৫ জুলাই ২০২১, সোমবার, ৬:৫০

দরকার বন্যার জন্য প্রস্তুতি

কিছুটা বয়স্ক পাঠকদের নিশ্চয়ই বন্যার ব্যাপারে অভিজ্ঞতা রয়েছে। ১৯৬০-এর দশক তো বটেই, ১৯৭০-এর দশক পর্যন্তও বাংলাদেশে প্রতি বছর বন্যা হতো। পানিতে তলিয়ে যেতো সারাদেশ, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চল। পরবর্তীকালে অবস্থায় অবশ্য পরিবর্তন ঘটেছে। এখন আর প্রতিবছর একই সময়ে একই রকম বন্যা হয় না। এর পেছনে রয়েছে ভারতের ভূমিকা। বাংলাদেশের সঙ্গে একাধিক চুক্তি থাকলেও ভারত একদিকে শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশকে পানিবঞ্চিত রাখে, অন্যদিকে বর্ষার সময় বিভিন্ন বাঁধের গেট খুলে দিয়ে বন্যায় ভাসিয়ে দেয়।

উদাহরণ দেয়ার জন্য ২০১৭ সালের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া যায়। কুড়িগ্রামসহ ভারতের রাজ্য আসাম সংলগ্ন বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা যখন আষাঢ়ের প্রবল বর্ষণ এবং বর্ষা মওসুমের কারণে প্রাকৃতিক নিয়মে পানিতে তলিয়ে যাচ্ছিল, খাদ্য ও বস্ত্রহীন লাখ লাখ বিপন্ন মানুষ যখন আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছিল ঠিক তেমন এক ভয়ংকর অবস্থার মধ্যে ২০১৭ সালের জুলাই মাসে ভারত হঠাৎ তিস্তা নদীকেন্দ্রিক গজলডোবা বাঁধের সবগুলো গেট খুলে দিয়েছিল। এর ফলে ধেয়ে এসেছিল ‘উজানের’ পানি। আর সে পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল নীলফামারী ও কুড়িগ্রামসহ দেশের উত্তর এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলো। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর উদ্ধৃত করে বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিকগুলোর খবরে তখন জানানো হয়েছিল, দিনের পর দিন ধরে টানা বৃষ্টির সঙ্গে পাহাড়ী ঢলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র ও বরাক নদের উপত্যকায় ব্যাপক বন্যা দেখা দেয়। বন্যার পানি ছড়িয়ে পড়ে আসাম রাজ্য জুড়েও। পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটলে ৯ জুলাই তারিখে গজলডোবা বাঁধের গেটগুলো খুলে দেয় ভারত। এর ফলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নীলফামারীর ডিমলা, গয়াবাড়ি ও জলঢাকা উপজেলা এবং পার্শ্ববর্তী লালমনিরহাট জেলার হাতিবান্ধা ও কালিগঞ্জ উপজেলার সব গ্রামের পাশাপাশি অসংখ্য চরও উজানের পানির তলে তলিয়ে যায়। আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে হাজার হাজার মানুষ। খবরে বলা হয়েছিল, ভারত যদি গজলডোবা বাঁধের গেটগুলো বন্ধ না করে তাহলে পরিস্থিতির ভয়ংকর অবনতি ঘটবে এবং আশপাশের আরো অনেক জেলা ভারতের বন্যা ও ঢলের পানিতে তলিয়ে যাবে। বাস্তবে সেটাই ঘটেছিল। বন্যার পানি ছড়িয়ে পড়েছিল সারাদেশেই।

প্রসঙ্গক্রমে ১৯৯৮ সালে নির্মিত গজলডোবা বাঁধের ইতিহাস স্মরণ করা দরকার। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, ভারতে বন্যা হলে বাংলাদেশের তিস্তা ব্যারেজের ৬০ কিলোমিটার উজানে নির্মিত এ বাঁধটির ৫৪টি গেটই খুলে দেয় ভারত। এর ফলে বন্যায় তলিয়ে যায় বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা। আবার শুষ্ক মওসুমে ভারত একই বাঁধের গেটগুলোয় তালা লাগিয়ে দেয়। তখন গজলডোবার উজানে তিস্তা-মহানন্দা খালের মাধ্যমে দুই হাজার ৯১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধের ভেতরে পানি পবেশ করে। এই বিপুল পরিমাণ পানি দিয়ে বাংলাদেশ সংলগ্ন রাজ্য পশ্চিম বঙ্গের জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর, কুচবিহার ও মালদহ জেলার দুই লাখ ২২ হাজার হেক্টর জমিতে সেচের মাধ্যমে চাষাবাদ করা হয়। অর্থাৎ গজলডোবা বাঁধের সাহায্যে ভারত একদিকে বর্ষার মওসুমে বাংলাদেশকে বন্যার পানিতে ডুবিয়ে দেয়, অন্যদিকে শুষ্ক মওসুমে পানিবঞ্চিত করে নিজেই শুধু লাভবান হয়। একযোগে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির শিকার বানায় বাংলাদেশকে। বলা হচ্ছে, মূলত এজন্যই পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সামনে রেখে ভারত তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর করা থেকে সুকৌশলে বিরত রয়েছে।

ভারতের এই কৌশলকে পানি আগ্রাসন ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। গজলডোবা বাঁধের মাধ্যমে শুধু নয়, ফারাক্কাসহ অন্য অসংখ্য বাঁধ এবং খাল ও নদীর মাধ্যমেও ভারত বাংলাদেশকে ক্ষয়ক্ষতির শিকার বানিয়ে এসেছে। প্রসঙ্গক্রমে ১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যার কথা উল্লেখ করতেই হবে। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গার পানিবন্টন চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। দেশপ্রেমিকদের প্রতিবাদ উপেক্ষা করে স্বাক্ষরিত ওই চুক্তিতে কোনো ‘গ্যারান্টি ক্লজ’ রাখা হয়নি।

এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে ভারত একদিকে শুষ্ক মওসুমে বাংলাদেশকে পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়া থেকে বঞ্চিত করেছে, অন্যদিকে বিশেষ করে ১৯৯৮ সালের বন্যার সময় বন্যার পানিতে পুরো দেশকে ভাসিয়ে দিয়েছে। ভারত ফারাক্কাসহ বিভিন্ন বাঁধের গেট খুলে দিয়ে বাংলাদেশকে তলিয়ে দেয়ার পরও সে সময় আওয়ামী লীগ সরকারের পানিসম্পদমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘উজান’ দেশের পানিতে ‘ভাটির’ দেশ বাংলাদেশকে সব সময় নাকি ‘ডুবতেই’ হবে! সরকারের পক্ষ থেকে অন্য দু’চারজনও সেবার মন্দ শোনাননি। যেমন ৩০ বছর মেয়াদী পাবিণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর পর ১৯৯৭ সালের মার্চেই ভারত যখন বাংলাদেশকে কম হিস্যা দিতে শুরু করেছিল, তখন যুক্তি দেখিয়ে এই বিশিষ্টজনেরা বলেছিলেন, ‘প্রকৃতির ওপর তো কারো হাত নেই!’

ভারতও আওয়ামী লীগ সরকারের এ মনোভাবের সুযোগ নিয়েছে বিভিন্ন সময়ে। যেমন ১৯৯৮ সালের পর ২০০৪ সালের জুলাই মাসেও ভারতের ছেড়ে দেয়া পানিতেই সারাদেশ তলিয়ে গিয়েছিল। বন্যাও হয়েছিল দীর্ঘস্থায়ী। কারণ, সেবার বৃষ্টি ও বন্যা শুরু হওয়ার পর ভারত ফারাক্কা বাঁধের ১০৫টি গেটই খুলে দিয়েছিল। ভারত সেই সাথে ৫৪টি অভিন্ন নদ-নদীর পানি নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্মিত বরাখ ও গজলডোবাসহ অন্য সকল বাঁধের গেট খুলে দিয়েও বাংলাদেশকে বিপন্ন করেছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতেও ভারত বাংলাদেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে চলেছে। ভারতের এই স্বার্থসর্বস্বতার কারণে কোনো মৌসুমেই বাংলাদেশ গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা পায়নি, এখনও পাচ্ছে না। অভিন্ন ও সীমান্তবর্তী নদ-নদীর ব্যাপারেও ভারত একই নীতি ও মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছে। এসব নদ-নদীর কোনো একটিতেই ভারত বাংলাদেশকে বাঁধ নির্মাণ বা ড্রেজিং করতে দিচ্ছে না। ভারতের গজলডোবা বাঁধের কারণে যমুনার পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ। তিস্তা, মহানন্দা, মনু, কোদলা, খোয়াই, গোমতি ও মুহুরিসহ আরো অন্তত ১৫টি নদ-নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণ করেছে ভারত। এভাবে ফারাক্কার পাশাপাশি ছোট-বড় বিভিন্ন বাঁধের মাধ্যমে ভারত পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় এবং পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করায় অভিন্ন ৫৪টির মধ্যে ৪০টি নদ-নদী শুষ্ক মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই ইদানীং পানিশূন্য হয়ে পড়ছে। আবার পুরো বাংলাদেশকে ডুবিয়ে দিচ্ছে বর্ষার মওসুমে। বর্তমান সময়েও বাংলাদেশ ভারতের একই আগ্রাসী নীতি ও কৌশলেরই অসহায় শিকারে পরিণত হয়েছে। যেমন গত ৪ জুলাই বিভিন্ন দৈনিক তাদের খবরে জানিয়েছে, কুড়িগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও শেরপুরসহ কয়েকটি জেলায় বাড়িঘর ও ফসলী ক্ষেত তলিয়ে গেছে। শুধু তা-ই নয়, গাবুর হেলান, খিতাবখা, দরিকিশোরপুর, থেতরাই এবং হোকডাঙাসহ নদীর ২১টি পয়েন্টে ভাঙন ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড আশঙকা প্রকাশ করে বলেছে, এখনই ব্যবস্থা না নেয়া হলে এক সপ্তাহের মধ্যে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, এ ধরনের সর্বব্যাপী ক্ষয়ক্ষতি থেকে দেশ ও জাতিকে বাঁচাতে হলে ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ অবস্থান নেয়া দরকার। এ ব্যাপারে দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলোকে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে। বাংলাদেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করার অভিযোগে ভারতের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অমন ব্যবস্থা নেয়া সম্ভবও। কারণ, এ আইনেই বলা আছে, উজানের দেশ ভাটির দেশকে শুষ্ক মওসুমে পানি বঞ্চিত যেমন করতে পারবে না তেমনি বর্ষা মওসুমে পারবে না বন্যায় তলিয়ে দিতেও। আন্তর্জাতিক আইনের এই সুবিধা নিয়ে স্পেন ও পাকিস্তানসহ অনেক রাষ্ট্রই বিভিন্ন সময়ে প্রতিবেশি রাষ্ট্রের কাছ থেকে পানির অধিকার আদায় করেছে। সে জন্যই এখন বেশি দরকার আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা, সরকার যাতে ভারতের পানি আগ্রাসনের বিষয়টি জাতিসংঘের পাশাপাশি সকল আন্তর্জাতিক ফেরামেও উত্থাপন করতে বাধ্য হয়।

এ বিষয়ে সরকারের ওপর নির্ভর করা যায় না বলে তো বটেই, হাতে যথেষ্ট সময় নেই বলেও আমাদের এখন ভয়ংকর এবং দীর্ঘমেয়াদী বন্যা মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুতি নেয়া দরকার। কারণ, বিশেষজ্ঞরা বলেছেন এবং অভিজ্ঞতায়ও দেখা গেছে, জুলাইয়ের শেষ থেকে আগস্টের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই বন্যা সারা দেশকে ডুবিয়ে দিতে পারে।

https://dailysangram.com/post/457625