৫ জুলাই ২০২১, সোমবার, ৬:৫৪

কুরবানির জন্য প্রস্তুত দেড় কোটি পশু খামারি ও কৃষকদের দিন কাটছে হতাশায়

চলছে সরকার ঘোষিত সপ্তাহব্যাপী সর্বাত্মক লকডাউন। গত ১জুলাই থেকে শুরু হওয়া এ লকডাউন চলবে ৭জুলাই পর্যন্ত। এর আগে ছিল সীমিত লকডাউন। এমতাবস্থায় আসন্ন পবিত্র ঈদুল আজহায় কোরবানির জন্য প্রস্তুত দেড় কোটি পশুর খামারি ও কৃষকদের দিন কাটছে হতাশায়। খামারিরা বলছেন, করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতি ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় এবার এখনও খামারে যাননি ব্যবসায়ীরা। হাট বসার অনুমতিও দেওয়া হয়নি। এতে করে ভালো দামে পশু বিক্রি করতে পারবেন কিনা তা নিয়ে দুশ্চিতা পিঁছু ছাড়ছে না খামারিদের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গরুর খামারিরা প্রতিকূল পরিস্থিতি সামলে আজকের বাজার তৈরি করেছেন। গরুর খামারের মতো কৃষি শিল্পের এ জায়গা তৈরি করা সহজ ছিল না। এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতেই হবে। লকডাউন হোক আর যে কোনো পরিস্থিতি তৈরি করা হোক, গরুর খামারিদের রক্ষা করার তাগিদ দিয়েছেন তারা। এদিকে প্রতিবছর কোরবানির এই ঈদকে কেন্দ্র করে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়। মহামারি করোনা প্রতিরোধে ঘোষিত লকডাউনে সবচেয়ে বড় আর্থিক লেনদেনের উৎসব ঈদুল আজহার বিশাল বাণিজ্য নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

জানা গেছে, কোরবানি ঈদ সামনে রেখে এখন শেষ মুহূর্তের পরিচর্যায় ব্যস্ত দেশের বিভিন্ন জেলার গরুর খামারিরা। বছরজুড়ে গরুগুলো লালন-পালন করেছেন পরম মমতায়। তাদের দাবি মোটাতাজাকরণে ব্যবহার করা হয়নি কোনো রকমের হরমোন বা ওষুধ। তারা বলছেন, গরুর খাবারে তালিকায় মাঠের জমিতে তৈরি করা ঘাষ ও ভুট্টা মাড়াই করে খাওয়ানো হয়েছে। এছাড়া দেশীয় পদ্ধতিতে পাতা, কাঁচা ঘাস, গমের ভূষি, ধানের কুড়া, খৈল, লবণ ও চিটাগুর খাইয়ে পালন করা হয়েছে।

খামারগুলোতে রয়েছে বিভিন্ন রকম দামের পশু। কোরবানির হাটে এসব গরু বিক্রি করে লাভের আশা করলেও করোনা মহামারি ও লকডাউন নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন খামারিরা। ন্যায্যদামের জন্য সরকারি উদ্যোগে সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনার দাবি করছেন তারা। খামারিরা জানান, আমাদের খামারের গরুগুলো বিক্রি করতে পারব কিনা করোনার কারণে এ জন্য আমরা বেশ চিন্তিত। তারা বলেন, সরকারের কাছে একটাই দাবি আমরা যেন গরুগুলো সুস্থভাবে বিক্রি করতে পারি তার ব্যবস্থা করে দিতে। তাদের আশা বিদেশ থেকে গরু আসা বন্ধ থাকলে ভালো দাম পাওয়া যাবে।
করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় কঠোর লকডাউনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশ। এমতাবস্থায় সবচেয়ে বড় আর্থিক লেনদেনের উৎসব ঈদুল আজহার বিশাল বাণিজ্য নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ঈদুল আজহায় কোরবানীর জন্য বিক্রির অপেক্ষায় থাকা প্রায় দেড় কোটি পশুর খামারি ও কৃষকরা দিন গুনছেন হতাশা নিয়ে। পশু ছাড়াও চামড়া শিল্প, ট্যানারি, ফ্রিজ-রেফ্রিজারেটর, ফ্যাশন, মশলাসহ ঈদকে কেন্দ্র করে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি রোধে লকডাউন জরুরি। তবে এর কারণে বিশাল এ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বড় ক্ষতি পুষিয়ে উঠা সম্ভব হবে না। এ জন্য সরকারকে সরবরাহ ব্যবস্থা শক্তিশালী করার পাশাপাশি মানুষের হাতে নগদ টাকা সরবরাহের পরামর্শ দিয়েছেন তারা। তারা বলেন, কৃষক ও খামারিদের যেন বড় ক্ষতি না হয় সেজন্য সাপ্লাই চেইন মসৃণ করতে হবে।

সরকারের প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, এবারে কোরবানির জন্য ১ কোটি ১৯ লাখ ১৭ হাজার পশু প্রস্তুত রয়েছে। এর মধ্যে ৪৬ লাখ গরু ও ৭৩ লাখ ছাগল-ভেড়া। সারা বছর বিনিয়োগ ও কায়িক শ্রমে কোরবানীর জন্য এসব পশু বড় করেছেন খামারি ও কৃষকরা। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবারের কোরবানির জন্য খামারি ও কৃষকেরা মিলে প্রায় দেড় কোটি পশু প্রস্তুত করেছেন।

সাধারণত ঈদের প্রায় এক মাস আগে থেকেই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাটগুলোতে নিয়মিত বেপারি-ফড়িয়াদের আনাগোনা শুরু হয়। ঈদের ১৫ দিন আগে এটি পুরোপুরি জমে উঠে। মানুষ সশরীরে হাটে গিয়ে পছন্দ করে পশু কিনে থাকে। শুধু পশু কেন্দ্রিকই ৩৫-৪০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

নীলফামারী জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে নীলফামারীর ছয় উপজেলায় ৭৪ হাজার ৮৮২ কুরবানির পশু প্রস্তত করা হয়েছে। গত বছর (২০২০ সালে) এর সংখ্যা ছিল ৫৯ হাজার। এবার চাহিদার বিপরীতে ১৫ হাজার ৮৮২ টি পশু বেশি প্রস্তত রয়েছে। জেলায় খামারির সংখ্যা ১৮ হাজার ৫৭৪ জন। ওই সংখ্যা গত বছর ছিল ১৮ হাজার ৫০২ জন। খামারি বেড়েছে ৭২ জন। জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সূত্রে আরও জানা যায়, ওইসব পশুর মধ্যে, সদরে ষাঁড় পাঁচ হাজার ৮২৪, বলদ দুই হাজার ৫৯০, গাভী তিন হাজার ৫০, ছাগল তিন হাজার ৩৪০, ভেড়া ১৮৩, সৈয়দপুরে ষাঁড় চার হাজার ৫২১, বলদ এক হাজার ৪৯৫, গাভী দুই হাজার ১৮০, ছাগল দুই হাজার ৮৩৬, ভেড়া ১৮৮, ডোমারে ষাঁড় দুই হাজার ৯১৬, বলদ এক হাজার ৩৫১, গাভী দুই হাজার ৮৪, মহিষ তিন, ছাগল তিন হাজার ১০২, ভেড়া ১৮৫, অন্যান্য পশু ২০টি রয়েছে। এছাড়াও জেলার ডিমলায় ষাঁড় তিন হাজার ২০৬, বলদ এক হাজার ২৬৫, গাভী তিন হাজার ৭৩১, মহিষ ১৩, ছাগল দুই হাজার ৮৫৮, ভেড়া ৭৭৬, জলঢাকায় ষাঁড় ৯ হাজার ১০৬, বলদ এক হাজার ৪৫৬, গাভী এক হাজার ৮১৪, মহিষ ১০, ছাগল দুই হাজার ৫০০, ভেড়া এক হাজার ১৩৫, কিশোরগঞ্জ উপজেলায় ষাঁড় ছয় হাজার ৩১৭, বলদ ৬৮৭, গাভী দুই হাজার ১৪, ছাগল দুই হাজার ২১, ভেড়া ৩৭৫টি কুরবানির জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। জেলায় মোট গবাদিপশুর সংখ্যা ৭৪ হাজার ৮৮২ টি।

নওগাঁর মান্দায় কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে ছোটবড় খামারে লক্ষাধিক গবাদিপশু পালন করা হয়েছে। কিন্তু মহামারিতে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণরোধে উত্তরাঞ্চলের পশুর হাটগুলো ইতোমধ্যে বন্ধ করে দিয়েছে প্রশাসন। এতে হতাশ হয়ে পড়েছেন খামারীরা। আসন্ন ঈদে পশুগুলো বিক্রি করতে পারবেন কি-না এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে তাদের। উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস সূত্রে জানা গেছে, এবারের কোরবানি ঈদকে সামনে রেখে উপজেলার ৭ হাজার ২৪৭ জন খামারী গবাদিপশু লালন পালন করেছেন। বিক্রির তালিকায় রয়েছে ষাঁড়, বলদ, গাভী, বকনা, মহিষ, ছাগল, ভেড়াসহ অন্যান্য প্রাণি। এদের সংখ্যা প্রায় ৪৫ হাজার। এছাড়া কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে তালিকার বাইরেও ছোটছোট খামার ও বাড়িতে গবাদিপশু পালন করা হয়েছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় ছোটবড় মিলিয়ে ৩০ হাজারেরও বেশি খামার রয়েছে। স্থানীয়ভাবে পালিত এসব গবাদিপশু থেকে এলাকার চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি করে থাকেন খামারীরা। লাভজনক হওয়ায় অনেক বেকার যুবকরা আত্মনিয়োগ করেছেন এ পেশায়। সফলতাও পেয়েছেন অনেকে। কিন্তু করোনার কারণে হাট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেশ দুশ্চিন্তায় ফেলেছে তাদের।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবিএম মির্জা আজিজুল ইসলাম জানান, নানা প্রতিকূল এবং অনিশ্চয়তার মধ্যেই আমাদের কৃষকরা বেঁচে থাকার চেষ্টা করেন। এদেশে গরুর খামারিরাও প্রতিকূল পরিস্থিতি সামলে আজকের বাজার তৈরি করেছেন। গরুর খামার তৈরি করা সহজ ছিল না। খামার কৃষি শিল্পের বিশাল জায়গা তৈরি করতে পারে, তা আজ প্রমাণ হয়েছে। এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতেই হবে। লকডাউন হোক আর যে কোনো পরিস্থিতি তৈরি করা হোক, গরুর খামারিদের রক্ষা করতেই হবে।

অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানান, করোনা মহামারির মধ্যে কয়েকটি ঈদ আমাদের পার করতে হলো। ঈদকে ঘিরে বিশাল বাজার তৈরি হওয়ার রেওয়াজ দাঁড়িয়েছে। কিন্তু করোনার মধ্যে সে বাজারে ধস নেমেছে। মানুষের হাতে নগদ টাকার প্রবাহ কমে গেছে। নগদ টাকার প্রবাহ না থাকলে যে কোনো বাজারই বিপর্যের মুখে পড়ে। গত কোরবানির বাজার নিয়েও অস্থিরতা ছিল। প্রকৃত খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। শেষের দিকে রাজধানীর কোরবানির হাটে গরুই পাওয়া গেল না। অথচ দালাল মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভবান হলো। খামারিরা মার খেলেন।

এদিকে পশু কোরবানির সঙ্গে অর্থনীতিতে চামড়ার ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে। ব্যবসায়ীদের মতে, প্রতিবছর দেশে দেড় কোটিরও বেশি পশুর চামড়া পাওয়া যায়। এর প্রায় ৮০ শতাংশই আসে কোরবানির পশু থেকে। চামড়া ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ খাতের মূল বাজার ৪-৫ হাজার কোটি টাকার। কিন্তু এর সঙ্গে জড়িত অন্যান্য বাজারসহ এ খাতে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে বিশাল এ অর্থনীতির বড় ক্ষতির পাশাপাশি এর সঙ্গে যুক্ত কয়েক লাখ মানুষের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়বে বলে তাদের দাবি।

কোরবানীর আরেক বড় বাজার পেঁয়াজ-রসুনসহ গরম মশলার বাজার। প্রতিবছর দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ২২ লাখ টন। রসুনের চাহিদা ৫ লাখ টন, আদা ৩ লাখ টন। এর উল্লেখযোগ্য অংশই কোরবানিতে ব্যবহার হয়। অন্যদিকে গরম মসলা, বিশেষ করে এলাচি, দারচিনি, লবঙ্গ, জিরা, তেজপাতার বড় অংশ ঈদের রান্নায় ব্যবহৃত হয়। কোরবানি ঈদেই এসব পণ্যে অন্তত ৫ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয় বলে জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া বিদ্যুতায়নের ফলে কয়েক বছর ধরেই দেশে বাড়ছে রেফ্রিজারেটরের বাজার। বর্তমানে প্রায় ৬ হাজার কোটি ছাড়িয়েছে ফ্রিজের বাজার। ঈদুল আজহার সময় রেফ্রিজারেটর ও ডিপ ফ্রিজ বা ফ্রিজারের বাজার থাকে চাঙা। কারণ, কোরবানির মাংস সংরক্ষণে ফ্রিজ বেশ কাজে লাগে। তবে লকডাউন শঙ্কায় ফেলেছে ফ্রিজ উৎপাদকদের।

গত বছরও দেশে করোনার আঘাতের মধ্যেই কেটেছিল ২০২০ সালের ঈদুল আজহা। অর্থনীতির বিশাল কর্মযজ্ঞকে সামনে রেখে তখন লকডাউন কিছুটা শিথিল করেছিল সরকার। মার্কেট-শপিংমল খুলে দেয়ার পাশাপাশি গণপরিবহনও চলে সীমিত পরিসরে। তবুও আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১৩ লাখ পশু কম কোরবানী হয় ২০২০ সালে। আর লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম বিক্রি হয় ২৫ লাখ পশু। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, গত বছর এক কোটি ১৯ লাখ পশু প্রস্তুত করা হয়েছিল। এর মধ্যে কোরবানি হয় ৯৪ লাখ। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের পরিচালক ডা. ভবতোষ কান্তি সরকার বলেন, প্রতি বছরই কোরবানির হার বাড়ে। কিন্তু করোনায় মানুষের আয় কমে যাওয়ায় গত বছর কমেছে। এ বছর তা আরো কমতে পারে।

https://dailysangram.com/post/457648