৪ জুলাই ২০২১, রবিবার, ২:৫৮

দেশে স্বর্ণের বার ও কয়েন উৎপাদনের দুয়ার খুলেছে

স্বর্ণের আন্তর্জাতিক বাজারের অংশীদার হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বৈধভাবে অপরিশোধিত বা আংশিক পরিশোধিত স্বর্ণ আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এতে স্বর্ণ আমদানির যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। অপরিশোধিত স্বর্ণ আমদানির পর তা কারখানায় পরিশোধনের মাধ্যমে সোনার বার ও কয়েন উৎপাদন করা হবে। সেগুলো সরাসরি রফতানির পাশাপাশি দেশে অলংকার তৈরির পর অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানো কিংবা বিদেশে রফতানির সুযোগ তৈরি হবে। এজন্য নীতিমালাও সংশোধন করা হয়েছে।

জানা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে স্বর্ণের বার আমদানি করেন স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা। আর সেসব স্বর্ণ থেকে তৈরি অলংকার শুধু দেশেই বিক্রি করতে পারতেন তারা। ২০১৮ সালে সোনা নীতিমালায় তৈরি হয় সোনা রফতানির সুযোগও। এবার দেশেই সোনা পরিশোধন করে বার ও কয়েন রফতানির লক্ষ্যে সেই নীতিমালা সংশোধন করেছে সরকার। আকরিক এনে বার ও কয়েন তৈরি করে সিঙ্গাপুরসহ অনেক দেশ। আর এখাতে বিনিয়োগে আগ্রহী দেশের ব্যবসায়ীরাও।

বৈধভাবে অপরিশোধিত বা আংশিক পরিশোধিত সোনা আমদানির সুযোগ দেওয়া হলেও এজন্য অবশ্যই আমদানিকারককে পরিশোধনের জন্য কারখানা স্থাপন করতে হবে। অপরিশোধিত সোনা আমদানির পর তা কারখানায় পরিশোধন করে স্বর্ণের বার বা কয়েন উৎপাদন করবে। ওইসব বার বা কয়েন রফতানির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে পারবে। এর আগে দেশে প্রথমবারের মতো অপরিশোধিত ও আংশিক পরিশোধিত সোনা আমদানির সুযোগ দিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত জুন মাসে স্বর্ণ নীতিমালা-২০১৮ সংশোধন করে। সেই আলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা ও নীতি বিভাগ গত বৃহস্পতিবার (১ জুলাই) সোনা পরিশোধনের জন্য লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে অপরিশোধিত এবং আংশিক পরিশোধিত সোনা আমদানির অনুমতি নেবে, সে বিষয়ে সার্কুলার জারি করেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলারে বলা হয়েছে, সোনা পরিশোধনের জন্য কারখানা স্থাপনে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হবে। পরিশোধিত প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশে নিবাসী একক বা অংশীদারি প্রতিষ্ঠান কিংবা নিবন্ধিত লিমিটেড কোম্পানি হতে হবে। অনুমোদনের শর্তানুযায়ী, নির্ধারিত স্থানে সোনা পরিশোধনাগার স্থাপন করতে হবে। অন্যান্য সব ধরনের লাইসেন্সের পাশাপাশি সোনা পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানকে সরকার অনুমোদিত ব্যবসায়ী সংগঠনের বৈধ সদস্য হতে হবে।

অনুমোদন পাওয়া প্রতিষ্ঠানকে অপরিশোধিত ও আংশিক পরিশোধিত সোনা আমদানির জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আবেদন করতে হবে। আমদানির অনুমতির জন্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের কাগজপত্র, হালনাগাদ ট্রেড লাইসেন্স, টিআইএন সনদ, মূসক নিবন্ধন, সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী সংগঠনের সদস্যপদের কপি, প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের জীবনবৃত্তান্ত, পরিশোধনাগারের নির্ধারিত স্থানের মালিকানার দলিল ইত্যাদি জমা দিতে হবে। অনুমতি ফি বাবদ ৩০ লাখ টাকা জমা দিতে হবে। অনুমোদনের মেয়াদকাল হবে পাঁচ বছর। মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগে আবারও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতির নবায়ন নিতে হবে।

সংশোধিত স্বর্ণ নীতিমালায় বলা হয়েছে, বিশ্বের অলংকার উৎপাদক ও রফতানিকারক দেশের মধ্যে বেলজিয়ামসহ ইউরোপের দেশ, ভারত, চীন অন্যতম। আর অলংকার আমদানিকারক দেশের মধ্যে সুইজারল্যান্ড, চীন, যুক্তরাজ্য, হংকং, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বেলজিয়াম, জার্মানি ও সিঙ্গাপুর শীর্ষ স্থানে রয়েছে। ২০১৯ সালে বিশ্বে মেশিন ও হাতে তৈরি সোনার অলংকারের বাজার ছিল ২২ হাজার ৯৩০ কোটি ডলারের। ২০২৫ সালে সেটির আকার বেড়ে ২৯ হাজার ১৭০ কোটি ডলারে দাঁড়াবে। হাতে তৈরি অলংকারের মূল্য সংযোজন বেশি। বিশ্বের ৮০ শতাংশ হাতে তৈরি অলংকার বাংলাদেশ ও ভারতে তৈরি হয়। তবে নানা কারণে রফতানি বাজারে ভালো করতে পারেনি বাংলাদেশ। এমনকি সোনার উচ্চমূল্যের কারণে দেশের বাজারও সংকুচিত হচ্ছে।

গেজেটে বলা হয়েছে, ধারণা অনুযায়ী দেশে বছরে প্রায় ২০-৪০ মেট্রিক টন সোনার চাহিদা রয়েছে। তার মাত্র ১০ শতাংশ চাহিদা পুরোনো অলংকার দিয়ে মেটানো হয়। বাকি ১৮ থেকে ৩৬ মেট্রিক টন বৈধভাবে আমদানির মাধ্যমে পূরণ হয় না। সোনার বাজার ও জুয়েলারি ব্যবসায় স্বচ্ছতা ফেরাতে ২০১৯ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকসহ ১৮টি প্রতিষ্ঠানকে সোনা আমদানির জন্য লাইসেন্স দেয়। পরে আরেকটি প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স পায়।

লাইসেন্স পাওয়ার পরও শুল্ক বেশি থাকায় প্রথম ছয় মাস কোনো সোনা আমদানি করেনি প্রতিষ্ঠানগুলো। গত অর্থবছরের বাজেটে ২০ শতাংশ কর প্রত্যাহার করা হয়। তারপর ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড গত বছরের ১০ জুন ১১ হাজার গ্রাম সোনা আমদানির জন্য আবেদন করে। দ্রুত সময়ে অনাপত্তি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। দুবাই থেকে ৩০ জুন সোনার বার আমদানি করে প্রতিষ্ঠানটি। পরে আরোসা গোল্ড করপোরেশন ১৫ হাজার গ্রাম সোনা আমদানি করে।

দেশে অপরিশোধিত ও আংশিক পরিশোধিত সোনা আমদানির সুযোগ দিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত মাসে স্বর্ণ নীতিমালা-২০১৮ সংশোধন করেছে। সেই আলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক গত বৃহস্পতিবার সোনা পরিশোধনের জন্য লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে সোনা আমদানির অনুমতি নেবে, সে বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির নেতারা বলছেন, দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপ গত বছর সোনা পরিশোধনের কারখানা স্থাপনের অনুমতি চেয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে। এরপরই মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয় এবং স্বর্ণ নীতিমালা সংশোধন করে। ইতিমধ্যে বসুন্ধরা গ্রুপ সোনা পরিশোধনাগার স্থাপনে প্রাথমিক সম্মতিও পেয়েছে। এ ছাড়া ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডও কারখানা স্থাপনের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছে। জানা যায়, অপরিশোধিত সোনা পরিশোধনের জন্য বসুন্ধরা গোল্ড রিফাইনারি লিমিটেড নামে নতুন কোম্পানি খুলেছে বসুন্ধরা গ্রুপ। ইতিমধ্যে কোম্পানিটি বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) সদস্যপদও নিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, পরিশোধন কারখানা স্থাপনের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হবে। অনুমোদনের শর্তানুযায়ী, নির্ধারিত স্থানে সোনা পরিশোধনাগার স্থাপন করতে হবে। অন্যান্য সব ধরনের লাইসেন্সের পাশাপাশি পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানকে সরকার অনুমোদিত ব্যবসায়ী সংগঠনেরও বৈধ সদস্য হতে হবে।

জুয়েলার্স সমিতির নেতারা জানান, পরিশোধন কারখানা স্থাপনের চূড়ান্ত অনুমতির জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিমানবন্দরের ৮-১০ কিলোমিটারের মধ্যে ২০ বিঘা জমি থাকতে হবে। তা ছাড়া বন্ড লাইসেন্স, পরিবেশ ছাড়পত্র, ফায়ার সার্ভিসের অনাপত্তিসহ সরকারের বেশ কয়েকটি দপ্তর থেকে লাইসেন্স নিতে হবে।

জুয়েলার্স সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলীপ কুমার আগরওয়ালা জানান, আধুনিক মানের পরিশোধন কারখানা স্থাপনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ দরকার। তবে বসুন্ধরা কত টাকা বিনিয়োগ করবে, সেটি আমার জানা নেই। তিনি জানান, কঙ্গো, মালি ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে অপরিশোধিত সোনা আমদানি করা যাবে। তবে পরিশোধিত সোনায় কী রকম শুল্ক ও কর আরোপ করা হবে, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। বিদেশ থেকে অপরিশোধিত সোনা দেশে এনে পরিশোধনের বিষয়টি আমাদের জন্য একেবারেই নতুন।

সংশোধিত স্বর্ণ নীতিমালায় বলা হয়েছে, বিশ্বে অলংকার উৎপাদক ও রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে বেলজিয়ামসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং ভারত, চীন অন্যতম। ২০১৯ সালে বিশ্বে মেশিন ও হাতে তৈরি সোনার অলংকারের বাজার ছিল ২২ হাজার ৯৩০ কোটি মার্কিন ডলারের। ২০২৫ সালে আকার বেড়ে ২৯ হাজার ১৭০ কোটি ডলারে দাঁড়াবে। সুনির্দিষ্ট হিসাব না থাকলেও দেশে বছরে প্রায় ২০-৪০ মেট্রিক টন সোনার চাহিদা রয়েছে। তার মাত্র ১০ শতাংশ চাহিদা পুরোনো অলংকার দিয়ে মেটানো হয়। বাকিটা ব্যাগজ রুলের আওতায় বিদেশ থেকে আসে। অবৈধভাবেও বিপুল সোনা আসে। তাই সোনার বাজার ও জুয়েলারি ব্যবসায় স্বচ্ছতা ফেরাতে ২০১৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকসহ ১৯টি প্রতিষ্ঠানকে সোনা আমদানির লাইসেন্স দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

তবে আমদানি পর্যায়ে উচ্চ শুল্কের কারণে প্রথম ছয় মাস সোনা আমদানি করেনি প্রতিষ্ঠানগুলো। গত ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে ২০ শতাংশ কর প্রত্যাহার করা হয়। এরপর ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড দুবাই থেকে ১১ হাজার গ্রাম সোনা আমদানি করে। এরপর আরোসা গোল্ড করপোরেশন ১৫ হাজার গ্রাম সোনা আমদানি করে। একাধিক প্রতিষ্ঠান আবেদন করলেও সোনার মান যাচাইয়ের অজুহাতে কয়েক মাস আমদানি বন্ধ থাকে। গত ছয় মাসে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড ১০০ কেজি সোনা আমদানি করেছে। আরেকটি প্রতিষ্ঠান এনেছে ১০ কেজি সোনা। এরপরও আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় দেশের বাজারে সোনার দাম তুলনামূলক বেশি। এ জন্য সোনার বৈধ আমদানিতে শুল্কসহ অন্যান্য খরচকে দুষছেন ব্যবসায়ীরা।
সোনা পরিশোধনের কারখানা স্থাপনের বিষয়ে জুয়েলার্স সমিতির সহসভাপতি দেওয়ান আমিনুল ইসলাম জানান, সোনা পরিশোধন শুরু হলে দেশের ভেতর থেকেই বৈধভাবে সোনা কেনার সুযোগ পাবেন ব্যবসায়ীরা। এতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভোক্তারাও উপকৃত হবেন।

https://dailysangram.com/post/457540