেও ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে ভর্তি না নিয়েই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাতে বয়সী এবং ঝুঁকিপূর্ণদের ভ্যাকসিনের বাইরে রেখে এবং জেলাশহরগুলোতে ভ্যাকসিন দেওয়ার হার না বাড়ানো গেলে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু কমানো যাবে না। এছাড়া মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে না পারলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহতার দিকে যাবে।

বিএসএমএমইউয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান মো. সায়েদুর রহমান বলেন, জেলাগুলোতে ১২০০ থেকে ১৫০০ ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে। ১৫ লক্ষ মানুষের মধ্যে মাত্র এই কজন করে ভ্যাকসিন পেয়েছেন। এসংখ্যা আরও বাড়াতে হবে।
জনস্বাস্থ্য ও ভ্যাকসিন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বয়সী ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীই করোনার মৃত্যু ঝুঁকিতে। আর ভ্যাকসিন দেওয়ার মূল উদ্দেশ্যই হলো মৃত্যু হার কমানো একই সাথে আক্রান্তদের রোগ জটিলতা কমিয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বা হাসপাতালের চাপ কমানো। তাই ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে যতটা দ্রুত সম্ভব ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে হবে। মো. সায়েদুর রহমান আরও বলেন, ভ্যাকসিন দেওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য মৃত্যু কমানো। তাই বেশি প্রাণ হারাচ্ছে যারা তাদের আগে ভ্যাকসিনেটেড করতে হবে। ৯০ ভাগ মানুষ মারা যাচ্ছে ৪০ এর বেশি বয়সী। আগে তাদের ভ্যাকসিন দিতে হবে। ৭০ ভাগ মানুষ মারা যাচ্ছে ৫০ বছরের বেশি বয়সী। এমনটা করা হলে প্রায় ৯৯ ভাগ মৃত্যু কমে যাবে। গণনিবন্ধনের মাধ্যমে একই অঞ্চলে একই সাথে ভ্যাকসিন গ্রহণকারীর আওতা বাড়িয়ে ভাইরাসের নতুন ধরণ ঠেকানো সম্ভব বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে, কয়েকদিন ধরে শনাক্ত এবং মৃত্যু বেড়ে যাওয়ায় ব্যাপক ভীতির সঞ্চার হয়েছে মানুষের মধ্যে। ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়ার ৩ দিন দিনের মাথায় অক্সিজেনের প্রয়োজন হচ্ছে যা; আগে অজান্তেই করোনা হয়ে বিদায় নিয়েছে বলে ধারণা করা হতো। হাসপাতাল গুলোতে চাপ বাড়ায় রোগীর অবস্থা খুব বেশি খারাপ না হলে মিলছে না ভর্তির অনুমতিও। আর সরকারি কোনো হাসপাতালে আইসিইউ না থাকায় সবাই ভিড় করছেন ডিএনসিসি হাসপাতালে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন,আইসিইউ তো দূরের কথা রাজধানীর করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতলে একটি শয্যা পাওয়াই এখন দুরূহ হয়ে উঠেছে। এ যেন সংক্রমণের হারের সঙ্গে যেন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দুর্ভোগ। বাড়ছে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে রোগী নিয়ে স্বজনদের ছোটাছুটি। অনেকেই হাসপাতালে একটি সিট পাওয়ার জন্য উচ্চ পর্যায় থেকে তদবির করা হচ্ছে।

রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নির্ধারিত ৩০০ বেড শেষ বহু আগেই। রোগীর সংখ্যা এখন চার শতাধিক। তবু প্রতিদিনই ৫০ জনের বেশি রোগী বাড়ি পাঠিয়েও ঠাঁই মিলছে না হালকা শ্বাসকষ্ট নিয়ে আসা রোগীদের। আবার যাদের অবস্থা বেশি খারাপ অর্থাৎ আইসিইউ দরকার তাদেরও বাধ্য হয়েই ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে।
হাসপাতালগুলোর তথ্য অনুযায়ী দেশের ৮ বিভাগে মোট করোনার জন্য নির্ধারিত শয্যা সংখ্যা ১২ হাজার ৩৪৭টি, মোট আইসিইউ শয্যা সংখ্যা ১ হাজার ৯২ টি। আট বিভাগের মধ্যে ঢাকা মহানগর হাসপাতালগুলোতে মোট জেনারেল বেড সংখ্যা ৫ হাজার ৬২৬টি। এই হাসপাতালগুলোর মধ্যে সরকারি ১৩টি এবং বেসরকারি ১৩টি হাসপাতাল রয়েছে। ঢাকা মহানগরের ১৩টি করোনার জন্য নির্ধারিত সরকারি হাসপাতালের মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ৭০৫টি বেড।
সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের ১০টি জেনারেল বেড। জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের ১৩৭টি জেনারেল বেড। টিবি হাসপাতালের ২০০টি জেনারেল বেড। রয়েছে পাঁচটি আইসিইউ বেড। ডিএনসিসি হাসপাতালের ২০০টি জেনারেল বেড। এখানে রয়েছে মোট ১০০টি আইসিইউ বেড।

পরিসংখ্যান বলছে যেভাবে করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে অনেক আগেই হাসপাতালগুলোতে রোগীতে ঠাঁই নাই অবস্থা। এখন কেউ যদি হাসপাতাল ছেড়ে চলে যায় তাহলে খালি হচ্ছে। এর জন্য লাইন ধরছেন অনেক মানুষ। ডিএনসিসি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন বলেন, এই ধারায় যদি প্রতিনিয়ত রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে, তাহলে একটা সময়ে আমরাও গভীর সংকটে পড়ে যাব। বিশেষ করে গুরুতর রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে।
গতকাল স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম জানিয়েছেন, জানুয়ারি মাসে সংক্রমণের যে হার ছিল সেখানে শনাক্ত রোগীর ছিল ২১ হাজার ৬২৯ জন। এপ্রিল মাসে সেটি লাখ ছাড়িয়েছিল। জুন মাসে সেটি এক লাখ ১২ হাজার ৭১৮ জনে থেমে ছিল। জুলাই মাসের মাত্র সাত দিন অতিক্রান্ত হচ্ছে। ছয় দিনে ৫৩ হাজার ১৪৮ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। সংক্রমণের উচ্চমুখী এই প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে, জুলাই মাসে রোগী সংখ্যা এপ্রিল ও জুন মাসকে ছাড়িয়ে যাবে। রোগী সংখ্যা যদি অস্বাভাবিক বেড়ে যায়, যেটি লকডাউন বা বিধি-নিষেধ অমান্য করার ঘটেছে। তাহলে আমরা আবারও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যাব।

তিনি আরও বলেন, স্বাভাবিক সময়ে বাংলাদেশে ৫০ থেকে ৭০ মেট্রিক টন অক্সিজেনের চাহিদা থাকে। করোনাকালে সেটি আড়াই থেকে তিন গুণ বেড়েছে এবং রোগী সংখ্যা যদি এভাবে বাড়তে থাকে তাহলে সেটি সামাল দেওয়া আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং হবে।
ফিল্ড হাসপাতাল বানানোর চিন্তা
করোনায় রোগী শনাক্তের ঊর্ধ্বগতিতে প্রয়োজনে ফিল্ড হাসপাতাল করা হবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। একইসঙ্গে করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের শয্যা বাড়ানো ও জনবল পুনর্বন্টন করা হচ্ছে বলেও জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। বুধবার স্বাস্থ্য অধিদফতর আয়োজিত ভার্চুয়াল বুলেটিনে এ কথা জানান অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম।

তিনি বলেন, আমাদের যেসব হাসপাতালে করোনার চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে, সেই হাসপাতালগুলোতে কীভাবে শয্যার সংখ্যা বাড়ানো যায়, জনবল কীভাবে পুনর্বণ্টন করা যায়, আমরা সে দিকে মনোযোগ দিয়েছি। এর বাইরে ফিল্ড হাসপাতাল করা যায় কিনা সে বিষয়টি আমরা যাচাই বাছাই করছি। প্রয়োজন হলে ফিল্ড হাসপাতাল করবো।

https://dailysangram.com/post/457947