৫ জুলাই ২০২১, সোমবার, ৬:৫৮

করোনার নেতিবাচক প্রভাব

রিজার্ভ থেকে আয় কমেছে ১৯৮৩ কোটি টাকা

বৈদেশিক মুদ্রার দাম ও সুদের হার কমায় এমন অবস্থা : কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুখপাত্র

করোনার প্রভাবে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অর্থ বিনিয়োগ করে এক বছরে আয় কমেছে এক হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্খবছরে বিভিন্ন দেশের মুদ্রার দাম ও সরকারি খাতের বন্ডের সুদের হার কমায় এমন অবস্থা হয়েছে। এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে অর্থ বিনিয়োগ করে মোটা অঙ্কের মুনাফা করার নজির রয়েছে। আয় কমার নজির নেই বললেই চলে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অর্থ বিভিন্ন দেশের মুদ্রা ও সরকারি বন্ডে ঝুঁকি বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগ করে। করোনার প্রভাবে গত বছরে প্রায় সব দেশের মুদ্রার মান ও বন্ডের সুদের হার কমে গেছে। এ কারণে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগ থেকে আয় কম হয়েছে। তবে লোকসান হয়নি, আয় হয়েছে, কিন্তু আয়ের হার বেশ কমেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক বন্ডের সুদের হার নেতিবাচক হয়ে গেছে। কোনোটার সুদের হার শূন্যে নেমে গেছে। এসব কারণে এমনটি হয়েছে।

২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক গতিতেই এগোচ্ছিল। ডিসেম্বরের শেষদিকে চীনে করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। জানুয়ারি থেকে চীনের সঙ্গে বিশ্বের ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যাঘাত ঘটতে শুরু করে। ফেব্রুয়ারিতে তা ভয়ানকভাবে কমে যায়। মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত বিশ্ব বাণিজ্য ছিল একেবারে স্থবির। ওই সময় থেকেই বিশ্ববাজারে বিভিন্ন দেশের মুদ্রার দাম কমতে থাকে। একই সঙ্গে কমতে থাকে বিভিন্ন দেশের সরকারের ছাড়া বন্ডের সুদের হার। মূলত ফেব্রুয়ারি থেকে মুদ্রা ও বন্ড বাজারে পতন হতে শুরু করলে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার বিনিয়োগ তুলে নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে জমা রাখতে থাকে। করোনার প্রকোপ বাড়লে সুদের হার ও মুদ্রার দাম আরও কমে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে আগেই সেগুলো বিক্রি করে দেওয়ায় ও বিনিয়োগ তুলে বৈদেশিক মুদ্রার নিজস্ব হিসাবে রাখায় লোকসানের মাত্রা কমানো সম্ভব হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগ করে আয় হয়েছে ৪ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা। এর আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরে একই খাতে আয় হয়েছিল ৫ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে আয় কমেছে ১ হাজার ২০ কোটি টাকা। শতকরা হিসাবে আয় কমেছে ১৭ দশমিক ০৪ শতাংশ। সুদ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে আয় হয়েছে ৪ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরে একই খাতে আয় হয়েছিল ৫ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা। এক বছরে এ খাতে আয় কমেছে ১ হাজার ৪ কোটি টাকা। শতকরা হিসাবে আয় কমেছে ১৬ দশমিক ৯১ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের কমিশন খাতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে আয় হয়েছে ৩৪ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরে হয়েছিল ৫০ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে আয় কমেছে ১৬ কোটি টাকা। শতকরা হিসাবে আয় কমেছে ৩২ শতাংশ।

প্রতিবেদনের তথ্যে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে গড়ে বৈদেশিক মুদ্রার দাম বাড়ার কারণে আয় বেড়েছে ৪২৭ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে এ খাতে গড়ে আয় হয়েছিল ১ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে এ খাতে আয় কমেছে ৯৬৩ কোটি টাকা। আয় কমার হার ৬৯ দশমিক ২৮ শতাংশ। এর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রা বিক্রি করে ২০১৯-২০ অর্থবছরে আয় হয়েছে ৩ হাজার ৯১ কোটি টাকা। এর আগের বছরে এ খাতে আয় হয়েছিল ১ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। ওই সময়ে এ খাতে আয় বেড়েছে ১ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা। শতকরা হিসাবে আয় বেড়েছে ১৬৬ দশমকি ৪৭ শতাংশ। করোনার নেতিবাচক প্রভাব শুরু হওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক বিনিয়োগ তুলে নিয়ে অর্থ নগদায়ন করে রিজার্ভের হিসাবে জমা করে। পরে এগুলোর দাম আরও কমে যায়। এতে এ খাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আয় বেশি হয়।

অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার যে অংশ বিক্রি করা সম্ভব হয়নি বা বিক্রি করেনি সেগুলোর দাম কমে যাওয়ায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে কোনো আয় হয়নি। উলটো আরও আনরিয়ালাইজড বা অবিক্রীত লোকসান হয়েছে ২ হাজার ৬৬৪ কোটি টাকা। এর আগের বছর এ খাতে আয় হয়েছিল ২৩০ কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, করোনার মধ্যে ডলারের দাম তুলনামূলক কম কমেছে। তবে ইউরোর দাম সবচেয়ে বেশি কমেছে। রিজার্ভের বড় অংশই এই দুটি মুদ্রায় রয়েছে। যে কারণে রিজার্ভের আয় যেমন কমেছে। তেমনি মুদ্রার মান কমে যাওয়ায় রিজার্ভের পরিমাণও কমেছে। অর্থাৎ মুদ্রার মান বাড়লে বা স্থিতিশীল থাকলে রিজার্ভ এখন যা আছে তার চেয়ে কমপক্ষে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ বেশি থাকত। এর ওপর আসলে কারও হাত ছিল না। প্রায় সব দেশেরই রিজার্ভের আয় কমেছে।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, করোনার আগে গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগ থেকে আয় বেশি হয়েছিল। ওই অর্থবছরে বিনিয়োগ থেকে আয় হয়েছিল ৪ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরে আয় হয়েছিল ২ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা। ওই বছরে আয় বেড়েছে ১ হাজার ৫১৮ কোটি টাকা। শতকরা হিসাবে বেশি আয় হয়েছে ৫৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রার দাম বাড়ার কারণে আয় হয়েছিল ৮ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরে আয় হয়েছিল ৬ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। ওই সময়ে আয় বেড়েছিল ১ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা। শতকরা হিসাবে আয় বেড়েছিল ২৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/439167/