৭ জুলাই ২০২১, বুধবার, ৭:১৭

করোনা উপসর্গে মৃত্যু আড়ালেই থাকছে

২৬ জুন পর্যন্ত উপসর্গে মারা গেছে ২ হাজার ৪৫৩ জন

করোনা শনাক্ত হয়ে দেশে প্রতিদিন যতসংখ্যক মানুষের মৃত্যু সরকারি হিসাবের তালিকায় উঠছে, সেই সংখ্যা ছাড়াও আরো অনেকেই মারা যাচ্ছে উপসর্গ নিয়ে। গবেষণাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, উপসর্গে মারা যাওয়ার সংখ্যাটাও বড়। সেটা সরকারি হিসাবে মৃত্যুর অর্ধেকের কাছাকাছি হতে পারে। শুধু এবারই নয়, এর আগে আরো দুই দফা দেশে যখন উচ্চমাত্রার সংক্রমণ হয়েছিল, তখনো উপসর্গে মৃত্যুর হিসাবটা এমনটাই ছিল বলে জানান করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়ার তথ্য পর্যবেক্ষণকারী একাধিক গবেষক।

পর্যবেক্ষক গ্রুপ তাদের তথ্যে জানিয়েছে, ৯-২২ জুন এই ১৩ দিনে শুধু খুলনা ও রাজশাহীতে করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছে ১৫০ রোগী। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ তাদের তথ্যে জানিয়েছে, গত ২৬ জুন পর্যন্ত দেশে শুধু উপসর্গ নিয়েই মারা গেছে দুই হাজার ৪৫৩ জন।

দ্য আমেরিকান জার্নাল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিনে প্রকাশিত ‘অফিশিয়ালি কনফার্মড কভিড-১৯ অ্যান্ড আনরিপোর্টেড কভিড-১৯ লাইক ইলনেস ডেথ : অ্যান অ্যাসেসমেন্ট অব রিপোর্টিং ডিসক্রিপেন্সি ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে গেল বছরের ৫ মে থেকে ২২ আগস্ট পর্যন্ত শনাক্ত হওয়া রোগীদের মধ্যে মৃত (সরকার ঘোষিত) ও উপসর্গ নিয়ে (সরকার অঘোষিত) মৃত্যুর তথ্য পর্যালোচনা করা হয়। এতে দেশি-বিদেশি গবেষকরা দেখেছেন, গত বছরের মার্চের প্রথম সপ্তাহে দেশে করোনা শনাক্ত শুরু হওয়ার পর থেকে ২ মে পর্যন্ত শনাক্ত হওয়া মৃত্যুর সঙ্গে উপসর্গে মৃত্যু ছিল আরো ৩১ শতাংশ। তবে ৩ মে থেকে ২২ আগস্ট পর্যন্ত ওই হার বেড়ে উঠে যায় ৪৯ শতাংশে। কানাডার ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় ও সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের চার সদস্যের গবেষকদল এই পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণা পরিচালনা করে। গবেষণার সময়কালে সরকারি হিসাবে গড়ে প্রতি সপ্তাহে যেখানে ১৫৬ জনের মৃত্যু হয়েছে, সেখানে উপসর্গে মৃত্যু ছিল আরো ৮৬ জনের।

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে (২৬ জুন পর্যন্ত) দেখা যায়, দেশে করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছে মোট দুই হাজার ৪৫৩ জন। এর মধ্যে এক হাজার ৯৯৪ জন পুরুষ এবং ৪৫৯ জন নারী। এ ক্ষেত্রে ওই দিন পর্যন্ত উপসর্গ নিয়ে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ছিল চট্টগ্রাম বিভাগে ৭৪২ জন, খুলনা বিভাগে ৪৪৬ জন, ঢাকা বিভাগে ৩৯৬, রাজশাহী বিভাগে ৩৬৪ জন, বরিশাল বিভাগে ২৪৪ জন, সিলেটে ১০২ জন, রংপুরে ৯৫ জন ও ময়মনসিংহে ৬৪ জন। এর মধ্যে জেলা হিসেবে সবচেয়ে বেশি উপসর্গ নিয়ে ওই দিন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে কুমিল্লায়, সংখ্যাটা ২৫২। তবে শুধু রাজশাহী ও খুলনা জেলায় গত ৯ থেকে ২২ জুন পর্যন্ত উপসর্গ নিয়ে ১৫০ জনের মৃত্যুর হয়েছে বলে সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের তথ্যে জানা যায়।

গেল কয়েক দিনে দেশে করোনা সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায় প্রতিদিনই শনাক্ত হওয়া মৃত্যুর সঙ্গে বাড়ছে উপসর্গে মৃত্যুও। কোনো কোনো এলাকায় শনাক্ত মৃত্যুর পাশাপাশি উপসর্গে মৃত্যুর তথ্যও মিলছে; যারা সবাই ওই হাসপাতালগুলোর করোনা ডেডিকেটেড ইউনিটে ভর্তি থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছিল।

তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘যারা বিভিন্ন হাসপাতালে উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হচ্ছে, সবারই করোনা পরীক্ষা করা হয়। এমনকি কারো কারো করোনা নেগেটিভ এলেও এক্স-রে, সিটি স্ক্যান বা রক্তের পরীক্ষা করে সে অনুসারে চিকিৎসা দেওয়া হয়। ফলে করোনা উপসর্গ যদি থাকে, তাহলে কোনো না কোনো পর্যায়ে তা শনাক্ত হয়েই যায়। তারা শনাক্ত হওয়া হিসাবের মধ্যেই থাকে। আর যাদের সব ধরনের পরীক্ষাতেই করোনা নেই বলে দেখা যায়, তাদের করোনায় মৃত্যুর হিসাবে দেখানো যায় না।’

এদিকে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এএসএম আলমগীর বলেন, ‘অনেক সময় হয়তো রোগীকে খুবই জটিল অবস্থায় হাসপাতালে আনার পরপরই উসর্গ দেখে চিকিৎসা শুরু করা যায় প্রটোকল অনুসারে। অন্যদিকে রোগীর নমুনা নিয়ে করোনা পরীক্ষার জন্য তা ল্যাবে পাঠানো হয়। ফল আসার আগেই হয়তো রোগীর মৃত্যু ঘটে। তখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সেটাকে উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু হয়েছে বলে তাত্ক্ষণিক প্রতিবেদন দেয় এবং গণমাধ্যমকেও কেউ কেউ ওই তথ্য জানায়। যখন আবার একই রোগীর ফল চলে আসে, তখন সেটি ওই হাসপাতালের শনাক্ত হওয়া হিসাবে মৃত রোগীর তালিকায় ঢুকে যায়। আর যদি নেগেটিভ ফল আসে তখন সেটি নেগেটিভ তালিকাতেই থাকে।’

ড. আলমগীর আরো বলেন, ‘সমস্যা হচ্ছে, আগের দিন যখন ওই রোগীকে উপসর্গধারী হিসেবে দেখানো হয়ে যায়, সেই তথ্য ততক্ষণে মিডিয়ায় চলে আসে, অনেকের হিসাবে তা যুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের হিসাবে ঠিকই মৃত ওই রোগীর ফল যদি পজিটিভ আসে পরদিন তা শনাক্ত হওয়া মৃত্যুর তালিকায় ওঠানো হয়, আর নেগেটিভ হলে সেই হিসাব পাঠানোর প্রয়োজন হয় না। ফলে সরকারি তথ্য থেকে কোনো শনাক্ত হওয়া মৃত করোনা রোগীর তথ্য বাদ যাওয়ার সুযোগ নেই। উল্টো উপসর্গ হিসেবে যাদের মৃত্যু দেখানো হচ্ছে, তাদের মধ্যে অনেকের হিসাব ডাবল হয়ে যায়, যা এক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি করে।’

গেল ২৪ ঘণ্টায় বগুড়ায় করোনা শনাক্ত হয়ে মারা গেছে আটজন। উপসর্গে মৃত্যু হয়েছে ১১ জনের।

বগুড়ার ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, যে ১১ জন উপসর্গ নিয়ে মারা গেছে তাদের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে ফল এখনো পাওয়া যায়নি। ফলে মৃত্যুর হিসাবে তাদের নাম যুক্ত হয়নি।

মাগুরা হাসপাতালে আইসোলেন ওয়ার্ডের সেবিকা সালমা পারভীন জানান, প্রতিদিন এ ওয়ার্ডে গড়ে এক থেকে দুজন রোগী করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাচ্ছে।

[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা।]

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2021/07/07/1050828