৬ জুলাই ২০২১, মঙ্গলবার, ৭:০৭

দু’দশকে দেড় হাজার কোটি টাকা গড়াই নদী ড্রেজিংয়ে

৭২ শতাংশ সময়ে ড্রেজিং ২৭ শতাংশ ; কাজের অগ্রগতি আশানুরূপ নয় : আইএমইডি

উন্নয়ন প্রকল্পে পরামর্শক, ট্রেনিং, বিদেশ সফর আর নদী ড্রেজিংয়ে যাচ্ছে বিশাল অঙ্কের অর্থ। নদী ড্রেজিং হচ্ছে, পলি পড়ে আবার ভরাটও হচ্ছে। ফলে অর্থ যাচ্ছে পানিতে। গত দু’দশকে গড়াই নদীতে ঢালা হয়েছে এক হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা। বলতে গেলে ১০ বছর ড্রেজিংয়ে ওই অর্থ খরচ হয়েছে। বছরে প্রায় দেড় শ’ কোটি টাকা। আর চলমান প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে স্থানীয় জনসাধারণ এবং পরিকল্পনা কমিশনের আইএমইডি হতাশা প্রকাশ করেছে। আউটসোর্সিং ড্রেজার দিয়ে ড্রেজিং করা হলেও খরচ পড়ছে প্রতি লাখ ঘনমিটারে এক কোটি ৮০ লাখ টাকা; যেখানে পাউবোর ড্রেজারে ৬২ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। আইএমইডি বলছে, যেভাবে চলছে তাতে ২০২২ সালের জুনে এই কাজ কোনোভাবেই সমাপ্ত হবে না।
প্রকল্পের প্রেক্ষাপট ও অগ্রগতি পর্যালোচনায় আইএমইডির তথ্য থেকে জানা গেছে, পরিবেশগত দিক থেকে পদ্মার প্রধান শাখা নদী গড়াই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুষ্ক মৌসুমে পদ্মার পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় গড়াই নদীর মুখে বিশাল বালুরাশি জমে যায়। বর্ষাকালে গড়াইয়ের উৎসমুখে এবং উৎসমুখ থেকে ভাটিতে ৪৪ কিলোমিটার অংশে অধিক হারে পলি পড়ে। ফলে নদীটি একেবারে মরা খালে পরিণত হয়। নদীটির সমস্যা সমাধানে ১৯৯৮ সাল থেকে ড্রেজিং কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। এখনো একটি প্রকল্প চলমান আছে। গড়াই নদী পুনরুদ্ধারে ১৯৯৮ সালের নভেম্বরে একনেকে দুই বছর মেয়াদে ২২৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়। তার মাধ্যমে ড্রেজিং সম্পন্ন হয়।
১৯৯৮-৯৯ সালে অফটেক হতে ১৯.৫৫ কিলোমিটার পর্যন্ত অংশে ৭৭ লাখ ঘনমিটার এবং ১৯৯৯-২০০০ সালে একই অংশে ১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যে সাড়ে ৪০ লাখ ঘনমিটার অর্থাৎ দু’বছরে ১১৭ লাখ ৫০ হাজার ঘনমিটার পলি অপসারণ করা হয়। ২০০০-২০০১ সালে রক্ষণাবেক্ষণ ড্রেজিংয়ের আওতায় ৪২ লাখ ঘনমিটার পলি অপসারণ করা হয়। কিন্তু ২০০১ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত, দীর্ঘ ৯ বছর এই নদীতে কোনো ড্রেজিং হয়নি। অবস্থার অবনতি হলে ৬৪৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা ব্যয়ে পাঁচ বছর মেয়াদে গড়াই নদী পুনরুদ্ধার (দ্বিতীয় পর্যায়) প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পের মেয়াদ ২০০৯ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত। নদীর অফটেক থেকে ভাটির দিকে ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত অংশে ২০৫ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিং করা হয়। কিন্তু প্রকল্পের অব্যবস্থাপনা ও উৎসমুখে পলি ভরনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় গড়াই নদীতে আবার ডেজিংয়ের আবশ্যকতা দেখা দেয়।
ফলে ২০১৮ সালের ২৩ অক্টোবর গড়াই নদী ড্রেজিং ও তীর সংরক্ষণ শীর্ষক একটি প্রকল্পটি অনুমোদন দেয় একনেক। ২০২২ সালের জুনে সমাপ্ত করার পরিকল্পনায় প্রকল্পের অনুমোদিত ব্যয় ছিল ৫৯১ কোটি ৫৮ লাখ ৮ হাজার টাকা। কিন্তু পরে নদীর মরফোলজিক্যাল পরিবর্তনের কারণে গঠিত কারিগরি কমিটির সুপারিশে কিছু অঙ্গ সংযোজন ও নকশার সংশোধনজনিত কারণে ২০২০ সালের ২০ আগস্ট সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) অনুমোদন দেয়া হয়। তাতে ৬.১৬ শতাংশ খরচ বাড়িয়ে বাস্তবায়ন ব্যয় ধরা হয় ৬২৯ কোটি ৪৩ লাখ ৩১ হাজার টাকা।
প্রকল্পের আওতায় ড্রেজিংয়ে প্রাক্কলিত মাটির ৪০ শতাংশ বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিজস্ব ড্রেজার দ্বারা এবং ৬০ শতাংশ আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োজিত ঠিকাদার দ্বারা ড্রেজিং কার্যক্রম বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নেয়া হয়। কিন্তু আরডিপিপি অনুযায়ী মূল ডিপিপির আউটসোর্সিং ড্রেজিং ব্যয়ের এক-তৃতীয়াংশ ব্যয়ে বাপাউবোর নিজস্ব ড্রেজার দ্বারা ড্রেজিং কাজ করা হচ্ছে। চলতি ২০২১ সালের মে পর্যন্ত ড্রেজিংসহ প্রকল্প কাজের অগ্রগতি ২৭ দশমিক ৩০ শতাংশ। অন্য দিকে প্রকল্পের মেয়াদ ৭২ শতাংশ অতিক্রম হয়েছে। আর টাকা খরচ করা হয়েছে প্রায় ১৮ শতাংশ বা ১১২ কোটি ৯১ লাখ ৪ হাজার টাকা।
পর্যালোচনা প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, প্রকল্পের প্রধান কাজগুলোর মধ্যে পাউবোর নিজস্ব ড্রেজার দ্বারা গড়াই নদীর ড্রেজিং হয়েছে ৪২৩.৯৮ লাখ ঘনমিটার বা ২৯.৪৫ শতাংশ। আর আউটসোর্সিং দ্বারা কাজই শুরু করা হয়নি। মেয়াদ আছে এক বছর এক মাস। মালামাল সংরক্ষণের জন্য ২০ কিলোমিটার প্রতিরক্ষা কাজ এবং আউটলেট নির্মাণের অগ্রগতি ৬ শতাংশ। ৭.৩৩ কিলোমিটার নদীর তীর সংরক্ষণের অগ্রগতি ৪৮ শতাংশ। ১.১৪ কিলোমিটার নদীর তীর সংরক্ষণ কাজ পুনর্বাসনের অগ্রগতি আড়াই বছরে ২ শতাংশ। গ্রোয়েন মেরামতের অগ্রগতি ২৫ শতাংশ। ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২১ সালের মে পর্যন্ত আড়াই বছরে ড্রেজিং হয়েছে ১৬৭.৭৯ লাখ ঘন মিটার, যা জুন পর্যন্ত ৩৭.৪১ শতাংশ।
এদিকে প্রকল্পের ২২টি প্যাকেজে পূর্তকাজের মধ্যে ১৪টি প্যাকেজের কাজ চলমান আছে। চলমান প্যাকেজের মধ্যে ছয়টির কাজ ৫০ শতাংশের বেশি হয়েছে। পণ্য কেনার তিনটি প্যাকেজের কাজ সমাপ্ত হয়েছে। আউটসোর্সিং ড্রেজার দ্বারা ড্রেজিং প্যাকেজগুলোর দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। আউটসোর্সিং দিয়ে প্রতি লাখ ঘনমিটার ড্রেজিং খরচ পাউবোর ড্রেজার থেকে দ্বিগুণেরও বেশি। নদীর তীর সংরক্ষণ কাজ প্রতি কিলোমিটারে সাড়ে ২৮ কোটি টাকার বেশি।
প্রকল্পের দুর্বলতার মধ্যে রয়েছে, ক্যাপিটাল ড্রেজিং কাজ ধীরগতিতে চলমান। বিপুল পরিমাণ ড্রেজিং ম্যাটারিয়াল সংরক্ষণের জন্য জায়গার সংস্থান না রাখা। এই কাজে ভূমি অধিগ্রহণ না করা। প্রকল্প বাস্তবায়নের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো কুষ্টিয়া শহরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত গড়াই নদী অংশের ড্রেজড বালি বা মাটি রাখার জায়গা না থাকা। ড্রেজার পরিচালনায় জনবলের অভাবে ড্রেজিং কাজ মন্থর। বিস্তারিত ফিজিবিলিটি স্টাডি না হওয়া।
প্রকল্প পরিচালক বলছেন, নদীতে প্রতি বছর ড্রেজিং অব্যাহত রাখতে হলে বছরে ২৫ কোটি টাকা করে বরাদ্দ রাখতে হবে। বর্তমানে নিয়োজিত সাতটি ড্রেজারে সেটআপ অনুযায়ী পদের সংখ্যা ১০৯ জন। কিন্তু কর্মরত আছে ৪৬ জন। এছাড়া নিচের পদের লোকবলকে উপরের পদের অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে ড্রেজিং করা হচ্ছে। প্রতি ড্রেজারে ১৭ জন লোকবল থাকার কথা। বর্তমানে কাজ করছে গড়ে ৭-৮ জন।
আইএমইডির পরিদর্শক টিমের অভিমত হলো, প্রকল্পের অধীনে ড্রেজিংকৃত স্পয়েল রাখার জন্য কোনো অধিগ্রহণকৃত জমি নেই। তাই স্পয়েলসমূহ নদীর দু’পাড়ে খাস জমিতে রাখা হয়, যা আবার নদীতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। ড্রেজড ম্যাটারিয়াল সঠিকভাবে সম্পাদন করা না গেলে গড়াই নদী রক্ষণাবেক্ষণে ড্রেজিংয়ের উদ্দেশ্য ব্যাহত হতে পারে। ইতোমধ্যে কুষ্টিয়া সদরের ১২ কিলোমিটার এলাকার নদীর দু’পাশে ড্রেজড পলি বা মাটি রাখার স্থানগুলো ধারণ ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে।
আইএমইডির সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তীর কাছে এই বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আমাদের ফাইন্ডিংসগুলো আমরা সুপারিশসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে পাঠাব। ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব হলো মন্ত্রণালয় বা বিভাগের। তিনি বলেন, প্রকল্পগুলো মনিটরিং সঠিকভাবে করা হলে অনেক দুর্বলতাই নিরসন সম্ভব। প্রকল্পগুলো থেকে মানুষ সুফল ভোগ করবে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/593038/