৬ জুলাই ২০২১, মঙ্গলবার, ৭:০৬

মগবাজার বিস্ফোরণের রহস্য জানা গেলনা নয় দিনেও ॥ বাতাসে গুমট গন্ধ কিসের?

রাজধানীর মগবাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণের রহস্য জানা গেলনা নয় দিনেও। ঘটনার পর থেকেই বিস্ফোরিত ভবনের ভেতর থেকে পচা গুমট গন্ধ বের হচ্ছে। দিন যতই যাচ্ছে, গন্ধ চারপাশে ছড়াচ্ছে। এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি তাদের কাজ চালিয়ে যাাচ্ছেন। বিস্ফোরণ ঘটা ‘রাখি নীড়’ নামে সেই ভবনটি এখনো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ব্যস্ততম সড়কের পাশে কিছুটা হেলেপড়া অবস্থায় আছে। পাশের আরও একটি ভবন হেলে পড়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরাও এখনো বিস্ফোরণের কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেনি। ঘটনা তদন্তে আরও সময় বাড়তে পারে বলে জানা গেছে।
গতকাল সোমবার ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে- লকডাউনের কারণে আশেপাশের প্রায় দোকান ও সব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানই বন্ধ। ৮৩ নম্বর আউটার সার্কুলার রোডে আমেনা ফার্মেসির মালিক দোকান খুলে বসে আছেন। তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন-‘এতবড় বিস্ফোরণের বিষয়টি মাথায় ঘুরছে না। ঘটনার সময় আমি দোকানেই ছিলাম, বিকট বিস্ফোরণে প্রথমে বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মার বিস্ফোরণ মনে করেছিলাম। পরে দেখলাম ভূমিকম্পের মতোই সমস্ত মগবাজার এলাকা কেঁপে ওঠলো।’ তিনি বলেন, তার দোকানের দুই পাশে সিংগার- এলজি ও শার্পের শোরুমের জানালার থাই গ্লাস ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। তিনি বলেন- এটি আসলে কিসের বিস্ফোরণ একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ বলতে পারবে না।

এদিকে মগবাজারের বিস্ফোরণের ঘটনায় ভবনমালিকসহ তিতাস গ্যাস, বিদ্যুৎ সঞ্চালন কোম্পানির ত্রুটিপূর্ণ সংযোগ, সিটি করপোরেশনের অপরিকল্পিত খননকে সন্দেহের তালিকায় রেখে অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে মামলা করেছে পুলিশ। তবে এ ঘটনার জন্য দায়ী কেউই গ্রেপ্তার হয়নি। এমনকি এ ঘটনায় নিহত ১১ জনের পরিবারের কেউ পায়নি ক্ষতিপূরণও। রাখী নীড় ভিলায় বিস্ফোরণের ঘটনায় পুলিশের পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিস ও বিস্ফোরক পরিদপ্তরের পক্ষ থেকেও তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কিন্তু কেউই এখনো প্রতিবেদন দেয়নি।

ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটির সদস্য ও ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক দিনমণি শর্মা বলেছেন, সাত দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা থাকলেও করোনায় চলমান কঠোর বিধিনিষেধের কারণে সব কাজ শেষ করা যায়নি। তবে খুব শিগগির প্রতিবেদন জমা দেয়া হতে পারে। একই ধরনের কথা বলেন বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদও। তবে তিনি বলেন, বিস্ফোরণটি জমে থাকা গ্যাস থেকে ঘটেছে বলে মনে করছেন তিনি। তবে ঘটনার পর বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ বলেছিলেন- এতবড় বিস্ফোরণ সাধারণ কারণে হওয়ার কথা নয়।

বিস্ফোরিত হওয়া ভবনটির দ্বিতীয় তলায় রয়েছে সিঙ্গার কোম্পানির অফিস। ভবনটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করায়, কোম্পানিতে অফিসের রক্ষিত মালপত্র এখনো বের করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। মালামাল দেখভালের জন্য রাখা হয়েছে একজন সিকিউরিটি গার্ড। তবে ভবনটি থেকে পচা মাংসের দুর্গন্ধ বের হওয়ার কারণে তিনিও দুর্ঘটনা কবলিত স্থানে থাকতে পারছেন না। পাশের একটি ভবনে আশ্রয় নিয়েছেন। সিকিউরিটি গার্ড বাকি বিল্লাহ বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের মালামাল দেখভালের জন্য আমাকে সাভার থেকে এখানে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু দুর্গন্ধের কারণে ভবনের সামনে ডিউটি করতে পারছি না। আশেপাশের এলাকার মানুষ বলছেন, বেঙ্গল মিট এর দোকানের ডিপ ফ্রিজে রক্ষিত মাংস পচে এ দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। তবে ভবনের পেছন থেকেও একই রকম গুমট গন্ধ বের হচ্ছে। অনেকেই মনে করেন- ডিপ ফ্রিজে থাকা মাংস থেকে পচা গন্ধ বের হলেও ভবনের পেছন থেকে কিসের গন্ধ বের হচ্ছে? বিস্ফোরণের এতদিন পরও কি এভাবে গন্ধ বের হওয়ার কথা? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পথচারী বলেন- তার সন্দেহ হচ্ছে ভেতরে কোনো লাশ চাপা পড়েছে কিনা? যেহেতু একজনের লাশ পাওয়া গেছে, আরও গুরুত্ব দিয়ে খোঁজ করে দেখা দরকার, লাশ থাকতেও পারে।

রমনা মডেল থানার উপ পরিদর্শক মোঃ কামরুজ্জামান বলেন, দুর্ঘটনাকবলিত ভবনটি ও আশপাশের এলাকা থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ইতোমধ্যে আলামত সংগ্রহ করেছেন। রাস্তায় পড়ে থাকা ধ্বংসাবশেষ সরানো হয়েছে। তবে ভবনের নিচে অবস্থিত দোকানের মালামাল সরানো হয়নি। ফলে বেঙ্গল মিট এর দোকানের ভিতর ধ্বংসাত্মক ফ্রিজে রক্ষিত মাংস পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এ মামলা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের ডিসি সাজ্জাদুর রহমান। তিনি বলেন, দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হবে। তবে তদন্তে কোনো অগ্রগতি না থাকায় মামলার তদন্তভার পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটে হস্তান্তর হয়েছে।

উল্লেখ্য, গত ২৭ জুন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে রাজধানীর মগবাজার ওয়্যারলেস গেট এলাকায় ‘রাখি নীড়’ ভবনের নিচে তলায় শর্মা হাউজে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ভবনটির তৃতীয় তলা পর্যন্ত ধসে যায়। আশেপাশের আরও ১৪টি ভবনে ফাটল ধরে। এ ঘটনায় ১১ জনের মৃত্যু হয়। আহত হয় শতাধিক মানুষ। আহত ৫ জন এখনো হাসপাতাল চিকিৎসাধীন।

গত ২৯ জুন বিস্ফোরণের ঘটনায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামী করে মামলা করে রমনা থানা-পুলিশ। তবে মামলার তদন্তে কোনো অগ্রগতি হয়নি। ঘটনার পর থেকেই ভবনের মালিক পলাতক। মামলার এজাহারের বরাত দিয়ে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ভবন মালিকের সার্বিক অব্যবস্থাপনা, অতি পুরোনো বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন এবং ত্রুটিপূর্ণ গ্যাস ব্যবস্থাপনার কারণে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে পারে। এ কারণে বিষয়গুলো মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি ভবনের ভাড়াটে শর্মা হাউস, বেঙ্গল মিট, সিঙ্গার বা গ্র্যান্ড কনফেকশনারির অননুমোদিত গ্যাস ও বিদ্যুৎ ব্যবহারে অবহেলার কারণে এই হতাহতের ঘটনা ঘটতে পারে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ সঞ্চালন কোম্পানির ত্রুটিপূর্ণ সংযোগ অথবা ঘটনাস্থলের সামনে সিটি করপোরেশনের অপরিকল্পিত ও গাফিলতিপূর্ণ ড্রেন খনন করে সংস্কার কাজও বিস্ফোরণের জন্য দায়ী হতে পারে।

https://dailysangram.com/post/457769