৭ জুলাই ২০২১, বুধবার, ৭:১৫

৩০ জেলায় অক্সিজেন সংকটের শঙ্কা

দেশে করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। দৈনিক শনাক্ত সাড়ে ১১ হাজার ছাড়িয়েছে। দিনে প্রায় ৩ জনে ১ জন শনাক্ত হচ্ছেন। তৃতীয় ঢেউয়ের কারণে করোনা পরিস্থিতির বেশ অবনতি ঘটেছে। এখনই অক্সিজেন ও আইসিইউ’র জন্য হাহাকার দেখা দিয়েছে হাসপাতালগুলোতে। যেকোনো সময় অক্সিজেনের ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি হতে পারে। একইসঙ্গে হাসপাতালগুলোতে বেড়েছে অক্সিজেনের ব্যাপক চাহিদা। করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির উন্নতি না ঘটলে দেশ ভয়াবহ অক্সিজেন সংকটের মুখে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশের অর্ধেকের বেশি জেলায় নেই আইসিইউ সাপোর্ট। ৩০ জেলায় নেই সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম।

এদিকে, করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়ায় বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে স্বাভাবিকের চেয়ে এখন বেশি অক্সিজেনের প্রয়োজন হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে অক্সিজেনের কোনো সংকট নেই। সামনে যাতে সংকট তৈরি না হয় সেজন্য ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
২৯ থেকে ৩০টি জেলায় এই মুহূর্তে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম নেই। এর মধ্যে পঞ্চগড় জেলা একটি। এই জেলায় বর্তমানে কীভাবে করোনা রোগীদের অক্সিজেন সাপোর্ট দেয়া হচ্ছে জানতে চাইলে জেলার সিভিল সার্জন ডা. মো. ফজলুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, করোনা রোগী অনেক বেড়ে গেছে। অক্সিজেনের চাহিদাও দ্বিগুণ হয়েছে। তার জেলায় সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম নেই। সিলিন্ডার দিয়ে করোনা রোগীদের অক্সিজেন সরবরাহ করতে হচ্ছে। জেলা সদরে ১২৪টি সহ জেলায় মোট সরকারি অক্সিজেন ২৪৮টি সিলিন্ডার রয়েছে। এগুলো দিয়ে রোগীকে সেবা দেয়া হচ্ছে। এখনো সমস্যা হচ্ছে না। তবে রোগী আরও বেড়ে গেলে অক্সিজেনের চাহিদাও বাড়বে। সেক্ষেত্রে করোনা রোগীদের অক্সিজেন সরবরাহ করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। উদাহরণ দিয়ে সিভিল সার্জন আরও জানান, ৬০টি সিলিন্ডার শেষ হলে এগুলো রংপুর থেকে আবার রিফিল করে আনতে হয়। এতে সপ্তাহখানেক সময় লাগে। তবে সব সময় সিলিন্ডার মজুত রাখার চেষ্টা করছেন তারা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দেশে বর্তমানে অক্সিজেনের চাহিদা ১৯০ থেকে ২০০ টন। এর মধ্যে লিন্ডে বাংলাদেশ ও স্পেক্ট্রা সরবরাহ করছে যথাক্রমে ৮০ এবং ৩৮ টন। এই দুটি প্রতিষ্ঠান নিজস্ব প্ল্যান্টে অক্সিজেন উৎপাদন করে। পাশাপাশি তারা ভারত থেকেও আমদানি করে থাকে। অক্সিজেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সূত্র বলছে, এপ্রিলে ভারত থেকে আমদানি বন্ধ থাকলেও এখন সেটা বন্ধ নেই। পাশাপাশি দেশি তিনটি প্রতিষ্ঠানের আবুল খায়ের স্টিল মেল্টিং লিমিটেড দৈনিক ৭ টন, ইসলাম অক্সিজেন ২০ টন এবং এ কে অক্সিজেন লি. ৮ টন সরবরাহ করার সক্ষমতা রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোভিড পরিস্থিতির আগে দেশে দৈনিক ১০০ টন মেডিকেল গ্রেড অক্সিজেনের চাহিদা ছিল। কোভিড রোগীদের সংখ্যা বাড়ায় হাইফ্লো জাল ক্যানুলা, ভেন্টিলেটর ও আইসিইউর চাহিদা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় অক্সিজেনের চাহিদা বাড়ছে।
দেশে অক্সিজেন সংকট প্রসঙ্গে জাতীয় পরামর্শক কমিটির অন্যতম সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, বিনা অক্সিজেনে দেশে বহু লোক মারা যাচ্ছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে অক্সিজেনের সংকট নেই। তাহলে তাদের কাছে অক্সিজেনের সংকটের সংজ্ঞা কি? এই জনস্বাস্থ্যবিদ বলেন, বহু আগেই বলেছিলাম অক্সিজেন বৃদ্ধি করতে। কিন্তু মন্ত্রী বলেছেন অক্সিজেন নিয়ে চিন্তা করবেন না। তিনি প্রশ্ন করে বলেন, দেড় বছর পরে এসেও অক্সিজেনের এই অবস্থান কেন? আইসিইউ’র জন্য হাহাকার দেখছি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা সত্ত্বেও সব জেলায় আইসিইউ’র ব্যবস্থার উন্নতি হলো না কেন? সব জেলায় সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম স্থাপন হলো না। নিয়মিত নির্দেশনা পালন করা প্রয়োজনবোধ করছে না সংশ্লিষ্টরা। এর থেকে বুঝা যায় কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন মানবজমিনকে বলেন, দেশে ৩৪ থেকে ৩৫টি জেলায় সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থা আছে। বর্তমানে অক্সিজেনের কোনো ঘাটতি নেই। তবে রোগী দ্বিগুণ হলে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। এই মুহূর্তে অক্সিজেনের চাহিদা ১৯০ থেকে ২০০ টন। সক্ষমতা আছে ২৫০ টনের।

অক্সিজেন সরবরাহকারী বড় প্রতিষ্ঠান লিন্ডে বাংলাদেশের মানবসম্পদ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) এবং প্রতিষ্ঠানটির মুখপাত্র সায়কা মাজেদ মানবজমিনকে বলেন, আমাদের নিজস্ব উৎপাদন রয়েছে। এই মুহূর্তে আমরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল বন্ধ রেখেছি। ৯০ টন উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। গড়ে প্রায় প্রতিদিনই এই পরিমাণ উৎপাদন হচ্ছে। যা পুরোটাই হাসপাতালে দিচ্ছি। আমরা এভাবে চালাতে পারবো যদি রোগীর সংখ্যা না বাড়ে। তবে অক্সিজেনের চাহিদা বাড়ছে। আর পরিস্থিতি খারাপ হলে সীমিত জিনিস দিয়ে মোকাবিলা করা চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়াবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশে কোভিড চিকিৎসা দেয় (সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে) এমন হাসপাতালগুলোয় ১ হাজার ৫৮৬টি হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা রয়েছে। শুধু এই হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলাগুলোর মাধ্যমে প্রতিদিন মুমূর্ষু রোগীদের জন্য ৬৪ মিলিয়ন লিটার অক্সিজেন সরবরাহ করতে হয়। এ ছাড়া আইসিইউতে (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট-নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) চিকিৎসাধীন রোগীদের অক্সিজেন সাপোর্টে রাখতে হয়। পাশাপাশি সাধারণ শয্যায় চিকিৎসাধীন অনেক রোগীরও অক্সিজেনের প্রয়োজন পড়ে। এর পাশাপাশি সারা দেশে সাধারণ হাসপাতালে ( যেগুলোয় নন- কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হয়) প্রতিদিন কয়েক হাজার রোগীর অস্ত্রোপচার হয়ে থাকে। তাদেরও অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। এমনকি দেশে করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে অবস্থাপন্ন অনেক ব্যক্তি ও পরিবার বাসাবাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখতে শুরু করেছেন। সারা দেশে অক্সিজেন সিলিন্ডারের সংখ্যা ২৮ হাজার ৩৪৪টি এবং অক্সিজেন কনসেনট্রেটর ১ হাজার ৭২৭টি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কোভিড-১৯ রোগীদের ১৫ থেকে ২০ শতাংশকে হাসপাতালে ভর্তি করার এবং অক্সিজেন সহায়তা দেয়ার প্রয়োজন হয়। প্রায় ১৫ শতাংশ রোগীর মধ্যে গুরুতর লক্ষণ দেখা যায় এবং ৫ শতাংশের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের প্রয়োজন হয়।

https://mzamin.com/article.php?mzamin=282403&cat=2