৪ জুলাই ২০২১, রবিবার, ৩:০৯

নিম্নাঞ্চল-চরাঞ্চলে পানি ঢুকে পড়েছে, বাড়ছে নদীভাঙনও

অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে কয়েক দিন ধরে দেশের নদ-নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে গতকাল শনিবার বৃষ্টিপাত কিছুটা কমায় বেশির ভাগ নদীর পানিই স্থিতিশীল রয়েছে, বাড়ছে শুধু পদ্মা নদীতে। এরই মধ্যে দেশের নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলে পানি ঢুকে পড়েছে। পানি বাড়ায় নদীভাঙনও বাড়ছে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র গতকাল বলেছে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ-নদীর পানি স্থিতিশীল রয়েছে। তবে আগামী ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি বাড়তে পারে। পদ্মা নদীর পানি বাড়ছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদ-নদীগুলোর পানিও স্থিতিশীল রয়েছে। তবে এই সময়ে দেশের উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, ব্রহ্মপুত্র, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মেঘনা অববাহিকা এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় পার্বত্য অববাহিকার প্রধান নদ-নদীগুলোর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।

গতকালের আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, রংপুর, ময়মনসিংহ, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের বেশির ভাগ জায়গায় এবং ঢাকা, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ী দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে মাঝারি ধরনের ভারি থেকে ভারি বর্ষণ হতে পারে। গতকাল সকাল ৬টা পর্যন্ত সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে পটুয়াখালীতে ৯৫ মিলিমিটার।

রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া গেজ স্টেশনে ছয় সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে তা শনিবার বিকেল পর্যন্ত ৭.৭৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে বিপত্সীমার কাছাকাছি এসে গেছে পদ্মার পানি। পানি বাড়ায় পদ্মায় স্রোত ও উত্তাল অবস্থা দেখা গেছে।

দৌলতদিয়া গেজ স্টেশনের গেজ রিডার মো. ইদ্রিস আলী জানান, প্রতিদিনই পদ্মায় পানি বাড়ছে। এখনো বিপত্সীমার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হলেও নিম্নাঞ্চলে পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে। এভাবে পানি বৃদ্ধি পেতে থাকলে কয়েক দিনের মধ্যে পদ্মার পানি বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে।

যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বৃদ্ধির ফলে প্লাবিত হচ্ছে চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা। শাহজাদপুর, চৌহালী ও কাজিপুর উপজেলায় দেখা দিয়েছে তীব্র নদীভাঙন। পানিবন্দি হয়ে পড়ছে এসব এলাকার অন্তত ১৫ হাজার মানুষ। তলিয়ে গেছে বীজতলা, সবজি বাগান, পাট ও তিলক্ষেত।

চৌহালীর বিনানুই গ্রামের শফিকুল ইসলাম বলেন, 'ভাঙনের কারণে আমরা ঘরবাড়ি সরানোর কাজে ব্যস্ত। গত বছরে ভাঙনে ঘরবাড়ি সরিয়ে এনে এখনো ঠিকভাবে দাঁড় করাতে পারিনি, আবারও ভাঙনে সরিয়ে নিতে হচ্ছে।'

নেত্রকোনায় বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে নতুন করে সোমেশ্বরী নদীর ভাঙনে চোখের পলকেই বিলীন হচ্ছে নানা স্থাপনা। নেত্রকোনার দুর্গাপুর পৌর সদরের শিবগঞ্জ, ডাকুমারা, কামারখালী, বহেরাতলী, বড়ইকান্দি, রানীখং ও দুর্গাপুর সদর ইউনিয়নের ফারংপাড়া, বিরিশিরি ইউনিয়নের চৈতাটি, বারইপাড়া গ্রামের বেশ কিছু অংশ ভেঙে গেছে। ফসলি জমি, বসতভিটা, রাস্তাঘাট ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিছুই ভাঙন থেকে রক্ষা পাচ্ছে না।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নেত্রকোনা জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী মোহন লাল সৈকত জানান, নদীতে নতুন করে পানি আসার ফলে ভাঙন দেখা দিয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যেই জিও ব্যাগ ফেলার কাজ শুরু হবে।

উজানের ঢল আর টানা বর্ষণে বাড়ছে কুড়িগ্রামের ধরলার পানি। আর ভাঙনের তাণ্ডব শুরু হয়েছে মেকলি, ধনিরাম, গোড়কমণ্ডল, চর কৃষ্ণপুর, পাঁচগাছি, সারডোবসহ বিভিন্ন স্থানে। ভিটেমাটি, ফসলি জমি, গাছপালা নিমিষেই চলে যাচ্ছে নদীগর্ভে। ভাঙনের তীব্রতার মুখে ঘরবাড়ি সরানোর ফুরসত মিলছে না। বাঁধের রাস্তায় চালা তুলে থাকা পরিবারগুলোর জীবন চলছে অন্যের সাহায্যের ওপর।

ধরলা পারের দিনমজুর বাবলু মিয়া জানান, ১৫-২০ দিন ধরে হাতে কাজ নেই। ধার-দেনা বাড়ছে। এ অবস্থায় ভিটে থেকে ঘর সরিয়ে এখন একবেলা খেলে অন্যবেলা অভুক্ত থাকতে হচ্ছে। ওমেদ আলী স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে সারা রাত বৃষ্টিতে ভিজে ঘরবাড়ি সরিয়েছেন। এখন রাস্তার ওপর আছেন। দিনমজুর শাহ আলম বলেন, 'এলা বাড়ি ঠিক করি না ধার শোধ করি। ধল্লা হামাক মারি ফেলাইলে।' তাঁর প্রতিবেশী বাবুল মিয়া চালা তোলায় ব্যস্ত। মাত্র কয়েক গজ দূরেই গর্জন করছে ধরলার স্রোত। অন্য প্রতিবেশী মওলা মিয়া বৃহস্পতিবার দুপুরেই ঘরের মালপত্র নৌকায় করে নিয়ে গেছেন।

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম দাবি করেছেন, ধরলার ভাঙন এখনো নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ভাঙনপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে।

নওগাঁর ধামইরহাটের আত্রাই নদীর বাঁধে ধস দেখা দিয়েছে। প্রায় দেড় শ মিটার জায়গা ধসে যাওয়ার যেকোনো মুহূর্তে বাঁধ ভেঙে যেতে পারে। এতে লোকালয় এবং শত শত সবজি ক্ষেত পানিতে তলিয়ে যেতে পারে। সেই সঙ্গে উপজেলা সড়ক বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

জানা যায়, এই বাঁধ কাম সড়ক নির্মাণ হওয়ায় আগে ওই এলাকার লোকজনকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার ঘুরে পত্নীতলায় যেতে হতো। তা ছাড়া আত্রাই নদীর তীরবর্তী এলাকার হাজার হাজার কৃষক বিশেষ করে বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষিরা তাঁদের উৎপাদিত ফসল পত্নীতলা উপজেলার নজিপুর হাট ও বাজারে প্রতিদিন বিক্রি করেন। বাঁধ ভাঙলে প্রায় ২০-২৫ গ্রামের বাড়িঘর ও শত শত একর জমির সবজি ক্ষেত পানিতে তলিয়ে যাবে।

নওগাঁর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান খান বলেন, বরাদ্দ দেরিতে আসায় ওই বাঁধের সংস্কারকাজ করতে বিলম্ব হয়েছে। বর্তমানে প্রায় ৪৬ লাখ টাকা ব্যয়ে জিও ব্যাগে বালুভর্তি করে বাঁধটি ডাম্পিং করার জন্য ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে। আশা করছি নদীতে পানিপ্রবাহ বৃদ্ধির আগে সংস্কারকাজ শেষ হবে।

https://www.kalerkantho.com/online/national/2021/07/04/1049786