৫ জুলাই ২০২১, সোমবার, ৬:৫৬

করোনায় স্থবির অর্থনীতি এক বছর পর্যন্ত ডলারের মান অপরিবর্তিত

উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে পরিবর্তন হবে। বাড়বে মূল্যস্ফীতি ও নতুন কর্ম সংস্থান। কিন্তু অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের এ ধারণার সাথে অর্থনৈতিক চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অবস্থান করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত এক বছর যাবৎ বৈদেশিক মুদ্রার মানের কোনো হেরফের হয়নি। গত এক বছর ধরে স্থানীয় মুদ্রার সাথে ডলারের মান অপরিবর্তিত রয়েছে। অর্থাৎ প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা দিয়ে বছর শুরু হয়েছে, আর বছর শেষ হয়েছে একই দামে। ব্যাংকগুলো প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ করছে। কিন্তু স্থানীয় চাহিদা কমে যাওয়ায় তা আর কাজে লাগাতে পারছে না। বাধ্য হয়ে উদ্বৃত্ত ডলার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে দ্বারস্থ হচ্ছে। এভাবে গত অর্থবছরে (২০২০-২১) বাজার থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায় ৬৮ হাজার কোটি টাকা সমমূল্যের ডলার কিনেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, কৃত্রিমভাবে ডলারের দাম ধরে রাখা কোনো ক্রমেই ঠিক না। ইতোমধ্যে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত এমনকি শ্রীলঙ্কাও তাদের স্থানীয় মুদ্রার মানের কয়েক দফা অবমূল্যায়ন করেছে ডলারের সাথে। কিন্তু আমাদের এখানে সম্পূর্ণ আলাদা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাজার হস্তক্ষেপের কারণেই এ অবস্থা হয়েছে। তিনি মনে করেন, এখন সময় এসেছে স্থানীয় মুদ্রার কিছুটা অবমূল্যায়ন করার। তা না হলে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বেন স্থানীয় উদ্যোক্তারা। তিনি বলেন, করোনার কারণে বিশ্ববাণিজ্যে কিছুটা চাহিদা কমে গেছে। কমেছে আমদানি ব্যয়। এ ছাড়া হজের মৌসুমে বড় ধরনের বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন হতো। পাশাপাশি মধ্যবিত্তের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ চিকিৎসার জন্য প্রতিবেশী দেশসহ বিভিন্ন দেশে যেত। এতেও ব্যয় হতো বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে ডলারের অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে গেছে। এসব কারণে স্থানীয় বাজারের ওপর এর প্রভাব পড়েছে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ জানিয়েছেন, উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিতে সাধারণত বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে একটু তারতাম্য হয়। কর্মসংস্থান বাড়ার জন্য এ মূল্যায়ন হতে হয়। কিন্তু আমাদের অর্থনীতিতে ডলারের মান অপরিবর্তিত রয়েছে। এটা অর্থনৈতিক কর্মকা কিছুটা শ্লথগতির লক্ষণ। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, ভারতের স্থানীয় মুদ্রার চেয়ে বাংলাদেশের স্থানীয় মুদ্রা ডলারের বিপরীতে শক্তিশালী অবস্থান করে নিয়েছে। ভারতের পুঁজিবাজারে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক বিনিয়োগকারী তাদের শেয়ার বিক্রি করে চলে গেছে। এতে ওই দেশে ডলারের স্থানীয় চাহিদা বেড়ে যায়। এটা সামাল দিতে গিয়েই ভারতীয় রূপীর মানে অবমূল্যায়িত হয়েছে বেশি হারে। কিন্তু বাংলাদেশে রফতানি বাড়ছে। বাড়ছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। কিন্তু বিপরীতে আমদানি ওই হারে বাড়েনি। এ কারণেই বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ শক্তিশালী অবস্থানে চলে গেছে।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, করোনার প্রাদুর্ভাবে ব্যাংকে বিনিয়োগ চাহিদা নেই বললেই চলে। নতুন নতুন উদ্যোক্তাও আর আসছেন না। যারা আসছেন ব্যবসায়িক মার খাওয়ার আশঙ্কায় তাদেরও ঋণ দেয়া যাচ্ছে না। অর্থাৎ ভালো উদ্যোক্তার অভাব রয়েছে। এর ফলে সামগ্রিক আমদানি কমে গেছে। আর এতে সমস্যায় পড়েছে ব্যাংকগুলো। অনেকেই প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স আহরণ করছে। কিন্তু স্থানীয় বাজারে চাহিদা না থাকায় এখন উচ্চ দরের ডলার এখন তাদের কাছে গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজারে ডলারের চাহিদা না থাকায় তারা বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, অর্থবছরের প্রথম মাসে বাজার থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার কিনেছিল ১৩৪ কোটি মার্কিন ডলার, যা স্থানীয় মূল্য ছিল ১১ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা হিসেবে)। পরের মাসে অর্থাৎ আগস্টে ডলার কেনে ৪০ কোটি ৬০ লাখ ডলার। যার স্থানীয় মূল্য ৩ হাজার ৪৪২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। সেপ্টেম্বরে আবার তা প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে হয় ৮৮ কোটি ১০ লাখ ডলার। যার স্থানীয় মূল্য ছিল ৭ হাজার ৪৭০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। অক্টোবরে আরো বেড়ে হয় ১০১ কোটি ৩০ লাখ ডলার, যা স্থানীয় মূল্য ৮ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা। ৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা মূল্যের ৮৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার কেনা হয় নভেম্বরে। পরের মাসেই অর্থাৎ ডিসেম্বরে কেনা হয় ৮ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা সমমূল্যের ১০১ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এভাবে জানুয়ারিতে ২ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা মূল্যের ৩০ কোটি ৭০ লাখ ডলার, ফেব্রুয়ারিতে ৩ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা মূল্যের ৪১ কোটি ৯০ লাখ ডলার এবং মার্চে কেনা হয় ১ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা মূল্যের ২২ কোটি ডলার। সর্বশেষ গত এপ্রিলে ৪ হাজার ৩৮৪ কোটি টাকা মূল্যের ৪৫ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার কেনা হয় বাজার থেকে। গত মে মাসে ডলার কেনা হয় ৬ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা মূল্যের ৭৬ কোটি ২০ লাখ ডলার। আর গত জুনে কেনা হয়েছে ২ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা মূল্যের ২৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার। আর এ পরিমাণ ডলার কেনা হয়েছে ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা দরে।

প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো ইচ্ছা করলেই বাড়তি ডলার নিজেদের কাছে ধরে রাখতে পারে না। প্রতিটি ব্যাংকেরই তার বৈদেশিক মুদ্রা নিজেদের কাছে ধরে রাখার জন্য সীমা দেয়া আছে। এ সীমাকে এনওপি বা নেট ওপেন পজিশন বলে। নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত ডলার থাকলে হয় সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলার বিক্রি করতে হবে, না হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বিক্রি করতে হবে। কেউ নির্ধারিত সীমার বাইরে ডলার নিজেদের কাছে ধরে রাখলে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে জরিমানা গুনতে হয়। জরিমানার হাত থেকে বাঁচার জন্য ব্যাংকগুলো বাজারে ডলার বিক্রি করতে না পারলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে দ্বারস্থ হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী একটি ব্যাংক তার মূলধনের ১৫ শতাংশের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা নিজেদের কাছে ধরে রাখতে পারে। এর অতিরিক্ত হলেই তাকে বাজারে ডলার বিক্রি করতে হবে।

তাই অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে যাওয়ায় বাজার থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার কিনে নিচ্ছে। এতে টাকার সরবরাহ বেড়ে গেলেও করোনার কারণে মানুষের আয় কমে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতির ওপর তেমন কোনো প্রভাব পড়ছে না বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের মজুদ যেমন শক্তিশালী হয়েছে, তেমনি বৈদেশিক মুদ্রাবাজারও স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করেছে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/592824