৬ জুলাই ২০২১, মঙ্গলবার, ৭:০৩

উচ্চশিক্ষায় ভ্যাট কার স্বার্থে?

শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। আমাদের দেশের সংবিধানের ১৫তম অনুচ্ছেদ অনুসারে শিক্ষা নাগরিকদের সুযোগ নয়, অধিকার। শিক্ষা ছাড়া অর্থনীতি, রাজনীতি, গণতন্ত্র কিছুই কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না। অথচ দেশে বেসরকারি পর্যায়ে উচ্চশিক্ষার উপর ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এটি কতটুকু যৌক্তিক শিক্ষা নিয়ে যারা কাজ করেন তারা সেই প্রশ্ন তুলেছেন।
শিক্ষা কোনো পণ্য নয়। শিক্ষা হচ্ছে একটি সামাজিক সেবা। একে পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা উচিত নয়। করোনা যেখানে সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর ভ্যাট আরোপ করা যুক্তিযুক্ত নয় বলে দেশের প্রায় সব শিক্ষাবিদ মনে করেন। দীর্ঘ ১৪ মাস ধরে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। আপাতত খোলার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ফলে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বাস্তবতা হলোÑ দেশ ক্রমান্বয়ে মেধাহীনতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। আমাদের উচিত ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দ্রুত কিভাবে খোলা যায় সেই কর্মপরিকল্পনা নেয়া। কিন্তু তা না করে উল্টো ২০১২-২২ অর্থবছরের বাজেটে বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়, বেসরকারি কলেজ, পলিটেকনিক ও মেডিক্যাল কলেজগুলোর ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। সরকারের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিন্দা ও সমালোচনার ঝড় বয়েছে। এমনিতেই করোনা মহামারীর এ সময় যেখানে শিক্ষা খাতে প্রণোদনা দেয়ার কথা, সেখানে ভ্যাট আরোপ করা মানে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।
আমরা সবাই কমবেশি দেশে প্রচলিত বহু ধারার শিক্ষাব্যবস্থার কুফল ভোগ করছি। বিতর্ক এড়িয়ে জনহিতকর ও বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলন করতে না পারার ব্যর্থতা অপনোদন করতে পারিনি। সেখানে বেসরকারি পর্যায়ে উচ্চশিক্ষায় ভ্যাট আরোপ করা বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। এর আগেও ২০১৫-১৬ অর্থবছরের খসড়া বাজেটে বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়গুলোর ওপর ১০ শতাংশ ভ্যাট চালুর প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তা মানেননি। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেয়া হয় ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ করার। কিন্তু এতেও শিক্ষার্থীরা রাজি হননি। প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন চালিয়ে যান। একপর্যায়ে সরকার বাধ্য হয়ে ওই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। ফলে সে সময় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর ভ্যাট চালু করা যায়নি। তখন সরকারের তরফ থেকে এও বলা হয়েছিল যে, শিক্ষার্থীদের ভ্যাট দিতে হবে না, ভ্যাট দেবে বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা সরকারের ওই কথার উপর আস্থা রাখতে পারেননি। কারণ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর আয়ের একমাত্র উৎস হচ্ছে টিউশন ফি। বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন ভ্যাট পরিশোধ করলেও চূড়ান্তভাবে সেটা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই আদায় করা হতো। এটা শিক্ষার্থীরা ভালোভাবেই জানেন। বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় পরিচালনা আইন ২০১০ এ স্পষ্ট করে বলা আছে, ট্রাস্টের অধীনে বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়গুলো একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। এটা জেনেও সরকার কেন শিক্ষার উপরে ভ্যাট আরোপ করলো তা বোধগম্য নয়। সরকার বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়গুলোর ওপর ভ্যাট আরোপ না করে উচ্চ শিক্ষার নামে যারা প্রতারণা ও সনদ বাণিজ্য করছেন; তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হলে লাখ লাখ শিক্ষার্থী যেমন উপকৃত হতেন, তেমনি বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থায়ও শৃঙ্খলা ফিরে আসত।
পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে অনেকে বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। বলা যায়, বাধ্য হয়ে ভর্তি হচ্ছেন। অনেকে বলতে পারেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তো অনেক কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু আছে। তারা সেখানে গিয়ে পড়াশোনা করতে পারেন। কিন্তু দেখা গেছে, জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের চার বছরের অনার্স শেষ করতে পাঁচ-ছয় বছর লেগে যায়। সেশনজটের ঝামেলা এড়াতেই শিক্ষার্থীরা বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়কে বেছে নিচ্ছেন। কিছু বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। তবে ঢালাওভাবে সব বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় খারাপ তা বলা কোনো যুক্তির ধোপে টেকে না। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডসের (কিউএস) জরিপে বিশ^বিদ্যালয় র্যাংকিংয়ের তালিকায় বাংলাদেশের চার বিশ^বিদ্যালয় যথাক্রমেÑ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়, বাংলাদেশে প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয় (বুয়েট), বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় ব্র্যাক ও নর্থ সাউথ বিশ^বিদ্যালয়ের নাম এসেছে।
নিকট অতীতে দেখা গেছে, ফল বিপর্যয় হওয়ার পরও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পরিমাণ আসন রয়েছে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি শিক্ষার্থী পাস করেছেন। এখন ফল বিপর্যয় নেই। অটোপাসের দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হয়েছে। এমতাবস্থায় সবাই তো আর পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবেন না। যারা পারবে না তারা কোথায় যাবে? তারা কি পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে দেবেন?
সাধারণত ভ্যাট আরোপ করা হয় সাধারণ পণ্যে। ভোক্তা কোনো পণ্য ভোগ বা গ্রহণ করলে তার উপর নির্দিষ্ট হারে ভ্যাট দিতে হয়। শিক্ষা তো কোনো পণ্য হতে পারে না। বরং বলা যায় ভবিষ্যতের বিনিয়োগ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নামমাত্র অর্থের বিনিময়ে পড়াশোনা করতে পারেন। সেখানে বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনেক টাকা খরচ করে পড়াশোনা করতে হয়। বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ে যারা পড়াশোনা করছেন; তারা সবাই ধনী বাবা-মায়ের সন্তান নন। মধ্যবিত্ত ও নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবারের বিপুলসংখ্যক ছেলেমেয়ে সেখানে পড়াশোনা করছেন। অনেকে নিজেদের শিক্ষার ব্যয় মেটাতে টিউশনি কিংবা খণ্ডকালীন চাকরি করছেন। বহু অভিভাবক গরুর দুধ বিক্রি করে কিংবা জমিজমা বিক্রি করে সন্তানকে বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন এই আশায় যে, পাস করার পর একটি চাকরি পাবে।
সংবিধানের ১৫ নং অনুচ্ছেদে শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার বলা হলেও এবারের বাজেটে এ খাতে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে, যা অনাকাক্সিক্ষত। যেখানে শিক্ষার দ্বিগুণ বাজেট বরাদ্দ করার কথা, সেখানে এ বছর শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৭১ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা যা জাতীয় বাজেটের মাত্র ১১ দশমিক ৯২ শতাংশ। জিডিপি হিসেবে ২ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। গত বছর ছিল ২ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এবার শূন্য দশমিক শূন্য ১ শতাংশ কমেছে। আন্তর্জাতিক মানের দিকে তাকালে এই বরাদ্দ খুবই কম। যেকোনো দেশের শিক্ষা বাজেট সেই দেশের মোট বাজেটের ন্যূনতম ১৫-২০ শতাংশ বা জাতীয় আয়ের ৪-৬ শতাংশ হওয়া প্রয়োজন। সারা বিশে^ যেখানে শিক্ষাকে প্রায় বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছে, সেখানে আমাদের দেশে শিক্ষার উপর ভ্যাট কার্যকরী করা মানে ভবিষ্যতে রাষ্ট্রীয় অগ্রগতিকে আরো একধাপ পিছিয়ে দেয়া। কাজেই আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেয়ার এখনই সময়।

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/593047/