৮ জুলাই ২০২১, বৃহস্পতিবার, ৭:১৩

লকডাউন কারো জন্য নিরাপত্তার আর কারো জন্য না খেয়ে থাকার!

করোনা মানুষের জীবনকে কঠিন করে তুলেছে। লকডাউনে সেই কঠিন জীবন হয়েছে আরও কঠিনতর। কবে নাগাদ এ অবস্থার পরিবর্তন হবে তা সবার অজানা। ৪ জুলাই দেশে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড ১৫৩ জন।
দেশে করোনার তৃতীয় ওয়েভ চলছে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে এবারে সংক্রমণের হার অনেক বেশি। সেখানে পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি হচ্ছে। দেশ জুড়ে ঘোষণা করা হয়েছে লকডাউন বা শাটডাউন।
করোনার প্রথম ঢেউ ছিল প্রধানত শহরকেন্দ্রিক। তখন অনেকে করোনা থেকে রক্ষা পেতে গ্রামে চলে গিয়েছিলেন। এবার শহর ও গ্রাম উভয় অঞ্চলে সমানভাবে সংক্রমিত হচ্ছে। তাই আগের মত মানুষকে গ্রামে গেলেই ঝুঁকি কমবে না। বরং আসা-যাওয়ার পথে তারা বহু মানুষের সংস্পর্শে এসে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি আরও বেড়ে যাবে।
করোনা ভাইরাসের ‘ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট’ আগামী কয়েক মাসে পুরো বিশ্বেই সংক্রমণ ছড়াতে পারে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। (সূত্র: এনডিটিভি)
খবরে প্রকাশ এরই মধ্যে ১০০টি দেশে এই ভেরিয়েন্টের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। ভারতেই প্রথম শনাক্ত হওয়ায় করোনার এই ভ্যারিয়েন্ট ভারতীয় ধরন হিসেবে পরিচিত হয়। করোনার নতুন ধরন যে কোন সময় হঠাৎ করে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। এ প্রসঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ কিম উও-জো বলেন -আমরা করোনা ভাইরাসের নতুন নতুন ধরনের (ভেরিয়েন্ট) বিস্তারের বিরুদ্ধে একটি প্রতিযোগিতার মধ্যে আছি।’
করোনা ডেল্টাভায়োলেন্টের সংক্রমণ রুখতে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরা এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার উপর জোর দিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান ‘তেদ্রস আধানম গেব্রিয়েসুস’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে এ পর্যন্ত পাওয়া করোনার ধরনগুলোর মধ্যে এটাই সবচেয়ে বেশি সংক্রামক। তাই এ মহামারিকে নিয়ন্ত্রণে টিকাদানের পাশাপাশি পূর্বসতর্কতা বজায় রাখা প্রয়োজন।
এ অবস্থায় মানুষ এখন বাধ্য হয়ে গৃহবন্দী। আমরা অনেকেই সংক্রমণের ভয়ে জীবিকার জন্যও ঘর হতে বের হতে চাচ্ছিনা। কিন্তু মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষ আজ জীবনের চেয়ে জীবিকা নিয়েই বেশি ব্যস্ত ও চিন্তিত। কারণ, রোগের কষ্টের চেয়ে ক্ষুধার কষ্ট অনেক অনেক বেশি, যা প্রতি মুহূর্তে তাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। দরিদ্র মানুষের কাছে ক্ষুধার মৃত্যুর চেয়ে করোনায় মৃত্যু অনেক ভালো, কারণ তারা মুসলিম হিসেবে বিশ্বাস করে মহামারিতে মৃত্যু হলে অন্তত শহীদি মর্যাদা পাওয়া যাবে।
অর্থমন্ত্রী আ. হ .ম .মুস্তফা কামাল গবেষকদের কাছে নতুন দরিদ্রদের নাম-ঠিকানা চেয়েছেন। কিন্তু তিনি যদি একবার নিজের নির্বাচনী এলাকারও খোঁজ নিতেন তাহলে সেখানে পুরাতন দরিদ্রদের সাথে, নতুন গরিব হওয়া অসংখ্য শিক্ষিত বেকার মানুষও দেখতে পেতেন যারা শুধু নতুন দরিদ্র নন, অনেকে অর্ধাহারে-অনাহারেও দিন কাটাচ্ছেন।
অনিশ্চিত জীবন অনিশ্চিত গন্তব্যের মধ্য দিয়ে
সামাজিক মর্যাদার কারণে এরা কারও কাছে হাত পাততেও পারছেন না। সমাজে এমন সংখ্যা হুহু করে বাড়ছে। অনেকে এমন যন্ত্রণায় আত্মহত্যার মত, আত্মহননের মত পথও বেছে নিয়েছেন।
এ লকডাউনে কেমন কাটছে সাধারণ মানুষের দিনকাল?
লকডাউনে সাধারণ মানুষ পড়েছ বিপাকে। কর্মহীন হয়ে পড়ছে নানা পেশার মানুষ। মধ্যবিত্তের ঘরে ঘরে আজ নীরব কান্না। গ্রামে যারা কৃষির ওপর নির্ভরশীল, তাদের হয়তো খাওয়া-পরার কাজটা কোনরকম চলে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা কি চিন্তা করে দেখেছি, যারা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের চাকুরে, কর্মচারী, শিক্ষক সমাজ, যারা দিন মুজুরে - দিন আনে দিন খায়, সাধারণ শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক অথবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বা প্রান্তিক মানুষগুলোর দিন কীভাবে কাটছে?
করোনায় তাদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। মহামারিতে বিশ্বের দরিদ্র মানুষের সংখ্যা লাফিয়ে ওঠার পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম)-এক জরিপ অনুযায়ী গত বছরের লকডাউনে দরিদ্রের হার বেড়ে দাঁড়়ায় ৪২ শতাংশ। ইওউঝ এর গত বছরের এক জরিপে দেখা গেছে -এসময় দেশে এক কোটি ৬৪টি লাখ মানুষ নতুন করে গরীব হয়েছে। এবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৪৫ লাখ। ব্র্যাক এবং পিপিআরসি’র এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের ফলে সাধারণ ছুটির ও সামাজিক দূরত্বের কারণে ৭২ শতাংশ মানুষ আজ কাজশূন্য হয়ে পড়েছেন। ৮ শতাংশ মানুষের কাজ থাকলেও বেতন পাননি। কৃষিকাজে সম্পৃক্তদের (৬৫%) তুলনায় অকৃষিখাতের দিনমজুর বেশি (৭৭%) ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অতি দরিদ্র, মাঝারি-দরিদ্র এবং সম্ভাব্য দরিদ্রদের ৭০% আয় কমে গেছে। তাছাড়া শহর এলাকায় ৭১% এবং গ্রাম্য এলাকায় ৫৫% অর্থনৈতিক কার্যক্রম কমে গেছে। জরিপ অনুযায়ী, ১৪ ভাগ মানুষের ঘরে কোনো খাবার নেই। ২৯ শতাংশ মানুষের ঘরে ১ থেকে ৩ দিনের খাবার আছে। ৫১ শতাংশ রিকশাচালক, ৫৮ শতাংশ কারখানা শ্রমিক, ৬২ শতাংশ দিনমজুর, ৬৬ শতাংশ হোটেল/রেস্তোরাঁকর্মীদের চলতি মাসের আয় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। (তথ্য সূত্র: ইন্টারনেট)
খেটে খাওয়া এসব মানুষগুলো ত্রাণ চায় না, কাজ করতে চায়। পরিবারের ভার বহনের অক্ষমতা তাদের যাতনা আরোও বাড়িয়ে তুলেছে। লকডাউন কারো জন্য নিরাপত্তার আর কারো জন্য উপোস থাকা।
মনে রাখতে হবে -রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করা। সরকারকে শুধু উপরতলা নিয়ে ভাবলে হবেনা , অসহায় মানুষগুলোর কথাই আগে ভাবতে হবে।
যাদের কোন পুঁজি নেই, মাস শেষে বেতন নেই, এমনকি ধার কর্য করারও ব্যবস্থা নেই সেই মানুষগুলো কীভাবে, কার উপর ভরসা করে ঘরে বসে থাকবে?
অনেকেই বলেন ঘরে বসে কাজ করা যায়। আসলে দরিদ্র কয়জন মানুষ ঘরে বসে কাজ করতে পারে? যারা দিনমজুর, রিক্সাচালক, পরিবহণ শ্রমিক, হোটেল রেস্টুরেন্টে কাজ করে তারা ঘরে বসে কি কাজ করবে কিভাবে করবে? তাদের কাছে -
ঝঃধু ঐড়সব /ডড়ৎশ ঋৎড়স যড়সব (স্টে অ্যাট হোম/ওয়ার্ক ফ্রম হোম) এই বাক্যগুলো আজ নিতান্ত হাস্যকর ও নিষ্ঠুর প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়!
ত্রাণ দিয়ে এই মানুষের কষ্ট কমানো কতটা সম্ভব হচ্ছে?
এই বিষয়গুলো যখন ঠিক করা যাচ্ছে না, তাই শুধুমাত্র লকডাউন দিয়ে তাদের ঘরে আটকিয়ে রাখা একমাত্র উপায় হতে পারে না! উল্টো লকডাউন ভঙ্গের দায়ে জরিমানা করা যেন ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মত।’
আসলে লকডাউন কোন স্থায়ী সমাধান নয়।
এভাবে মাসের পর মাস সবকিছু বন্ধ থাকলে অনেক বড় ব্যবসায়ীও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে একসময়ে পথে বসতে বাধ্য হবে। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাও তখন কঠিন হয়ে পড়বে। অর্থনীতিবিদরা লকডাউনের সময় দরিদ্রদের খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন। তারা বলেছেন শহরের দরিদ্রদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বাড়াতে হবে। তারা আরোও বলেছেন-সরকারের বর্তমান কর্মসূচি পর্যাপ্ত নয়। দরিদ্র শ্রেণীর জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে কঠোর মনিটরিং এর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সেক্টরে কাজের সুযোগ করে দিতে হবে।
সুস্থ থাকার জন্য -
* জনসচেতনতা বাড়াতে হবে।
* স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
* সবাইকে মাস্ক পরতে হবে।
* সম্ভব হলে টিকা নিতে হবে। যদিও টিকা গ্রহণের পরও অনেককে সংক্রমিত হতে দেখা গেছে।
* জরুরি সেক্টর যেমন : জরুরি খাদ্য সরবরাহ, ব্যাঙ্ক, হসপিটাল, কলকারখানা বা গার্মেন্টস, শ্রমিকদের জন্য প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিবহনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
* অসহায় দিন-মজুরদের জন্য সাহায্যের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
* সরকারিভাবে কমিউনিটি বেজড্ সাহায্য কেন্দ্র চালু করতে হবে।
* মানবিকবোধে উজ্জীবিত হয়ে বিত্তবানদের এগিয়ে আসতে হবে।
* বিশেষভাবে গোপন অভাবীদের খুঁজে খুঁজে সহযোগিতা দিতে হবে।
আর স্মরণ রাখতে হবে করোনা ভাইরাসের বিস্তার সম্পর্কে যত বক্তব্যই থাকুক না কেন মহান আল্লাহ এ প্রসঙ্গে সূরা রুমের ৪১ নাম্বার আয়াতে-
“মানুষের কৃতকর্মের কারণে জলে-স্থলে অন্তরীক্ষে বিপর্যয়-বিশৃংখলা দেখা দিয়েছে এবং এগুলো তাদেরই হাতের উপার্জন, মহান আল্লাহ্ তাদের অশুভ কর্মের কারণে তাদেরকে শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করান, যেন তারা নিজেদেরকে সংশোধন করে আল্লাহ নির্দেশিত পথে ফিরে আসে।”
কাজেই করোনা ভাইরাস থেকে মুক্তি পেতে হলে সবাইকে আল্লাহর দিকে ফিরে আসতে হবে। তাহলেই মহান আল্লাহ্ তা আমাদের থেকে ফিরিয়ে নেবেন।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়-এই মহামারি তেমন কোন পরিবর্তন আনতে পারেনি আমাদের মানসিকতায়। কাছের মানুষদের এত মৃত্যু দেখেও স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রীকতা যেন আমাদের পিছু ছাড়ছেনা। মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করছি, এই লকডাউনে বন্ধ দরজায় থেকেও অন্তত বিবেকের জানালাটা যেন আমরা খুলে রাখি। বিবেক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হই। কারণ আমরা জানি- পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আদালত হলো মানুষের বিবেক। এই বিবেকবোধ ও মহান রবের কাছে জবাবদিহিতার অনুভূতিই হয়তো আদালতে আখিরাতে আমাদের উৎরে যেতে সাহায্য করবে। মহান রব আমাদের আরো অনেক বেশি মানবিক হওয়ার তৌফিক দান করুন ও মহামারির এ কঠিন অবস্থা থেকে হেফাজত করুন।

https://dailysangram.com/post/457944