রাজনীতিবিদরা বলেন এবং শিক্ষাবিদরাও বলেন যে, ইতিহাস কোন দিন চেপে রাখা যায় না। ইতিহাস বলতে তারা সত্য ঘটনা, অর্থাৎ সত্য ইতিহাসকেই বোঝাতে চান। সাজানো ইতিহাস নয় বা বিকৃত ইতিহাসও নয়। কিন্তু ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বা ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ কিছু ইতিহাস চেপে রাখা হয়েছে এবং আজও তা চেপেই থেকে যাচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজ করুক এটা সকল নাগরিকই চান। এবং বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির রোল মডেল। কিন্তু একটি মুখচেনা গোষ্ঠীকে দেখা যায়, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে ৪৭ এর আগে বাংলাসহ সমস্ত ভারতে যে মুসলমানদের বঞ্চিত করেছে সেই জলজ্যান্ত সত্যও আড়াল করতে চান। হিন্দুরা যে বৃটিশদের সাথে কোলাবোরেট করে মুসলমানদের দাবিয়ে রেখেছে সেই কঠোর বাস্তবতাকেও তারা লুকিয়ে রাখার প্রচেষ্টায় রত এবং উল্টো তারা উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপাতে চান। বলতে চায় যে, মুসলমানরা নাকি ইংরেজদের সাথে সহযোগিতা করেছে। বলতে চায় যে বৃটিশ শাসন চক্রান্তেই নাকি ভারত ভাগ হয়েছে। বলে যে বৃটিশরা Divide and Rule করে ভারত শাসন দীর্ঘায়িত করেছে এবং এই বিভাজন নীতিতে নাকি মুসলমানরা সহযোগিতা করেছে। এই ধরনের প্রচারণা তারা সুপরিকল্পিত এবং সুসংবদ্ধ ও ব্যাপকভাবে করছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল এই যে, এই ধরনের ভিত্তিহীন ও বানোয়াট প্রচারণার দাঁত ভাঙা জবাব হিসাবে যে প্রকৃত তথ্য ও ইতিহাস জোরেশোরে তুলে ধরার প্রয়োজন ছিল সেটা সত্যন্বেষীরা করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
যারা বানোয়াট ইতিহাস প্রচার করছেন তারা তাদের বক্তব্যকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য দুই এক ব্যক্তিকে ইতিহাসবিদ হিসাবে দাঁড় করাচ্ছেন এবং ঐসব ইতিহাসবিদদের (?) পুস্তক থেকে অনেক উদ্ধৃতি দিচ্ছেন। কিন্তু যারা রেকর্ডকে তার সঠিক স্থানে উপস্থাপন করতে চান। (Put the record Straight) তারা মিডিয়া জগতে বলতে গেলে অনুপস্থিত এবং প্রকাশনা জগতেও তাদের বিচরণ গতিশীল নয়। ফলে বানোয়াট ইতিহাসের দাপটে সঠিক ইতিহাস চাপা পড়ে যাচ্ছে।
এসব কথা মনে ইচ্ছে আজ বৃহস্পতিবার ১ জুলাই যখন লেখার জন্য কলম ধরেছি। পহেলা জুলাই ২০২১, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ১০০ বৎসর পূর্তি হচ্ছে। মেইনষ্ট্রিম মিডিয়া বলে যাদেরকে হামেশা বলা হয় সেই সব প্রিন্ট এবং অনলাইন মিডিয়ায় বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ মিডিয়ায় রয়েছে শুধু একটি বিশেষ সময়ের কথা। যেমন মিঃ জিন্নার সভায় উর্দু সম্পর্কে তার বক্তব্যের প্রতিবাদ, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন ইত্যাদি। আন্দোলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবশ্যই গৌরবোজ্জ্বল দিক। কিন্তু এসব রাজনৈতিক আন্দোলনই কি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখ করার মত গৌরবোজ্জ্বল দিক?
॥ দুই ॥
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গর্ব করার মত যে দিক সেই লেখাপড়া তথা একাডেমিক দিকটা কি? সাম্প্রতিক অতীতে গর্ব করার মত কি আছে? আমরা এক সময় গর্ব করে বলতাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড। পৃথিবীর প্রথম সারির বিশ্ববিদালয়গুলির মধ্যে ঢাবি’র অবস্থা কি? আমি নিজে ঢাবি’ র ছাত্র ছিলাম। তাই গভীর মর্মবেদনার সাথে বলছি যে, ওয়ার্ল্ড র্যাংকিং এ, অর্থাৎ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০০ (এক হাজার) বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকাতেও ঢাবি’র কোনো স্থান নাই। বরং যতই দিন যাচ্ছে ততই এর স্থান নীচে চলে যাচ্ছে। লন্ডনভিত্তিক শিক্ষা বিষয়ক সাময়িকী ‘টাইমস্্ হায়ার এডুকেশন’ প্রতি বছর বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে র্যাংকিং প্রকাশ করে তাতে ঢাবি’র অবস্থান এক হাজারের পরে। এই তালিকায় বিশ্বের ৯৩টি দেশের ১৩০০ (তেরোশত) বিশ্ববিদ্যালয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশের যতগুলি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে তার মধ্যে শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই এই তালিকায় স্থান পেয়েছে। শিক্ষার পরিবেশ, গবেষণার সংখ্যা ও সুনাম সাইটেশন বা গবেষণার উদ্ধৃতি, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বা সংশ্লিষ্টতাসহ ৫টি মানদণ্ড বিশ্লেষণ করে এই তালিকা তৈরি করা হয়েছে। র্যাংকিং-এ বিদেশী ছাত্রের ক্ষেত্রে পেয়েছে শূন্য। ৪০১০৮ জন ছাত্রের মধ্যে সম্ভবত: কোনো বিদেশী ছাত্র নাই। এবং থাকলেও তাদের সংখ্যা উল্লেখ করার মত নয়। সবচেয়ে আতঙ্কজনক দিক হচ্ছে এই যে যতই দিন যাচ্ছে ততই র্যাংকিং নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে। যথা ২০১৬ সালে এই অবস্থান ছিল ৬০০ থেকে ৮০০ এর মধ্যে। অথচ এর মাত্র ২ বছর পর ২০১৮ সালে এর র্যাংকিং দাঁড়ায় ১০০০ (এক হাজার) এর পরে। একই বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালের মে মাসে বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়। সেই তালিকায় শুধুমাত্র এশিয়ার ৪১৭ টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পায়। কিন্তু সেখানেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ছিল না।
এই সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষার মান ও গবেষণার সুযোগ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। এই আলোচনার প্রায় পুরোটাই ছিল নেতিবাচক। টাইমস হায়ার এডুকেশনে রেখাচিত্রও প্রকাশ করা হয়। এই রেখাচিত্রে দেখা যায় যে, ২০১৫ ইং সালের পর থেকে বাংলাদেশের রেখাচিত্র ক্রমান্বয়ে অবনতিশীল। পাশাপাশি উপমহাদেশের ভারত এবং পাকিস্তানের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, তারা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক ভাল করেছে।
আলোচ্য তালিকায় দেখা যায় যে, ১০০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ভারতের রয়েছে ৩৬ টি বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে ইন্ডিয়ান ইনষ্টিটিউট এর টেকনোলজির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সন্ত্রাসী তৎপরতা পাকিস্তানকে অস্থিতিশীল করে তুললেও টাইমস হায়ার এডুকেশনের জরিপ মোতাবেক এবং বিবিসি বাংলাদেশের ভাষ্য মোতাবেক বাংলাদেশের চেয়ে পাকিস্তানের অবস্থান ভাল তালিকায় বিধৃত ১০০০ ভার্সিটির মধ্যে পাকিস্তানের রয়েছে ৭টি বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে প্রথম ৫০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে কায়েদে আজম ইউনিভার্সিটি। মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় ক্ষতবিক্ষত ইরানেও একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে এই তালিকায়। বরাবরের মত বিলাতের ৩টি বিশ্ববিদ্যালয় শ্রেষ্ঠত্বের আসনের রয়েছে। এগুলো, অক্সফোর্ড, কেম্ব্রিজ এবং লন্ডন ইউনিভার্সিটি।
॥ তিন ॥
টাইমস হায়ার এডুকেশনের এই জরিপ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কিছু শেখার আছে। অক্সফোর্ডের ভিসি বলেন যে অক্সফোর্ডের সফলতার পেছনে একটি বড় কারণ হল বিশ্বের অনেক প্রখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তাদের সহযোগিতা রয়েছে। পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে তাদের জ্ঞানের আদান প্রদান ঘটে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশ, যারা করোনা প্রতিরোধী এ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নিয়েছেন, সেই টিকার উদ্ভাবক এবং আবিষ্কারক হল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছিয়ে থাকার অন্যতম প্রধান কারণ হল মৌলিক গবেষণার অভাব। তার মতে বিশ্ববিদ্যালয়টি আকারে অনেক বড় হয়েছে, কিন্তু শিক্ষা ও গবেষণার মান উন্নয়নে ব্যর্থ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা ও প্রকাশনায় কদাচিৎ উৎসাহ প্রদান করা হয়। তিনি বলেন, জ্ঞানের নতুন দিগন্ত উন্মোচনের পরিবর্তে শিক্ষকরা ননএকাডেমিক তৎপরতা, বিশেষ করে রাজনীতিতে বেশি ব্যস্ত থাকেন। প্রকাশনার ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চরম উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায়। ২০১৭ ও ২০১৮ সালে মাত্র একটি প্রকাশনা রয়েছে। ২০১৯ সালে ৪টি।
॥ চার ॥
শুরুতে বলেছিলাম যে সঠিক ইতিহাস তথাকথিত মুক্তমনা এবং প্রগতিশীলরা চেপে রাখেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পটভূমি সম্পর্কে একথা চরম সত্য। রাজনৈতিক সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাদপদ মুসলমানদের ভাগ্য উন্নয়ের জন্য ১৯০৫ সালে বঙ্গ প্রদেশকে ভাগ করে পূর্ববঙ্গ ও আসামকে নিয়ে বঙ্গাসাম নামে একটি নতুন প্রদেশ গঠন করা হয় এবং ঢাকাকে নতুন প্রদেশের রাজধানী করা হয়। এটি সকলেই জানেন। ৬ বছর পর হিন্দুদের আন্দোলন এবং মাষ্টারদা সূর্য্যসেনদের সন্ত্রাসী তৎপরতায় বঙ্গভঙ্গ রদ হয়। একই সাথে ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লীতে স্থানান্তর করা হয়। ফলে মুসলমানরা যে তিমিরে ছিলেন সেই তিমিরেই নিক্ষিপ্ত হন।
নাকের বদলে নরুন দেয়ার মত বঙ্গভঙ্গ রদ করে ঢাকাকে রাজধানী করার পরিবর্তে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন বৃটিশ ভাইসরয় (বড়লাট) লর্ড হার্ডিঞ্জের এটি ১৯১২ সালের ঘটনা। বড়লাট ঢাকা সফরে আসার পরে বৈঠক করেন ১৯ সদস্যের এক মুসলিম প্রতিনিধি দলের সাথে। প্রতিনিধি দলে ছিলেন ঢাকার নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ্্, টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীর জমিদার নওয়াব আলী চৌধুরী, একে ফজলুল হক (পরবর্তীতে শেরে বাংলা) প্রমুখ।
লর্ড হার্ডিঞ্জের এই প্রস্তাবের পর হিন্দুরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এ বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেন হিন্দু মহাসভার প্রধান নেতা শামা প্রসাদ মুখার্জীর পুত্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখার্জী, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সহযোগী প্রতিষ্ঠাতা স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী প্রমুখ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতাকারীদের তালিকায় রবীন্দ্রনাথের নামও উচ্চারিত হয়। তবে এ ব্যাপারে বিতর্ক রয়েছে।
যাই হোক, এসব বাধা উপেক্ষা করে ১৯২১ সালের ১লা জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। এটি প্রতিষ্ঠায় নীলক্ষেত ও শাহবাগের এলাকা জুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের যত স্থাপনা রয়েছে তার সমুদয় জমি দান করেন নওয়াব সলিমুল্লাহ্। এছাড়াও নওয়াব আলী চৌধুরী ও একে ফজলুল হকের তৎপরতা ও অবদান ছিল বিশাল।
অথচ আজ একশত বছর পূর্তিতে বাংলাদেশের বাম ও সেক্যুলার মহল এবং তাদের পন্থী মিডিয়া এই তিন মনীষীর অবদানকে সুচতুরভাবে, সুপরিকল্পিতভাবে ভুলিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা করছেন।
Email: journalist15@gmail.com