৫ জুলাই ২০২১, সোমবার, ৬:৫৫

স্বাস্থ্য খাতের কর্মসূচি প্রকল্প

ট্রেনিংয়ের নামে বেপরোয়া খরচ

রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অচল মোবাইল ক্লিনিক কাম অ্যাম্বুলেন্স

খরচের শৃঙ্খলার মধ্যে থাকছে না স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্প। দীর্ঘ দিন ধরে এই খাতের প্রকল্পে চলমান লাগামহীন বেপরোয়া খরচের ধারা থামানো যাচ্ছে না। অনিয়মের বেড়াজালে আক্রান্ত স্বাস্থ্য খাত। ক্লিনিক্যাল কন্ট্রাসেপশন সার্ভিসেস ডেলিভারি প্রোগ্রামে বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিংয়ের নামে চলছে বেপরোয়া অর্থ ব্যয়। মাথাপিছু যে ব্যয় বরাদ্দ ধরা হয়েছে তার চেয়ে ৩ থেকে প্রায় ৬ শ’ শতাংশ বেশি খরচ করা হয়েছে। বরাদ্দ ছিল ১৬ হাজার ৭৬৬ টাকা; কিন্তু ব্যয় করা হয়েছে এক লাখ ১১ হাজার ৯৩১ টাকা, যা নির্ধারিত খরচের চেয়ে ৬.৬৭ গুণ বেশি। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অচল মোবাইল ক্লিনিক কাম অ্যাম্বুলেন্সসহ ১৯টি যানবাহন।

পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আউএমইডি) বলছে, সিসিএসডিপি ওপি’র সব নথি ও তথ্য, বিশেষ করে ক্রয়সংক্রান্ত, প্রশিক্ষণসংক্রান্ত, কন্ট্রাসেপটিভ, এমএসআর ওষুধ, মেডিক্যাল সরঞ্জাম সংগ্রহ ও ব্যবহার সব তথ্য নিয়মতান্ত্রিকভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে না। প্রকল্পের অগ্রগতি ও বাস্তবায়ন নিয়ে আশঙ্কা ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছে বিভাগটি।

সিসিএসডিপির লাইন ডিরেক্টর ডা: নুরুন নাহার বেগম বলেছেন, মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী, ট্রেনিং মাঠপর্যায়ে হয়। আমরা খরচগুলো করি না। তাদের চাহিদা অনুযায়ী আমরা টাকা দিয়ে থাকি। যেসব অসঙ্গতি পাওয়া গেছে আমরা মিলিয়ে দেখব।

পরিকল্পনা কমিশন ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রের তথ্যানুযায়ী, গত ২০১৭ সালের ২১ মার্চ একনেক সভায় সাড়ে চার বছরে বাস্তবায়নের জন্য ২৯টি অপারেশনাল প্ল্যানের মাধ্যমে বাস্তবায়নের জন্য চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচি অনুমোদন দেয়া হয়, যার মোট খরচ এক লাখ ১৫ হাজার ৪৮৬ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল কর্মসূচি এই প্রকল্পের আওতায় ই-ক্লিনিক্যাল কন্ট্রাসেপশন সার্ভিসেস ডেলিভারি প্রোগ্রাম নেয়া হয়েছে, যার খরচ এক হাজার ৪৯৮ কোটি ৪১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। ২০২২ সালের জুনে এটি শেষ হওয়ার অনুমোদিত মেয়াদ।
লাগামছাড়া মাথাপিছু খরচ : পরিবার পরিকল্পনা সেবা প্রদানকারীদের সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ওপিতে কর্মসূচির আওতায় চিকিৎসকদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বেসিক ট্রেনিং দেয়া হয়। এক হাজার ৫০ জনের মধ্যে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত ৩৩৮ জনকে দেয়া হয়। বেসিক ও রিফ্রেশার ট্রেনিং খাতে প্রাক্কলিত ব্যয়ের ৯৭ শতাংশ ইতোমধ্যে খরচ করা হয়েছে। এই ট্রেনিংয়ে মাথাপিছু খরচ বরাদ্দ ছিল ১৬ হাজার ৭৬৬ টাকা; কিন্তু ব্যয় করা হয়েছে এক লাখ ১১ হাজার ৯৩১ টাকা, যা নির্ধারিত খরচের চেয়ে ৬.৬৭ গুণ বেশি।

লোকাল ট্রেনিং খাতে ৫২০ জনকে প্রশিক্ষণ প্রদানের কথা উল্লেখ থাকলেও এ পর্যন্ত কাউকে ট্রেনিং দেয়া হয়নি। বৈদেশিক প্রশিক্ষণ বাবদ ৩০০ জনের জন্য প্রাক্কলিত খরচ ছিল ১০ কোটি ৮০ লাখ টাকা। সেখানে করোনাকালীন ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত ১৬ জনের বৈদেশিক প্রশিক্ষণ বাবদ ব্যয় হয়েছে পাঁচ কোটি ১২ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। অর্থাৎ জনপ্রতি তিন লাখ ৬০ হাজার টাকা। কিন্তু সেখানে খরচ দেখানো হয়েছে চার লাখ ৪২ হাজার ১০৩ টাকা। এখানে মাথাপিছু ৮২ হাজার ১০৩ টাকা বেশি খরচ করা হয়েছে।

রিজিওনাল ওয়ার্কশপ বা আঞ্চলিক কর্মশালা খাতে চার হাজার ৯২০ জনের জন্য বরাদ্দ ছিল দুই কোটি চার লাখ টাকা। এপ্রিল পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৮১৫ জনের পেছনে এক কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এখানে মাথাপিছু চার হাজার ১৬২ টাকা খরচের কথা থাকলেও দেখানো হয়েছে ১৭ হাজার টাকা। জনপ্রতি ১২ হাজার ৮৩৮ টাকা বেশি খরচ করা হয়েছে। প্রতিজনের পেছনে ৩০৯ শতাংশ বেশি খরচ হয়েছে।

সিসিএসডিপির তথ্যানুযায়ী, পিপিএফপি ট্রেনিং ফর প্যারামেডিক্স খাতে ২০১৭-১৮ অর্থবছর খরচ করা হয়েছিল জনপ্রতি ৬২ হাজার ৩৯২ টাকা। একই ধরনের ট্রেনিং বাবদ পরের ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্যয় করা হয় ৩৯ হাজার ৩২৫ টাকা। আর সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছর জনপ্রতি খরচ দেখানো হয় ২৪ হাজার ৩৮৭ টাকা। অর্থাৎ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় জনপ্রতি প্রায় ১৫৫ শতাংশ বেশি খরচ করা হয়েছিল।

অপারেশনাল প্ল্যানের তথ্যনুযায়ী, ২০১৭-২০২২ সালে মোট পাঁচ হাজার জনের ট্রেনিং খাতে বরাদ্দ করা হয় ছয় কোটি টাকা। যেখানে জনপ্রতি ১২ হাজার টাকা পড়ে। প্রাক্কলিত বরাদ্দ থেকে জনপ্রতি প্রায় ৫২০ শতাংশ বেশি খরচ করা হয়েছে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে। ২২৭ শতাংশ বেশি খরচ করা হয়েছে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এবং ১০৩ শতাংশ বেশি খরচ করা হয়েছে ২০১৯-২০ অর্থবছরে। একইভাবে পেইড পার ভলেন্ট্রিদের ট্রেনিং বাবদ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জনপ্রতি ১০ হাজার ৪৭ টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জনপ্রতি ১১ হাজার ২৭১ টাকা খরচ করা হয়েছে। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা উল্লেখ না থাকলেও খরচ দেখানো হয়েছে ২৮ লাখ ৩৭ হাজার টাকা।

মোবাইল ক্লিনিক কাম অ্যাম্বুলেন্স অচল : এইচপিএনএসডিপির আওতায় এই অপারেশনাল কর্মসূচির কাছে হস্তান্তরকৃত সব মোবাইল ক্লিনিক কাম অ্যাম্বুলেন্স অচল অবস্থায় পড়ে আছে। হস্তান্তরকৃত ২৩টি যানবাহনের মধ্যে ১২টি জিপ এবং চারটি মোবাইল ক্লিনিক কাম অ্যাম্বুলেন্সসহ মোট ১৬টি যানবাহন যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে আছে। এ ছাড়াও এইচপিএনএসডিপি থেকে হস্তান্তরকৃত ১৯টি জিপের মধ্যে ১২টি জিপ অচল অবস্থায় পড়ে আছে। যেখানে প্রতিটি জিপ ৯০ লাখ টাকা দরে কেনা হয় কোয়ালিটি ইম্প্রুভমেন্ট টিমের জন্য। মোবাইল ক্লিনিক কাম অ্যাম্বুলেন্সগুলো হলোÑ আঞ্চলিক সুপারভাইজার, এফপিসিএসটি-কিউএটি, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর ও বরিশালের।

কর্মসূচির দুর্বলতা হলো : প্রসব-পরবর্তী পরিবার পরিকল্পনার সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সাথে কার্যকর সমন্বয়ের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে উল্লেখ করে আইএমইডি বলছে, মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্য কার্যক্রমের লক্ষ্যমাত্রা ও বাস্তবায়িত কার্যক্রমের যথাযথ মনিটরিং না থাকায় ওপি’র লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যাহত হচ্ছে। সিসিএসডিপি ওপি’র সব নথি ও তথ্য, বিশেষ করে ক্রয়সংক্রান্ত, প্রশিক্ষণসংক্রান্ত, কন্ট্রাসেপটিভ, এমএসআর ওষুধ, মেডিক্যাল সরঞ্জাম সংগ্রহ ও ব্যবহার সব তথ্য নিয়মতান্ত্রিকভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে না। জানুয়ারি ২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সারের এপ্রিল পর্যন্ত চার বছর চার মাসে সিসিএসডিপি ওপি’র আর্র্থিক অগ্রগতি ১৮.৭২ শতাংশ। অবশিষ্ট প্রায় ৫৫.৪৮ শতাংশ আর্ধিক অগ্রগতি অর্জন করে ওপি’র সব কার্যক্রম ২০২২ সালের জুনে শেষ করতে হবে।

অন্য দিকে সার্ভিস প্রকিউরমেন্ট প্যাকেজের আওতায় ২০টি স্টাডি কার্যক্রমের জন্য ব্যয় নির্ধারিত থাকলেও ২০২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত মাত্র একটি স্টাডি পরিচালনার কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। সিটি করপোরেশন এলাকায় পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের কর্মকর্তারা সরাসরি সেবা প্রদান কাজে নিয়োজিত থাকেন না। তবে বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে সিসিএসডিপি ওপি থেকে সেবা কার্যক্রম প্রদান চলমান আছে। মেডিক্যাল সরঞ্জমাদি কেনার জন্য ১৪৫ কোটি তিন লাখ ৭৯ হাজার টাকা বরাদ্দ। কিন্তু আইএমইডির তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত আর্থিক অগ্রগতি ১৮১ কোটি ৬২ লাখ টাকা, যা বরাদ্দের চেয়ে বেশি।

আইএমইডির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিসিএসডিপি কর্তৃপক্ষের কাছে সরবরাহকৃত আসবাবপত্রের সংখ্যা, সরবরাহের তারিখ, স্থান এসব বিষয়ে একাধিকবার বিস্তারিত জানতে চাওয়া হলেও তারা এ-সংক্রান্ত বিস্তারিত কোনো তথ্য দেননি। আবার করোনাকালীন ২০২০-২১ অর্থবছরে দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী পরিবার পরিকল্পনা সেবা প্রদানের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে চিকিৎসকদের কোনো প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি। ট্রেনিং খাতে অতিরিক্ত ব্যয়ের ধারাবাহিকতায় এক দিনব্যাপী ওরিয়েন্টেশন কোর্স অন পিপিএফপি আয়োজনে জনপ্রতি প্রাক্কলিত মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি ব্যয় করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে আইএমইডি সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তীর সাথে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে আমাদের প্রতিবেদন দিয়ে অবহিত করছি। তারা বিষয়গুলো নিয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছে। আমাদের এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে তারা তাদের নিজেদের শাণিত করছে। আশা করছি ধীরে ধীরে এসব ত্রুটি-বিচ্যুতি শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে।

পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক বিভাগের সচিব মোসাম্মৎ নাসিমা বেগমের কাছে মূল্যায়ন প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, যখন কোনো প্রকল্প বা কর্মসূচি সময় ও মেয়াদ বাড়ানোর জন্য আমাদের কাছে আসে তখন আমরা বিষয়টি পর্যালোচনা করি।
খরচের অঙ্গতির ব্যাপারে সিসিএসডিপির লাইন ডিরেক্টর ডা: নুরুন নাহার বেগমের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, আইএমইডির রিপোর্ট খসড়া, এখনো চূড়ান্ত হয়নি। খসড়া প্রতিবেদন তারা কেনইবা প্রকাশ করল। তিনি বলেন, আমাদের ট্রেনিং প্রোগ্রামগুলো আমাদের এখানে হয় না। এগুলো মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী, মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় হয়। তারা সেই পরিপত্র অনুযায়ী খরচ করে আমাদের কাছে চাহিদা পাঠায়। আমরা তাদের সেই চাহিদার আলোকে তাদের টাকা দিয়ে থাকি।

তিনি বলেন, রিপোর্টে কিছু অসঙ্গতি আছে। তবে তারা কোথা থেকে এসব তথ্য পেয়েছে আমরা জানি না। আমাদের কাছে তারা বক্তব্য চেয়েছে। আমরা বক্তব্য দেবো। আর ওনাদের রিপোর্ট পেলে আমরা সেসবের সাথে আমাদের তথ্য মিলিয়ে দেখব।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/592825/