৪ জুলাই ২০২১, রবিবার, ২:৫১

বাঁচার স্বপ্নটা যেন ফিকে হয়ে না যায়

দেখা অদেখা

স্রষ্টার এই সুন্দর পৃথিবীতে কে না বেশি দিন বেঁচে থাকতে চায়? কিন্তু পরিবেশ, পারিপার্শ্বিকতা, মহামারী ও অন্যান্য রোগশোক, প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর দরিদ্রতাÑ এসব অঘটন বহু মানুষকে বেশি দিন বেঁচে থাকার স্বপ্ন পূরণ হতে দেয় না। অপরিণত বয়সেই অনেককেই পৃথিবী মায়া ছাড়তে হয়। পৃথিবীর রূপ রস সৌন্দর্য আর স্রষ্টার অসংখ্য নেয়ামত, মানুষের স্নেহ মমতা স্বজন সুহৃদদের শুভেচ্ছা, পারিবারিক বন্ধনÑ সব ছিন্ন করে চলে যেতে হয়। ভাবুন না, মহামারী কোভিড বিশ্বকে দাপিয়ে নিয়ে কত লাখ মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে। কোটি কোটি মানুষ তাদের স্বজনদের হারানোর বেদনায় কাতর আর মুহ্যমান হয়ে আছে।

বিশ্বের ধনী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসাব্যবস্থা কত উন্নত তার পরও এই লেখা তৈরি করার সময়ে সেখানে কোভিডে ৬ লাখ ২০ হাজার ৬৪৮ জনের মৃত্যু ঘটেছে। এতে গড় আয়ুর ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের দেশে এ পর্যন্ত ১৪ হাজার ৭৭৮ জন কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।

দুই দেশেরই এ সংখ্যা সরকারের দেয়া। বাস্তবিক পক্ষে মৃত্যুর হার এসব সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি। কিছুটা ‘হাইড অ্যান্ড সিক’ করা হচ্ছে। অন্যান্য দেশেও কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মানুষের মৃত্যুর হার নিয়ে লুকোচুরি খেলা রয়েছে। তা ছাড়া গোটা বিশ্বে এখনো অসংখ্য মানুষ এই মহামারীর কবলে পড়ে চিকিৎসাধীন। আল্লাহ জানেন, তাদের কী পরিণতি হবে। তা ছাড়া কোভিড থেকে সেরে উঠে হাজার হাজার মানুষ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় নানা অসুবিধার মধ্যে রয়েছে, অনেকে মারাও যাচ্ছে।

পৃথিবীতে যারা অধিক হায়াতের প্রত্যাশী তাদের জন্য উল্লেখ করতে চাই যে, বিশ্বের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি আর আনুষঙ্গিক আরো কিছু কারণে বিশ্বজুড়ে মানুষের গড় হায়াত তুলনামূলকভাবে বেড়েছে। প্রাপ্ত এক তথ্যে জানা গেছে ১৯৫০ সালে বিশ্বব্যাপী মানুষের গড় আয়ু ছিল মাত্র ৪৬ বছর। আর ২০১৫ সালের মধ্যে এটি বেড়ে ৭১ বছরে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ুও এখন ৭২-এর কোঠায় এসে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণার খবর থেকে জানা গেছে, মানুষের যে মনোদৈহিক ব্যবস্থা তাতে মানুষের পক্ষে ১২০ বছর পর্যন্ত বাঁচা সম্ভব। আসলে সত্য কথা হচ্ছে, সে বাঁচাকে কি আর বাঁচা বলা যায়? এর বহু আগেই তো মানুষ এতটা বৃদ্ধ হয়ে যেতে পারে যে, তার বোধ বিবেচনা সুখ আনন্দের সব অনুভূতিই প্রায় নিঃশেষ হয়ে যায়। আর তখন সব ক্ষেত্রে পর নির্ভরশীলতা এতটা বেড়ে যায় যে, সব কিছু অর্থহীন মনে হতে পারে।
আর ১২০ বছর বয়স হলে পরিণতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা তো অনুমানই করা যায়। এমন চিন্তা থেকে বিরত থাকাই ভালো।

ফিরে যাই মূল কথায়। মানুষ স্রষ্টার দেয়া জ্ঞান-গরিমাকে পুঁজি করে সাধনা গবেষণা করে সেই জ্ঞান গবেষণার সফলতায় পরিবেশ পারিপার্শি¦কতা রোগ শোক আর দরিদ্রতাকে হটানোর জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞ যে, তার দেয়া জ্ঞান বুদ্ধি আর ব্যুৎপত্তি মানুষকে সে যুদ্ধে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায় অনেক সাফল্য এনে দিয়েছে। কিছুকাল আগে মানুষের গড় আয়ু যেখানে ছিল তা এখন অনেক বেড়েছে। রোগ শোক থেকে মুক্তি পেতে বহু জীবন রক্ষাকারী ওষুধপত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সতর্ক থাকতে পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব হচ্ছে। দারিদ্র্য হটানোর চেষ্টা করে বহু দেশ সফল। অভাব-অনটন থেকে মুক্তি পেতে অন্যান্য দেশও এ চেষ্টায় এগিয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা মানব কল্যাণে তাদের গবেষণালব্ধ জ্ঞান বিশ্ববাসীর কল্যাণের জন্য অন্যের সাথে শেয়ার করছেন। এমন উন্নতি অগ্রগতির সাধনা থেমে নেই। তবে এসব গড় কথা। সব মানুষের জন্য তা প্রযোজ্য নয়। চরম দারিদ্র্যপীড়িত দেশের সংখ্যা কম নয়। এসব দেশের পক্ষে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত হতে জ্ঞান বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি থেকে সুফল তোলার সাধ্যও রয়েছে অনেক সীমাবদ্ধতা। এই দেশগুলোর নাগরিকদের এসব কারণে তাদের গড় আয়ু বরং কমছে। পরিবেশের অবনতি, চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগের মারাত্মক সীমাবদ্ধতা, প্রকৃতিক নানা দুর্যোগ, অর্থনৈতিক সঙ্কট ও পুষ্টিহীনতা সেখানে প্রকট। এসব অঞ্চলে শিশু মৃত্যুর হার অনেক। তাই মানুষের গড় আয়ুতে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ক্রমাগত পড়ছে।

পৃথিবীর শিল্পোন্নত সাত জাতির ফোরামের সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সম্মেলনে এই মর্মে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, ভবিষ্যতে আর কোনো মহামারী দেখা দিলে তার মোকাবেলা যাতে ১০০ দিনের মধ্যে করা যায়। তার প্রস্তুতি তারা এখন নিয়ে রাখবেন। তাদের এই শুভ চিন্তাকে স্রষ্টা যেন মদদ দেন সে কামনা করছি। সে প্রস্তুতির শেয়ার সবার সাথে করবেন কি না আল্লাহ মালুম।

এসব কিছু আয়োজন করার আর্থিক সঙ্গতি, মানবিক যোগ্যতা, গবেষণা করার মতো প্রতিষ্ঠান, আর উচ্চমানসম্পন্ন গবেষকদের অভাব তো আমাদের দেশে রয়েছে। কিন্তু ঘাটতির কথা ভেবে হতাশ ও স্থবির হয়ে থাকলে চলবে না। এই দেশের স্থপতি স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে এক ঐতিহাসিক জনসমাবেশে যে উদ্দীপনাময় বক্তৃতা করেছিলেন তার একপর্যায়ে বলেছিলেন, ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে তা নিয়ে প্রস্তুত হও।’ এ কথাকে প্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করে যতটুকু সঙ্গতি আমাদের রয়েছে, তাকেই জড়ো করে সুদূরপ্রসারী চিন্তা নিয়ে ধীর ও দৃঢ় পদে এগোতে হবে। শুধু পর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকার চিন্তাটা বাদ দিতে হবে। একটা প্রবাদ আছে, ‘পরের আশা যে করে, নিত্য উপস করে সে।’ পরমুখাপেক্ষিতার যে তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের কোভিডের টিকা সংগ্রহ করা নিয়ে শিক্ষা হয়েছে, তা যেন আমাদের আজীবন শিক্ষা হয়ে থাকে। তা ছাড়া জরুরি কোনো বিষয় মোকাবেলার ক্ষেত্রে বিকল্পের চিন্তা কতটা জরুরি তা-ও বুঝতে হবে।

এই প্রবন্ধের সূচনা, সেই কথা থেকেই উৎসারিত, স্রষ্টার এই সুন্দর পৃথিবীতে কে না বেশি দিন বাঁচতে চায়। প্রকৃতপক্ষে বেশি সময় বাঁচার জন্য সুস্বাস্থ্যের বিষয়টি সর্বাগ্রে বিবেচনায় রাখতে হবে। কথায় বলে ‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল।’ এ জন্য কিছু লক্ষ্য নির্ধারণ করে তা নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। বিশেষজ্ঞরা সেই লক্ষ্যগুলো এভাবে সাজাতে চান, সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবা, মানুষকে আপৎকালীন চিকিৎসা ও সুরক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করা, ভালোভাবে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ ইত্যাদি। জানি, আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা অত্যন্ত ভঙ্গুর সে কথা পরে বলব। তারপর কোভিড মহামারী আমাদের স্বাস্থ্য আর চিকিৎসা সংক্রান্ত অনেক দুর্বলতাকে চিহ্নিত করে দিয়েছে। এসব আমলে নিতে হবে। সেই সাথে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসংক্রান্ত যে লক্ষ্যগুলোর কথা উল্লেখ করা হয়েছে, এসবের গুরুত্ব দিয়ে আমাদের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক চিন্তাভাবনাকে শাণিত আর সুবিন্যস্ত করা দরকার। রোগা ও হীনবল জনশক্তি নিয়ে শুধু আমরা নয় কোনো জাতির পক্ষেই সমৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়। চিকিৎসাব্যবস্থাকে সর্বজনীন করা তথা সবাই যাতে সে সুযোগ গ্রহণ করতে পারে সে ব্যবস্থা নেয়া উচিত কেননা কোনো রোগ এক দিনে দুরারোগ্য হয়ে উঠে না। প্রথমে সাধারণ চিকিৎসা পেলে তা দুরারোগ্য হয়ে উঠতে পারে না বা এতে দেরি হয়। সাম্প্রতিককালের নানা উৎস থেকে জানা যায় যে, দেশে দুরারোগ্য ব্যাধি নিয়ে বহু মানুষ মারাত্মক কষ্টের মধ্যে জীবন যাপন করছে। যেহেতু দেশের অধিকাংশ মানুষের আয় রোজগার কম, কোভিড তা আরো কমিয়ে দিয়েছে। ফলে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত সাধারণ মানুষ বলতে গেলে কোনো চিকিৎসাই নিতে পারছে না। অথচ দেশের মৌলিক লক্ষ্যগুলোর মধ্যে সবার জন্য চিকিৎসার সুযোগ সৃষ্টি করার ব্যবস্থাটা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

হীনবল মানুষের কথা বলা হয়েছে। আসলে পুষ্টির অভাবেই মানুষ হীন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ অপুষ্টিজনিত গুরুতর সমস্যার মধ্যে আছে। এক তথ্যে জানা যায়, বর্তমানে মাথাপিছু মানুষের খাদ্য গ্রহণের হার ১৮৫০ কিলো গ্রাম। ক্যালরি গ্রহণের ক্ষেত্রে তা কোনো মানের পর্যায়ে পড়ে না বলে পুষ্টিবিদদের অভিমত। দারিদ্র্যের কশাঘাত, অসম খাদ্য, নানান রোগ, নিরক্ষতা, দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, পরিবেশগত ঝুঁকি, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অবিচার তথা বৈষম্যের ফলে ব্যাপক অপুষ্টি ঘটছে দেশে। বিশেষ করে ভূমিহীন কৃষক ও তাদের পরিবার এবং নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে পুষ্টিহীনতা প্রবল। এসব মানুষের অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস পুষ্টিহীনতাকে বৃদ্ধি করে চলেছে। অপুষ্টিতে আক্রান্ত মা যে শিশুর জন্ম দেন, তার বেড়ে উঠতে ও স্বাস্থ্যবান কিশোরে পরিণত হতে বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হয়। এসব কিশোরকে শারীরিক বিকাশের সমস্যা, কম ওজন, রক্তশূন্যতা, রাতকানা এবং আয়োডিনের অভাবজনিত রোগে ভুগতে হচ্ছে। এর ফলস্বরূপ বাংলাদেশে রয়েছে শিশু মৃত্যুর উচ্চ হার। অথচ এটা বিশ্বজনীন ধারণা যে, প্রতিটি শিশু জনগ্রহণ করে পরিণত বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকার অধিকার নিয়ে। এই অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে তার দায় সরকারি কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে। শিশুদের অপুষ্টির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকা দেশগুলোর অন্যতম। ৫ বছরের নিচের শিশুদের দুই-তৃতীয়াংশ অপুষ্টিতে ভোগে; ৬ বছরের নিচে ৬০ শতাংশ শারীরিক বিকাশে বাধাগ্রস্ত হয়। কিছুকাল আগের এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে, গ্রামীণ এলাকার ৪৫ শতাংশ এবং শহর এলাকায় ৭৬ শতাংশ নিম্ন আয়ের পরিবার নির্দিষ্ট ক্যালরি গ্রহণের মাত্রা থেকে অনেক কম হারে ক্যালরি গ্রহণ করছে।

বাংলাদেশের বেশির ভাগ ভূখণ্ড নিচু ও বন্যাপ্রবণ। দেশের জনসংখ্যার অধিকাংশই এমন অঞ্চলে বাস করে, যেখানে বার্ষিক চরম বন্যায় বিপুল পরিমাণে ফসল নষ্ট হয়ে যায়। প্রতি বছর দেশে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ অঞ্চল প্লাবিত হয়। বন্যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকি এবং এর প্রভাবে কৃষি উৎপাদনে মারাত্মক ঘাটতি দেখা দেয়। গ্রামাঞ্চলের মানুষ চরম সঙ্কটে পড়ে। বসতবাটি বন্যায় এতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় যে, তাদের তখন সড়কে এসে ঠাঁই নিতে হয়। বন্যার পানি নেমে গেলে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত বসতবাটি মেরামতের জন্য হাজার হাজার টাকার প্রয়োজন যা সবার পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব হয় না। বন্যায় গ্রামাঞ্চলের মানুষকে শুধু খাদ্যসঙ্কটেই পড়তে হয় এমন নয়। বন্যায় খাদ্যশস্যের মূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি শাকসবজির দামও আকাশচুম্বী হয়ে পড়ে। নিম্ন আয়ের মানুষ তো বটেই, মধ্যবিত্তের মানুষকে পর্যন্ত সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তখন তাদের খাদ্যগ্রহণের ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রতা অবলম্বন করতে হয় বলে শরীরে পুুষ্টির কমতি ঘটে। বন্যা হওয়ার অন্যতম কারণ বিভিন্ন স্থানে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য যে বাঁধ তৈরি করা হয় তার অবস্থা এতটা দুর্বল যে, বন্যার তোড় রুখতে সে বাঁধ ব্যর্থ হয়। তদুপরি ফসলহানি, শাকসবজির বাগান ধ্বংস হয়। সে সাথে অসংখ্য মাছের ঘের বিধ্বস্ত হয়ে কোটি কোটি টাকার মাছ ভেসে যায়। এর পরিণতি হচ্ছে বহু মানুষের চরম আর্থিক সঙ্কটে পতিত হওয়া।

বিশ্বের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যাগুলোর তালিকায় প্রথমে রাখা হয়েছে বায়ু দূষণকে। ‘হু’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতিদিন বিশ্ববাসীর প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জন দূষিত বায়ু শ্বাসের সাথে গ্রহণ করছে। বায়ুদূষণই স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সব থেকে বড় পরিবেশগত ঝুঁকি। বাতাসের আণুুবীক্ষণিক দূষিত বালুকণা শ্বাসযন্ত্র এবং সংবহন তন্ত্রে আক্রমণ করে। ক্ষতি হয় ফুসফুস, হৃদযন্ত্র এবং মস্তিষ্কের। এখানে উল্লেখ করতে হয়, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বায়ুদূষণে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি দূষিত শহরগুলোর অন্যতম। বিশ্বে প্রতি বছর ৭০ লাখ মানুষ মারা যায় ক্যান্সার, স্ট্রোক, হৃদযন্ত্র এবং ফুসফুসের রোগে। মৃতদের ৯০ শতাংশই নিম্ন এবং মধ্য আয়ের দেশগুলোর নাগরিক। শিল্প পরিবহন এবং কৃষি ক্ষেত্রে দূষণ এই রোগ সৃষ্টির বড় কারণ। আবার গৃহস্থালির নোংরা রান্নার স্টোভের জ্বালানি বহু রোগ সৃষ্টি করে। বায়ু দূষণের প্রাথমিক কারণগুলোই বস্তুত জলবায়ু পরিবর্তনের পথ করে দেয়। এই পরিবর্তনও বিভিন্নভাবে স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে চলেছে।

বাংলাদেশ বায়ুদূষণ আর জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রতিক্রিয়ার শিকার হলেও এ নিয়ে কর্তৃপক্ষীয় পর্যায়ে তেমন কোনো উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বা কোনো ব্যবস্থা নেয়ার কার্যক্রম নেই বললেই চলে। দেশে পরিবেশসংক্রান্ত বিষয় দেখা এবং তার প্রতিবিধানের জন্য একটি স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় রয়েছে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে তাদের ক্রিয়াকর্ম আছে বলে অনুধাবন করা যায় না। পরিবেশ নিয়ে বিশ্বব্যাপী অ্যাক্টিভিস্টদের তৎপরতা এখন অত্যন্ত জোরদার। তাদের তৎপরতা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে সরকারি পর্যায়ে পরিবেশ রক্ষার কার্যক্রমকে আরো গতিশীল করে তুলছে। তাছাড়া সম্প্রতি বিশ্বে শিল্পোন্নত ধনী দেশগুলোর সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের পরিবেশ নিয়ে কার্যক্রম বহুগুণে বেড়েছে। তারা এ জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করতে যাচ্ছেন। আমাদের দেশে পরিবেশ নিয়ে ভাবেন এবং জাতি ও কর্তৃপক্ষকে সজাগ করার জন্য বক্তব্য দানসহ নানা কর্মসূচি পালন করে থাকেন যারা তাদের এসব প্রয়াস যেন ‘সকলই গরল ভেল’। কেননা এসব সতর্কবার্তা কারো কর্ণকুহরে পৌঁছে না। অথচ দেশের পরিবেশগত বিপর্যয় এতটা ভয়াবহ যে, কোটি কোটি মানুষের জীবন যখন বিপন্ন হয়ে উঠবে তখন আক্ষেপ করে কোনো ফায়দা হয় না। মাত্র কিছু দিন আগে একটি জাতীয় দৈনিকের প্রধান খবর ছিল, কিছুকালের মধ্যেই ঢাকাসহ দেশে কয়েকটি বড় শহর মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়তে পারে এবং সে শহরগুলো পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে হবে। যেসব কারণে এমন বিপর্যয় ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে তার অন্যতম হচ্ছে পরিবেশজনিত সমস্যা। খোদা না করুন, এমন আশঙ্কা যদি ফলে যায় তবে তা কি দেশের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে না? এসব নগর ছেড়ে কোটি কোটি মানুষ কোথায় গিয়ে আশ্রয় নেবে? ৫৫ হাজার বর্গমাইলের দেশে নতুন বসতি করা আর সম্ভব নয়। এর আগে বলে এসেছি দেশের ভঙ্গুর চিকিৎসাব্যবস্থার কথা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক জরিপ প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, দেশের সরকারি হাসপাতালে প্রতি এক হাজার মানুষের জন্য শয্যাসংখ্যা মাত্র ০.৩২। বেসরকারি হাসপাতালে প্রতি হাজারে শয্যাসংখ্যা ০.৬৪। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে প্রতি এক হাজার মানুষের জন্য শয্যার সংখ্যা মাত্র ০.৯৬। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ হচ্ছে প্রতি হাজার মানুষের বিপরীতে সাড়ে তিনটি শয্যা থাকতে হবে। সেই হিসাবে আন্তর্জাতিকমানের চেয়ে দেশের সরকারি বেসরকারি হাসপাতালগুলোর শয্যার সংখ্যা অনেক নিচে। দেশের ১৬ কোটিরও বেশি মানুষের চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ কত নাজুক পর্যায়ে রয়েছে এই পরিসংখ্যান তা প্রমাণ করে দিচ্ছে। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার ক্ষেত্রে রোগীদের যে তিক্ত অভিজ্ঞতা তা সবার কাছেই পরিষ্কার। আর বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ নেয়ার মতো আর্থিক সঙ্গতি ক’জন মানুষের রয়েছে? দেশের অসংখ্য মানুষ নানা রোগ শোকে বিপর্যস্ত। তাদের সুচিকিৎসা পাওয়াটা জরুরি। অথচ দেশে চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ খুব কম। এর পরিণতিতে জাতি হিসেবে আমরা হীনবল হয়ে পড়ছি। এমন জনশক্তির উপর নির্ভর করে আমাদের দেশের পক্ষে বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখা অলীকই হবে। ‘স্বাস্থ্য সকল সুখের মূল’ এ কথা না ভেবে এখন হয়তো বলতে হবে, অসুখই আমাদের সকল দুখের মূল। কিন্তু এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় আমাদের হর্তাকর্তারা দেখাতে পারছেন না। দীর্ঘদিন বাঁচার যে স্বপ্নের কথা বলা হয়েছে সেটা বোধ হয় এ দেশের মানুষের পক্ষে বিবেচনায় নেয়া সম্ভব নয়।

স্বাস্থ্যসংক্রান্ত আর একটি স্পর্শকাতর বিষয়ের উল্লেখ করতে চাই। আপনাদের নিশ্চয় স্মরণ রয়েছে কোভিডের পরীক্ষা নিয়ে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে এক মহিলা চিকিৎসক ভুয়া টেস্ট রিপোর্ট দিয়ে প্রচুর অর্থ কামিয়েছেন। তাছাড়া দেশে এমন কিছু ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে যাদের মান গুণ ধর্তব্যের মধ্যে আসে না। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয়, মুষ্টিমেয় কিছু চিকিৎসক সেখানে রোগ নির্ণয়ের জন্য রোগীদের পাঠান। অভিযোগ আছে, সেসব সেন্টারের সাথে কিছু চিকিৎসকের ‘আনহোলি’ রিলেশনের কারণে সেখানে পরীক্ষার জন্য রোগীদের পাঠিয়ে থাকেন। আর কিছু সেন্টারে রোগীদের কাছ থেকে গলাকাটা চার্জ নেয়া হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের কারণে উচ্চমানসম্পন্ন এবং যৌক্তিক চার্জ নিয়ে পরীক্ষা সম্পন্ন করে থাকে এমন সব প্রতিষ্ঠানকে কখনো কখনো বিব্রত হতে হয়। যেসব প্রতিষ্ঠানের মান ধর্তব্যের মধ্যে নেই, সেখানে পরীক্ষা করিয়ে রোগীরা শুধু প্রতারিতই হয় না। সেই সব সেন্টারে করোনো টেস্টের ভিত্তিতে চিকিৎসা নেয়া হলে ভয়াবহ বিপদের আশঙ্কা থাকে।

বাংলাদেশে চিকিৎসক তৈরির জন্য যতগুলো কলেজ রয়েছে তার সংখ্যা জানলে অবশ্যই আশান্বিত হওয়ার কথা। কেননা দেশে চিকিৎসকের সংখ্যা জনসংখ্যার অনুপাতে অনেক কম। এখন দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা ১০৪। এর মধ্যে সরকারি মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা ৩৭ আর বেসরকারি কলেজের সংখ্যা ৬৭। ঢাকা বিভাগে সরকারি মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা ১০, খুলনায় ৫, চট্টগ্রামে ৬, বরিশালে ২, রাজশাহীতে ৫, রংপুরে ৩, সিলেটে ৩ এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৩টি। বিভিন্ন বিভাগে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা ৬৭টি। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৩৫, চট্টগ্রামে ৮, খুলনায় ৪, সিলেটে ৫, রাজশাহীতে ৬, রংপুরে ৬ এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ৩টি।

এতগুলো মেডিক্যাল কলেজ দেশে রয়েছে, তা অবশ্যই তৃপ্তির কারণ বটে। বিষয়টি স্পর্শকাতর হলেও প্রশ্ন জাগে, এতগুলো কলেজের জন্য উচ্চমানের ও যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক কি সব কলেজে রয়েছে? চিকিৎসা শাস্ত্র অত্যন্ত কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ। এর সাথে মানুষের স্বাস্থ্যের সম্পর্কই শুধু নয়, মানুষের জীবন রক্ষার প্রশ্নও জড়িত। উচ্চমানসম্পন্ন শিক্ষক ব্যতিরেকে মেডিক্যল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা সুশিক্ষিত হতে পারবে কি? আমাদের এত মেডিক্যাল কলেজের প্রয়োজন নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই, তবে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ভালো চিকিৎসক বের হবে এটা অবশ্যই পূর্বশর্ত হওয়া উচিত। এটা আনন্দ ও গর্বের কথা, আমাদের দেশে এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বহু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন যারা জটিল আর দুরারোগ্য অসুখের চিকিৎসা দিয়ে সফল এবং অপারেশনে পারদর্শী। তারা আরো দক্ষতা দেখাতে সক্ষম হতেন। যদি তাদের হাতে সর্বাধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম থাকত তবে তা হতো অসাধারণ ব্যাপার। এই সঙ্কট দূর করতে সরকারের এগিয়ে এসে সহায়তা করা জরুরি। সে সব সরঞ্জাম দেশে থাকলে তাতে শুধু চিকিৎসকদের দক্ষতা সক্ষমতা বৃদ্ধি পেত না এবং রোগী উপকৃত হতো না, স্বয়ং রাষ্ট্রও উপকৃত হতো। কারণ এখন বহু লোক উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যায়। এ বাবদ বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। দেশেই উন্নত চিকিৎসা পাওয়ার অবস্ট্রাকল দূর হলে অনেক ইতিবাচক অবস্থার সৃষ্টি হতো। অর্থাৎ মানুষকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বাইরে যাওয়ার দরকার হতো না।

মেডিক্যাল কলেজগুলোর শিক্ষার মান নিয়ে সরকারের মনিটরিংয়ের উন্নয়নের ব্যবস্থা থাকা দরকার যাতে যেখানে যতটুকু ঘাটতি রয়েছে তা পরিশুদ্ধ করে তুলতে সহায়তা দেয়ার সুযোগ হয়। কেননা সে সব প্রতিষ্ঠানের উন্নতির সাথে দেশের মানুষের সুস্বাস্থ্যের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানুষের চিকিৎসা পাওয়া যে মৌলিক অধিকার তার সহায়তা হতো। যোগ্য চিকিৎসক না হলে উত্তম চিকিৎসা হবে কিভাবে?

ndigantababor@gmail.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/592568/