৭ জুলাই ২০২১, বুধবার, ৭:১২

মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে ১৬ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা

কক্সবাজারের মাতারবাড়ী ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করা হয় ২০১৪ সালের আগস্টে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিকল্পনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন আনুষঙ্গিক বিষয়ে ভুলের কারণে বেড়ে গেছে প্রকল্প ব্যয়। প্রায় ১৬ হাজার ৪০৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এতে করে বেড়ে যাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়। ধারণা করা হচ্ছে প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা বাড়ায় ক্যাপাসিটি চার্জ প্রায় দেড়গুণ হয়ে যাবে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ইউনিটপ্রতি প্রায় দুই টাকা বেড়ে যাবে। এর দায় সরাসরি জনগণকে বহন করতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা খালাসে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ পরিকল্পনায় ছিল ত্রুটি। আবার বিদ্যুৎ বিতরণ উপকেন্দ্রের সক্ষমতাও ছিল কম। এগুলো সংশোধন করতে হয়েছে। পাশাপাশি জমি অধিগ্রহণের পরিমাণও বাড়ছে। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণব্যয় বেড়ে যাচ্ছে ৪৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
তথ্যমতে, প্রাথমিকভাবে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) ঋণ দেয়ার কথা ছিল ২৮ হাজার ৯৬৯ কোটি চার লাখ টাকা। বাকি অর্থ সরকারি তহবিল ও সংস্থাটির নিজস্ব অর্থায়ন থেকে দেয়ার কথা ছিল। তবে পরিকল্পনা সংশোধনের ফলে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৫২ হাজার ৩৮৮ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে ১৬ হাজার ৪০৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা।
সংশোধিত প্রকল্পের আওতায় ৪২ হাজার ৪৯ কোটি ৭৩ লাখ টাকা দেবে জাইকা। আর আট হাজার ৫৪৯ কোটি ৪১ লাখ টাকা সরকারি তহবিল ও সংস্থাটির নিজস্ব অর্থায়ন থেকে দেয়া হবে। বাকি দুই হাজার ৩৭৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা দেবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি প্রকল্পটির সংশোধিত প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। এটি যাচাই-বাছাই করে ব্যয় বৃদ্ধির বিভিন্ন খাতভিত্তিক বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে।
এতে বলা হয়েছে, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প প্রস্তাবে কয়লা খালাসে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ, ১৫ মিটার গভীর ও ২৫০ মিটার প্রস্থ চ্যানেল নির্মাণের প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে কয়লাবাহী জাহাজ জেটিতে ভিড়তে তা অপ্রতুল। এজন্য ১৪ দশমিক তিন কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেল নির্মাণ করতে হবে। পাশাপাশি চ্যানেলের গভীরতা ও প্রশস্ততা হবে যথাক্রমে ১৮ দশমিক পাঁচ মিটার ও ৩৫০ মিটার। ফলে ঠিকাদার ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ ব্যয় বেড়ে গেছে।
এ চ্যানেল প্রস্তুত করতে গিয়ে ব্যয় বাড়ছে ১৪ হাজার ৩২৬ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। আর বিদ্যুৎকেন্দ্রের বয়লার, টারবাইন ও জেনারেটর খাতে ব্যয় বাড়ছে এক হাজার ৪০৭ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এছাড়া পল্লী বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইনের সক্ষমতা ধরা হয়েছিল অনেক কম। এ সক্ষমতা পরে বাড়ানো হয়েছে। ফলে এ খাতে ব্যয় বাড়ছে ৩৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকা।
এদিকে ২০১৬ সালের গুলশান হামলার পর দরপত্র জমা দেয়া দীর্ঘায়িত হয়। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওয়ারেন্টি ১২ থেকে বাড়িয়ে ২৪ মাস করা হয়। পাশাপাশি পরামর্শক খাতের আওতাও বেড়েছে। এতে পরামর্শক ব্যয় বেড়েছে ৩২৭ কোটি ৮২ লাখ টাকা।
এর বাইরে পরামর্শকের ভ্যাট ও অগ্রিম কর ধরা হয়েছিল যথাক্রমে ১৫ ও সাড়ে ১০ শতাংশ। এক্ষেত্রে ভ্যাটের হার একই থাকলেও অগ্রিম কর বাড়িয়ে ১২ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া যন্ত্রপাতির আমদানি শুল্ক ও ভ্যাট খাতে সাড়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এ খাতে ব্যয় বেড়েছে দুই হাজার ১৬৬ কোটি আট লাখ টাকা।
এদিকে প্রকল্প এলাকায় টাউনশিপ নির্মাণে ১৭ হেক্টর জমি আট মিটার উঁচু করার কথা ছিল। তবে তা বাড়াতে হয়েছে। বর্তমানে ২৭ হেক্টর জমি ১০ মিটার উঁচু করে টাউনশিপ করা হচ্ছে। এতে ভূমি উন্নয়ন খাতে ব্যয় বেড়েছে ১২৯ কোটি ৮৭ লাখ টাকা।
প্রকল্পটির আওতায় জমি অধিগ্রহণের পরিমাণ ধরা হয়েছিল এক হাজার ৫০০ একর। পরে তা বাড়িয়ে এক হাজার ৬০৮ একর করা হয়েছে। তবে এ খাতে ব্যয় বাড়েনি। যদিও পুনর্বাসন খাতে ২১৬ কোটি ৫৮ লাখ টাকা ব্যয় বেড়ে গেছে। আর স্থানীয় পরিবহন, বিমা ও অন্যান্য খাতে ১০৬ কোটি টাকা ব্যয় বেড়েছে।
বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যয় দুই খাতে হ্রাসও পেয়েছে। এর মধ্যে নির্মাণকালীন সুদ বাবদ ব্যয় ৫৮৮ কোটি ১৭ লাখ টাকা কমেছে। আর কন্টিনজেন্সি খাতে ব্যয় কমেছে এক হাজার ৭২৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকা।
এদিকে প্রকল্পটির মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। তবে বাস্তবায়নে ধীরগতি ও কাজের পরিধি বৃদ্ধির ফলে এ মেয়াদ আড়াই বছর বাড়ানো হচ্ছে। এতে প্রকল্পটির মেয়াদ গিয়ে ঠেকবে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।
মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, মাতারবাড়ীর বন্দরের জন্য চ্যালেন উন্নয়ন কার্যক্রম এ প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। এজন্য ব্যয় বাড়ছে বড় অংশের। পাশাপাশি বিনিময় হার পরিবর্তন এবং অন্যান্য খাতে ঠিকাদার ও পরামর্শক বাবদ ব্যয় বেড়েছে। এজন্য প্রকল্পটির সংশোধিত প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হয়েছে। আর বর্ধিত কাজের জন্য অতিরিক্ত সময় প্রয়োজন হবে। এজন্য ২০২৬ সাল পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের ব্যয় বৃদ্ধি প্রকল্পটির বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে দেবে। ক্যাবের জ্বালানি-বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম এ প্রসঙ্গে বলেন, বন্দরের জন্য চ্যানেলের নাব্য বাড়াতে অতিরিক্ত দুই হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ছে। তবে বাকি প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা ভুল পরিকল্পনা ও প্রকল্প বিলম্ব হওয়ার কারণেই বাড়ছে বলে মনে হচ্ছে। যদিও এ ব্যয় বৃদ্ধির ফলে প্রকল্পটি অর্থনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়বে।
তিনি বলেন, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ পূর্বনির্ধারিত ছিল না। এক্ষেত্রে বলা হয়েছিল, নির্মাণকাজ সম্পন্ন হলে সে অনুপাতে ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণ করা হবে। এখন ব্যয় প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা বাড়ায় ক্যপাসিটি চার্জ প্রায় দেড়গুণ হয়ে যাবে। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ইউনিটপ্রতি প্রায় দুই টাকা বেড়ে যাবে। এর দায় সরাসরি জনগণকে বহন করতে হবে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

https://dailysangram.com/post/457821