৪ জুলাই ২০২১, রবিবার, ২:৫৬

দেশ রাজনীতি শূন্য

‘দেশ রাজনীতি শূন্য, কোথাও রাজনীতি নেই।’ এই বক্তব্য ক্ষমতাসীন দল ও তাদের জোটে থাকা থাকা সিনিয়র নেতাদের। গত ২৮ জুন সংসদ অধিবেশনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা বলেছেন, দেশে এখন রাজনীতি নেই, দেশ চালাচ্ছেন আমলারা। সরকারি দল ও সরকারি জোটে থাকা রাজনীতিবিদদের এমন বক্তব্য দেশে বিদেশে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। কারণ আগে এই অভিযোগটি কেবল বিরোধীরা করলেও এখন খোদ সরকারি জোট থেকেই এটি বলা হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার না থাকলে দেশে রাজনীতি থাকে না। তখন যারা বা যে গোষ্ঠীর তত্ত্বাবধানে ক্ষমতার রদবদল হয়, তাদেরই কর্তত্ব থাকে। বাংলাদেশেও তাই ঘটেছে। সবার অংশগ্রহণে একটি নিরপক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমেই দেশে প্রকৃত রাজনীতির ধারা আবারো চালু করা সম্ভব বলে তারা মনে করেন।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, যে দেশে গণতন্ত্র নেই, রাজনৈতিক কোনো কর্মকাণ্ড নেই, সেই দেশে রাজনীতিবিদদের গুরুত্ব থাকার প্রশ্নই আসে না। তিনি বলেন, ক্ষমতা ধরে রাখতেই সরকার দেশে আমলা নির্ভর রাজনীতির সূচনা করে রাজনীতিতে শূণ্যতার সূত্রপাত করছে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতা দখলের জন্য কর্তৃত্বপরায়ণ আচরণের মাধ্যমে সমস্ত রাজনীতিবিদদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে। বিরোধী দলকে অবমূল্যায়ন করতে করতে তারা নিজেরাই মূল্যহীন হয়ে যাচ্ছে।

খসরু আরো বলেন, সংসদীয় ব্যবস্থায় নির্বাচন গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলেও দুর্ভাগ্যক্রমে কয়েক বছর ধরে এটি অনুপস্থিত। জনগণের ভোটাধিকার নেই। নির্বাহী বিভাগ থেকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে আমলাদের মাধ্যমে। ফলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। তিনি বলেন, ক্ষমতা ধরে রাখতে সরকার আমলাদের শক্তিশালী করার যে কৌশল নিয়েছে তারা নিজেরাই এখন সেই ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে। তারা দূরদর্শী হলে এ কাজ করতো না। এভাবে চলতে থাকলে যতোই দিন যাবে ততোই আমলাতন্ত্রের যাঁতাকলে রাজনীতিবিদরা পিষ্ট হতে থাকবে। এটা আগামী প্রজন্মের নতুন রাজনীতির জন্য ভয়াবহ অশনি-সংকেত।

বাংলাদেশের রাজনীতি এখন কার হাতে সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন রাজনীতি এখন আর রাজনীতিবিদ এবং সাধারণ মানুষের হাতে নেই। আর সিদ্ধান্ত গ্রহণেও তাদের ভূমিকা গৌণ হয়ে গেছে। তাহলে কারা সিদ্ধান্ত নেন? সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের পরে এই প্রশ্ন আরো বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াসহ বিভিন্ন কার্য বিষয়টিকে আলোচনায় নিয়ে এসেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে ক্ষমতাসীনরা বিরোধীদের কোণঠাসা করে রাখার কারণে প্রকৃত রাজনৈতিক চর্চার পাশাপাশি বিরোধীরা পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাৎ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। পক্ষান্তরে পুলিশ ও প্রশাসননির্ভর সরকারি দলের নেতাকর্মীরাও শুধু অর্থনৈতিক চাহিদা ও ক্ষমতা চর্চায় ব্যাপৃত হয়েছেন। ফলে নিজেদের মধ্যে দেখাসাক্ষাৎ ও রাজনৈতিক চর্চার অভাব হেতু বোঝাপড়া দিনকে দিন কমছে। ঐক্যের পরিবর্তে রাজনীতি হয়ে উঠছে পার্থক্য নির্ভর। চিন্তার নৈরাজ্য, প্রযুক্তির অপব্যবহার, সন্দেহ ও অবিশ্বাসের বাতাবরণে রাজনীতিতে উত্তর-আধুনিকতার ভয়াবহ প্রভাব চিরায়ত রাজনীতির শৈল্পিক সৌন্দর্যকে ম্লান করে দিচ্ছে।

বাংলাদেশের রাজনীতির পর্যবেক্ষক এবং গবেষক আফসান চৌধুরী সম্প্রতি বলেছেন, কোনো দলের রাজনীতিই আর রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। এর নিয়ন্ত্রক এখন সিভিল ও মিলিটারি ব্যুরোক্রেসি এবং বিত্তশালীরা। আর সাধারণ মানুষও রাজনীতিতে নেই। তাদের গুরুত্বও নেই। ফলে যা হবার হয়েছে। রাজনীতি চলে গেছে রাজনীতিবিদদের হাতের নাগালের বাইরে। তিনি বলেন, রাজনীতি বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। শাসন করার ক্ষমতা যার হাতে তিনি রাজনীতিবিদ। রাজনীতি শাসন করে। আর সেই দিক থেকে রাজনীতিকে বিবেচনা করলে বোঝা যাবে রাজনীতি কার হাতে। এটা স্পষ্ট যে শাসন করার ক্ষমতা এখন আর একক কারোর হাতে না। এটা নানা গ্রুপের হাতে ভাগ হয়ে গেছে। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে সিদ্ধান্ত নেন হাতে গোনা কয়েকজন মানুষ। আর গত ৩০ বছরে বিশ্বে রাজনীতিতে পরিবর্তন এসেছে। জনগণ এখন রাজনীতিতে শুধু রাজনীতিদিদের দেখতে পায়না। তারা আরো অনেককে দেখতে পায়।

সত্তরোর্ধ আলী হোসেন।দেশের রাজনীতি নিয়ে ভাবেন। তার ভাষায়, গত কয়েকবারের মতো ভোটের পরিবেশ জীবনে আর দেখেননি। জোর করে তার ব্যালটে সিল মেরেছেন বুথের ভেতরে আগে থেকে অবস্থান করা অন্য একজন। পাশে থেকে সেটি দেখেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ প্রশাসনের অণ্যরা। ভয়ে কিছু বলতেও পারেন নি। দেশের রাজনীতি নিয়ে এমন মন্তব্য তার। তিনি বলেন, প্রফেশনাল রাজনীতিবিদরাই হলেন একমাত্র গোষ্ঠী যারা সাধারণ মানুষের (পাবলিক) ওপর পুরোপুরি নির্ভর করেন। এখন সাধারণ মানুষের যেহেতু কোনো ভূমিকা রাজনীতিতে নেই, সেকারণে রাজনীতিবিদরা সবচেয়ে দুর্বল হয়ে গেছেন।

রাজনীতির এই পরিস্থিতি কি ইতিবাচক? যদি না হয় তাহলে এর পরিণতি কী হতে পারে? আর এই পরিস্থিতির কারণইবা কী? এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক শামীম রেজা। তিনি বলেন, বাংলাদেশে নানা রাজনৈতিক উত্থান পতনের পরও যারা পেশাদার রাজনীতিবিদ তাদের প্রাধান্য রাজনীতিতে ছিল। তবে গত দুই-তিনটি সংসদের দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখবো যারা দীর্ঘদিন রাজনীতিতে আছেন, তাদের জায়গায় অন্য পেশাজীবীরা চলে এসেছেন। আছেন আমলারা। তিনি আরো বলেন, দীর্ঘদিন ব্যবসা করে অল্প সময়ের মধ্যে রাজনীবিদ হওয়া, দীর্ঘদিন আমলা থেকে বা কোনো বাহিনীতিতে কাজ করে রাজনীতিতে অল্প সময়ে প্রভাবশালী হওয়া কোনো ভালো লক্ষণ না। রাজনীতিবিদরা যে রাজনীতি পরিচালনা করার কথা সেটা না থাকা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রত্যাশিত নয়। আমার মনে হয় এই প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে তা বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য খারাপ খবর।

সূত্রমতে, করোনার ছোবলে দেশের মানুষের দুরবস্থার পাশাপাশি রাজনীতিরও বিপন্ন দশা হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের পারস্পরিক আচার-আচরণ, কথাবার্তার মধ্যে রাজনীতি নেই। রয়েছে রাজনৈতিক দৈন্যতা। বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক, যিনি সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীও বটে, তিনি যেমন প্রতিদিন একই ধরনের বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে চলেছেন, তেমনি বিএনপির মতো বড় দলের মহাসচিবও কিছু ছকবাঁধা বক্তব্য উপস্থাপন করে চলেছেন। তাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে শুধু একে অপরের ওপর দোষারোপ এবং দোষারোপ খণ্ডন করা ছাড়া অন্য তেমন কিছুই থাকে না। দেশের মানুষকে এই করোনা-দুর্যোগের সময়ও যে সরকারি সেবা পেতে কোনো কোনো মন্ত্রণালয় বা অফিস-আদালতে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে, সেসব নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা আছে বলেও মনে হয় না। বরং সরকারি দপ্তর-অধিদপ্তর, অফিস-আদালত ইত্যাদি সবকিছু আমলাতন্ত্রের হাতে লিজ দিয়ে সরকারি দল যেমন বগল বাজাচ্ছে, বিরোধী দলও ঠিক তেমনি হেলতে দুলতে যতদিন চলে নীতি গ্রহণ করেছে। তারাও সরকারের বিভিন্ন অসামঞ্জস্য, সরকারি অফিসে ঘুষ-দুর্নীতি ইত্যাদি সরকারকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।

কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন বলেন, বর্তমান অবস্থায় সরকার অত্যন্ত বেশি আমলানির্ভর হয়ে পড়েছে। দেশে এক ধরনের রাজনৈতিক শূন্যতার কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। রাজনীতি সঠিক স্থানে না থাকার কারণে রাজনৈতিক নেতাদের অবস্থানও সঠিক স্থানে নেই। রাজনীতিবিদরা সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য পালন না করায় বা করতে না পারায় দেশে যে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, একশ্রেণির আমলা সেই শূন্যতারই যথেচ্ছ সুযোগ গ্রহণ করে চলেছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই একশ্রেণির সরকারি আমলা নিজেদের ব্যক্তিগত ফায়দা হাসিল করছেন। ফলে সরকারের একজন মন্ত্রীকেই জনসমক্ষে বলতে শোনা গেছে যে, বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের অধিকাংশই সরকারি চাকরিজীবী।

শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, ‘দেশে এখন রাজনীতি নেই’-এ সত্যটি প্রকাশ পেল সংসদ সদস্যদের বক্তব্য থেকে। সরকারের আমলানির্ভরতা নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির একাধিক সদস্য। তিনি বলেন, কেন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো সেটি তলিয়ে দেখা এ মুহূর্তের কর্তব্য। এ লক্ষ্য হতে পারে দুর্নীতি, হতে পারে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমন, আরও হতে পারে নির্বাচন জয়ে সহায়তা লাভ। রাজনীতির চরিত্র যদি এ রকম হয়, তাহলে রাজনীতিবিদরা আমলাদের হাতে বন্দি হয়ে পড়বেন এবং হয়ে পড়বেন তাদের ওপর নির্ভরশীল। এর ফলে দেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়। অদক্ষ আমলাদের হাতে পড়ে দেশীয় প্রশাসন জরাজীর্ণ হয়ে যায়। এসব আমলাও হয় দুর্নীতিপরায়ণ।

ঢাবির এ অধ্যাপক আরো বলেন, নির্বাচন দিনে দিনে কলুষিত হয়েছে। এই কলুষতার পরিমাণ যতই দিন যাচ্ছে, ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত আমরা শুনছি দিনের ভোট পূর্বদিনের রাত্রিতে হওয়ার কথা। এসব কারণে আমলাতন্ত্রের ওপর রাজনীতিবিদদের নির্ভরতা বেড়ে থাকতে পারে। এ অবস্থায় রাজনীতিবিদরা সংসদের মেঝেতে দাঁড়িয়ে আহাজারি করতে পারেন। কিন্তু এতে কোনো কাজ হবে না। এ দেশের জনগণ বহুবার প্রবঞ্চিত ও প্রতারিত হয়েছেন। এর অন্যতম কারণ হলো নিজ পছন্দমতো ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না পারা। এর মূলে রয়েছে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের অনৈতিকভাবে ক্ষমতা ধরে রাখার বাসনা।

উল্লেখ্য এ প্রসঙ্গে সংসদে তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ‘মাফ করবেন, কথা বলাটা কতটা যুক্তিসঙ্গত জানি না, এখন আমাদের জেলায় জেলায় দেয়া হয়েছে প্রশাসনিক কর্মকর্তা, মানুষ মনে করে আমরা যা দেই (ত্রাণ সহায়তা), এটি প্রশাসনিক কর্মকর্তারাই দেন। এর মাধ্যমে একটা রাজনৈতিক সরকার এবং রাজনীতিবিদদের যে কর্তৃত্ব, কাজ, সেটা কিন্তু ম্লান হয়ে যায়।’ ওই একই দিনে সংসদে কাজী ফিরোজ রশীদ বলেছেন, ‘এখন রাজনীতিবিদদের চেয়ে আমলাদের বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। দেশে কোনো রাজনীতি নেই। আওয়ামী লীগের বৃহস্পতি এখন তুঙ্গে, কারণ কোনো রাজনীতি নেই তো। রাজনীতির নামে এখন পালাগানের অনুষ্ঠান হয়। এই পালাগান চলছে ১০ বছর। রাজনীতিশূন্য, কোথাও রাজনীতি নেই।’

https://dailysangram.com/post/457533