৩ জুলাই ২০২১, শনিবার, ২:৩৬

বৃষ্টি আর লকডাউনে ঘরবন্দী মানুষ

বিভিন্ন স্থানে আইন ভঙ্গকারীদের সাজা; রাজধানীতে ৩২০ জন আটক

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সরকারের দেয়া কঠোর লকডাউনের দ্বিতীয় দিনে গতকাল শুক্রবার রাজধানীর প্রধান সড়কগুলো ছিল অনেকটাই ফাঁকা। লকডাউনের সাথে দিনভর বৃষ্টি থাকায় বেশির ভাগ মানুষ ছিলেন ঘরবন্দী। তা ছাড়া শুক্রবার থাকায় লকডাউনের আওতামুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল বন্ধ। যার কারণে সড়কগুলোতে মানুষ ও যানবাহনের চাপ ছিল কম। তারপরও প্রথম দিনের মতোই দ্বিতীয় দিনেও পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা মাঠে তৎপর ছিলেন। তারা রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে টহল দিয়েছেন। মোড়ে মোড়ে পুলিশি চেকপোস্টে বাধার মুখে পড়তে হয়েছে অনেককেই। তবে নানা প্রয়োজন দেখিয়ে আগের মতোই পাড়া-মহল্লায় ছিল মানুষের ভিড়। নিত্যপণ্য ক্রয়, চা-সিগারেট পান, ব্যক্তিগত (চুল-দাড়ি কাটানো) কাজ সম্পন্ন করতে বের হয়েছিলেন তারা। ডিএমপি জানিয়েছে, বিনা কারণে রাস্তায় বের হওয়ায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ৩২০ জনকে আটক করা হয়েছে। কয়েকটি এলাকায় বিভিন্ন যানবাহনকে মামলা দেয়া হয়েছে। ৬৮টি গাড়ি থেকে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। এ দিকে গতকাল রাস্তায় মানুষের উপস্থিতি কম থাকায় বিপাকে পড়েছিলেন রিকশা চালকরা। যাত্রীর জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয়েছে তাদের। অথচ গত বৃহস্পতিবারও রিকশা চালকদের দাপটে দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন যাত্রীরা।
রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউ, ফার্মগেট, বিজয় সরণি, কাওরান বাজারের প্রধান সড়ক, সায়েন্স ল্যাব এলাকা, শাহবাগ, মিরপুরের ৬, ৭ ও ১২ নম্বরের রাস্তাঘাট ছিল অনেকটাই ফাঁকা। লোকজনের উপস্থিতিও কম দেখা গেছে। খিলগাঁও এলাকার ভেতরের গলিগুলোতে দোকানপাট বন্ধ থাকলেও বেশকিছু দোকানপাট খোলা দেখা গেছে। সাধারণ মানুষের উপস্থিতি তুলনামূলক বেড়েছিল। বৃহস্পতিবার খিলগাঁও রেলগেটে বিপুল সংখ্যক পুলিশ দেখা গেলেও শুক্রবার খুব বেশি চোখে পড়েনি। ফলে সাধারণ মানুষ যে যার মতো করে ঘোরাঘুরি করছেন। সারমিন আক্তার নামে একজন গৃহিণী বলেন, শুক্রবার সাপ্তাহিক বাজার করার জন্য খিলগাঁও রেলগেট কাঁচাবাজারে এসেছি। বাজার সেরে এখন আবার বাসায় যাচ্ছি। লকডাউন হলেও মানুষের উপস্থিতি কিছুটা বেশি বলে মনে করেন তিনি।
এ দিকে গত বৃহস্পতিবার কঠোর লকডাউনের প্রথম দিনে ব্যক্তিগত গাড়িসহ বিভিন্ন যানবাহনের উপস্থিতি ছিল সড়কগুলোয়। সে তুলনায় গতকাল ব্যক্তিগত গাড়ি ছিল অনেক কম। যে কয়টি গাড়ি বের হয়েছিল সেগুলোকে আবার পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের মধ্যে পড়তে হয়েছে। অন্য দিকে বন্ধ থাকতে দেখা গেছে বেশির ভাগ দোকানপাট।
মিরপুর ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মো: সোহেল রানা জানান, সকাল থেকে বৃষ্টির মধ্যেও পুলিশের চেকপোস্ট ছিল কড়া। তবে প্রথম দিনের চেয়ে গতকাল মামলা কম হয়েছে। কারণ রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কম ছিল। যারা বের হয়েছিলেন তাদের সত্যিকারে প্রয়োজন ছিল। আর যারা বিনা কারণে বের হয়েছিলেন তাদের শাস্তি দেয়া হয়েছে। মিরপুর বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) আ স ম মাহতাব উদ্দিন বলেন, লকডাউনের (বিধিনিষেধ) নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বিনা কারণে রাস্তায় বের হওয়ায় মিরপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৩০ জনকে আটক করেছেন দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা। শুক্রবার সকাল থেকে বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত মিরপুর, গাবতলী, টেকনিক্যাল, শাহ আলী, পল্লবী, কাফরুল থানাসহ অন্যান্য এলাকা থেকে তাদের আটক করা হয়।
খুলনা ব্যুরো জানায়, প্রশাসনের কঠোর অবস্থানে লকডাউনের দ্বিতীয় দিন খুলনা ছিল অনেকটা ফাঁকা। যৌক্তিক কারণ ছাড়া কেউ বাইরে বের হলেই তাকে গুনতে হয়েছে জরিমানা। ছিল শাস্তির বিধান। ১৬ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে সেনা, বিজিবি, র্যাব, পুলিশ, এপিবিএন ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা নগরীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে চেকপোস্ট বসিয়ে কার্যক্রম চালাতে দেখা গেছে। নগরীর রয়্যাল মোড়ে বাইরে আসার কারণ জিজ্ঞাসায় উত্তর দিতে না পারায় শাস্তি হিসেবে তিনজনকে আধাঘণ্টা রোদে দাঁড় করিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। বড় বাজারে মুখে মাস্ক না পরে ঘুরতে আসা একজনকে সদুত্তর দিতে না পারায় ২ শ’ টাকা জরিমানা করা হয়। সবচেয়ে দুর্ভোগে পড়ে খেটে খাওয়া শ্রমিক-মজুর। নগরীর শিববাড়ি, মোস্তফার মোড়সহ কয়েকটি জায়গায় তাদের দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে কাজ না পেয়ে হতাশ হয়ে গন্তব্যে ফিরে যেতে দেখা যায়। তবে কাঁচাবাজারগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে পরিলক্ষিত হয়নি।
জেলা প্রশাসনের মিডিয়া সেলের সূত্র জানায়, খুলনা মহানগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন ও কঠোর বিধি নিষেধ নিশ্চিতকরণে এখন পর্যন্ত মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকালে খুলনা মহানগরে মোট ৪৮টি মামলায় ৩৮ জনকে ২২ হাজার ৬ শ’ টাকা জরিমানা করা হয় এবং ১৮ জনকে আটক করা হয়। উপজেলাগুলোতে নিজ নিজ উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও এসিল্যান্ডদের নেতৃত্বে অভিযান পরিচালিত হয়।
রাজশাহী ব্যুরো জানায়, রাজশাহীতে ‘লকডাউন’ বাস্তবায়নে কঠোর অবস্থানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দ্বিতীয় দিনে গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা রাজশাহী নগরীর প্রধান প্রধান সড়ক ও পাড়া-মহল্লার গলিপথেও টহল দেয়। সকালে নগরীর কাঁচাবাজারগুলোতে মানুষের তেমন ভিড় লক্ষ করা যায়নি। বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত নগরী প্রায় ফাঁকাই দেখা গেছে।
তবে রাজশাহী নগরী ও জেলায় জরুরি সেবাগুলো চালু রয়েছে আগের মতোই। এর মধ্যে রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স, ওষুধ ও খাবার পরিবহনের যানবাহনগুলো স্বাভাবিক নিয়মেই চলাচল করছে। যারা জরুরি প্রয়োজনে ওষুধের প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে বাইরে বের হচ্ছেন তাদেরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জেরার মুখে পড়তে হচ্ছে। পুলিশ, র্যাব ও আনসার সদস্যদের পাশাপাশি রাজশাহী নগরী এবং প্রতিটি উপজেলায় সেনাবাহিনীর দু’টি করে টিম টহল দিচ্ছে। পাশাপাশি তিন প্লাটুন বিজিবি ‘লকডাউন’ বাস্তবায়নে মাঠে রয়েছে। এছাড়া মাঠপর্যায়ে রয়েছে জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত।
রাজশাহী নগরীর তিনটি প্রবেশমুখসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে বসানো হয়েছে চেকপোস্ট। নগরীর তিন দিকের প্রবেশমুখ আমচত্বর, কাশিয়াডাঙ্গা ও কাটাখালী এলাকায় পুলিশ সদস্যরা ব্যারিকেড দিয়ে ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করছেন। এসব পয়েণ্টে মানুষ ও যানবাহনের অবাধ প্রবেশ ঠেকাতে কঠোর নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলেছে মহানগর পুলিশ। পণ্যবাহী পরিবহন, পিকআপ ভ্যান ও মালবাহী ট্রাক ছাড়া অন্য কোনো যানবাহন রাজশাহী নগরীতে ঢুকতে বা বের হতে দেয়া হচ্ছে না। বেলা ১১টা পর্যন্ত জরুরি সেবার যানবাহন ছাড়া মূল সড়কে রিকশা চলতে দেখা যায়নি। তবে পাড়া-মহল্লার ভেতরে ভেতরে রিকশা চলছে। এছাড়া কিছু প্রাইভেটকার বিভিন্ন স্টিকার লাগিয়ে বাইরে বের হচ্ছে। বন্ধ রয়েছে নগরীর সব মার্কেট, বিপণিবিতান এবং সব ধরনের দোকানপাট। লকডাউনের কঠোরতায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা এক প্রকার স্থবির হয়ে পড়েছে। ফলে জনবহুল এই নগরীতে যেন নেমে এসেছে সুনসান নীরবতা।
রংপুর অফিস জানায়, কঠোর লকডাউনের দ্বিতীয় দিন যানবাহন ও জনচলাচল নিয়ন্ত্রণে রংপুর মহানগরীতে তৎপর ছিল প্রশাসন। চালানো হয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত।
শুক্রবার সকাল থেকেই গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে নগরীতে। তবুও গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে চেকপোস্ট বসিয়েছে মেট্রোপলিটন পুলিশ। জেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশন যৌথভাবে চারজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে র্যাব-পুলিশ- সেনাবাহিনীর বিশেষ টিমের টহল চলছে নগরীজুড়ে। এছাড়াও নগরীর বাইরে প্রতিটি উপজেলায় একটি করে সেনাবাহিনী ও বিজিবির টিম কাজ করছে মানুষকে লকডাউন মানাতে। বৃষ্টি উপেক্ষা করেই সকাল থেকেই নগরীতে রিকশা, মোটরসাইকেল, সাইকেলে অনেক মানুষজনকে দেখা গেছে প্রয়োজনীয় কাজে যেতে। এছাড়াও দোকানপাট শপিংমল আছে বন্ধ। কাঁচাবাজার ও ফলমূলের দোকানগুলোতে দেখা গেছে কেনাকাটা করতে। ফলের দোকানে অভিযান চালিয়ে সতর্ক করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
এদিকে বৃষ্টির কারণে দিনভর নিম্ন আয়ের মানুষের দুর্ভোগ ছিল চরমে। বৃষ্টি ভিজেই অনেকেই রিকশা অটোরিকশা নিয়ে বেরিয়েছিলেন। কাক্সিক্ষত যাত্রীও পাননি তারা। বিধিনিষেধের কবলে পড়ে তারা অসহায় হয়ে পড়েছেন। ৫টার পরই সব কিছু বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়েছেন। পরিবার পরিজন নিয়ে তারা খেয়ে না খেয়ে থাকছেন।
রংপুর বিভাগীয় কমিশনার আব্দুল ওয়াহাব ভুঞা জানান, সিটি করপোরেশন ছাড়াও বিভাগের আট জেলার ৫৮ উপজেলা এবং ইউনিয়নগুলোতেও সরকারের কঠোর বিধিনিষেধ মানাতে প্রশাসন কাজ করছে। তিনি করোনাভাইরাস মোকাবেলায় জনগণকে সরকারি বিধিনিষেধ মেনে চলার আহবান জানান।
নাটোর সংবাদদাতা জানান, করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে চলমান কঠোর বিধিনিষেধ ও স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করতে শুক্রবার জেলার বিভিন্ন স্থানে পাঁচটি ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনা করেছে। এসব অভিযানে ১৫ ব্যক্তিকে পাঁচ হাজার ৭০০ টাকার অর্থদণ্ড প্রদান করা হয়। জেলা শহর, লালপুর, বড়াইগ্রাম ও নলডাঙ্গায় পাঁচটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছেন জেলা প্রশাসনের এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট খালিদ হাসান, রেহানা আক্তার মুক্তি, আব্দুল মালেক, শরীফ শাওন ও লালপুরে উপজেলায় দায়িত্বপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাম্মী আক্তার। জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শামীম আহমেদ বলেন, করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কঠোর বিধিনিষেধ কার্যকর করা জরুরি।
আশুলিয়া (ঢাকা) সংবাদদাতা জানান, আশুলিয়ার বিভিন্ন বাজারে কঠোর লকডাউনের দ্বিতীয় দিনে কোনো ছোঁয়া লাগেনি। মানুষজনকে গাদাগাদি করে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে দেখা গেছে। স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে বাজারগুলোতে মানুষের জটলা থাকলেও মনিটরিংয়ের জন্য প্রশাসনের কাউকে চোখে পড়েনি। তবে কঠোর লকডাউনের প্রথম দিনের তুলনায় আশুলিয়ার সড়ক, মহাসড়কগুলো ছিল অনেকটাই ফাঁকা। সড়কের বিভিন্ন স্থানে আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের টহল দিতে দেখা গেছে।
শুক্রবার ভোর থেকে আশুলিয়ার বাইপাইল মাছের আড়ৎ, কাঁচামালের আড়ত, ফলের আড়ত, শ্রীপুর বাজার, আড়ত, জিরানী বাজার, গোহাইলবাড়ি বাজার এবং কোনাপাড়া ইকরা বাজারগুলোতে জনসমাগম ছিল চোখে পড়ার মত। বিশেষ করে বিভিন্ন পণ্যের আড়ত, জিরানী বাজার এবং গোহাইলবাড়ী বাজারে লোকসমাগম ছিল তুলানামূলকভাবে বেশি।
সরেজমিন আশুলিয়ার বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে শত শত মানুষের সমাগম থাকলেও স্বাস্থ্যবিধির কোনো বালাই ছিল না। অধিকাংশ ক্রেতা-বিক্রেতার মুখে ছিল না কোনো মাস্ক।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/592416/