৩ জুলাই ২০২১, শনিবার, ২:৩৩

ধান আমাদের শুধু খাদ্যশস্য নয় প্রাণও

আমরা মানে বাঙালিরা এখন খাদ্যদ্রব্য হিসেবে রুটি খাওয়া রপ্ত করলেও ভাতের প্রতিই বেশি আগ্রহী। কথায় বলে না, “মাছে-ভাতে বাঙালি”। আমরা যে যাই বলি না কেন, ভাত ব্যতীত আমাদের অন্যকোনও খাবারে মনভরে না। প্রাণও জুড়োয় না। কাজেই ভাত আমাদের জীবন। ভাত আমাদের মরণ।

বিয়ে-শাদি হলে “বউভাত” বলে একটা অনুষ্ঠান হয়। কই, কেউতো “বউরুটি”র আয়োজন করে না? বাচ্চাদের ৬ মাস বয়স হলে সেখানেও “ভাতখাওয়ানো”র অনুষ্ঠান করা হয়। কেউ কি “রুটিখাওয়ানো”র আয়োজন করেন? নিশ্চয়ই না। তাই ভাত মানে আমাদের জীবন। ভাত আমাদের মরণ। এটাই সত্য এবং শাশ্বত।

কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা থেকে রেজাউল করিম জানিয়েছেন, নিজের উদ্ভাবিত নতুন জাতের ধান চাষ করেছেন মিরপুর উপজেলার কৃষক মিলন হোসেন। এক বিঘা জমিতে আবাদ করে তিনি ধান পেয়েছেন ৪৩ মণ, যা সাধারণ ধানের তিনগুণ। এ ধানের কোনও নাম নেই। তাই তিনি তাঁর মেয়ের নামানুসারে এ ধানের নাম রেখেছেন ‘ফাতেমাধান’। চমৎকার নামকরণ। ধন্যবাদ কৃষক মিলন হোসেনকে তাঁর বুদ্ধিমত্তার জন্য।
মিলন হোসেনের সাফল্য দেখে এ ধানের বীজসংগ্রহে দূর-দূরান্ত থেকে আসছেন অনেকে। একই সঙ্গে এ বীজ গবেষণাগারে পাঠিয়েছে কৃষি বিভাগও।

মিলন হোসেন কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার সদরপুর ইউনিয়নের চকগ্রামের বাসিন্দা। পেশায় তিনি একজন ছোট মুদি দোকানি। একই সঙ্গে আধুনিক চাষাবাদে রয়েছে তাঁর ব্যাপক আগ্রহ। গতানুগতিক কৃষির পরিবর্তে নতুন জাতের এ ধান উৎপাদনে তিনি সাফল্য পেয়েছেন। লাভজনক হওয়ায় তাঁর মতো এলাকার অনেকেই এখন নতুন এ জাতের ধান চাষের জন্য আগ্রহ দেখাচ্ছেন।

সম্প্রতি কৃষক মিলন হোসেন জানান, তিন বছর আগে তিনি ব্রি-৫১ জাতের ধানের চাষ শুরু করেন। সেসময় তাঁর জমিতে ভিন্ন ধরনের এক গোছা ধানের গাছ দেখা যায়। অন্য গাছের তুলনায় গাছগুলো বেশ শক্তপোক্ত, লম্বা ও মোটা। তিনি গাছগুলোকে তুলে ফেলে না দিয়ে অন্য ধানের সঙ্গে রেখে দেন।

পরে দেখেন ওই গোছার শীষে অনেক ধান। তখন তিনি সেধানগুলো আলাদা করে কেটে রেখে দেন। পরে সেধানগুলো আলাদা করে চারা দিয়ে অল্প কিছু জমিতে চাষ করেন। পরের বছর সেখান থেকে বীজ সংগ্রহ করে পুনরায় দুই বিঘা জমিতে এ ধানের চাষ করেন।

এ ধানের জাতের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে তিনি জানান, অন্য ধানের মতোই এ ধানের চাষপদ্ধতি। আউশ, আমন ও বোরো তিন মৌসুমেই এ ধানের চাষ করা যায়। গাছের উচ্চতা অন্য ধানের তুলনায় বেশি। গাছগুলো শক্ত হওয়ায় হেলে পড়ে না। আর এক একটি ধানের শীষে ৭০০-৭৫০টি করে ধান হয়। সাধারণ ধানের তুলনায় ছয় গুণ বেশি। ফলে এর উৎপাদনও অনেক বেশি। রোগ ও পোকামাকড়ের হার তুলনামূলক কম। এ ছাড়া চাল খুব চিকন ও ভাতও খেতে খুব সুস্বাদু।

ধানের নামকরণ সম্পর্কে তিনি জানান, মেয়ের নামানুসারে এ ধানের নাম রেখেছেন ‘ফাতেমাধান’।
মিলন হোসেন জানান, চলতি বোরো মৌসুমে তিনি এক বিঘা জমিতে ৪৩ মণ ধান পেয়েছেন। যেহেতু এ ধান ইতোপূর্বে কেউ চাষ করেননি। তাই আশপাশের এলাকার চাষিরা এসে বীজ হিসেবে এ ধান কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি ৩০০ টাকা কেজি দরে এ ধানের বীজ বিক্রি করছেন। প্রায় পাঁচ লাখ টাকার ওপরে তিনি শুধু বীজধান বিক্রি করেছেন।
‘ফাতেমাধান’ আরও উন্নত করে কৃষকের হাতেহাতে পৌঁছে দিতে সরকারের কাছে দাবি জানান তিনি।

এ বিষয়ে একই এলাকার কৃষক সাইদুল জানান, তাঁরা যেসব ধান চাষ করেন, তার তুলনায় এ ধানের ফলন তিনগুণ বেশি। তিনি চান সরকারিভাবে এ ধান কৃষকের হাতেহাতে পৌঁছে দেয়া হোক। কৃষক সেলিম হোসেন জানান, অনেক ফলন হচ্ছে শুনে তিনি কৃষক মিলনের এ ধান দেখতে এসেছেন। মিলনের কাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করেছেন। আগামীতে তিনি এ ধান চাষ করবেন।

কুষ্টিয়া জেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা নাঈম হোসেন বলেন, সাধারণত প্রতিটি ধানের শীষে ১৫০-১৬০টি করে দানা থাকে। কিন্তু কৃষক মিলনের উদ্ভাবিত এ ধানের প্রতিটি শীষে ৭০০-৭৫০টি করে দানা হয়েছে। ধানের ফলন বিঘাপ্রতি ৪০-৫০ মণও হতে পারে।

মিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রমেশচন্দ্র ঘোষ বলেন, কৃষক মিলন নিজের চেষ্টায় ব্রি ধান-৫১ জাতের মধ্য থেকে কয়েকটা ধানের গোছা সংগ্রহ করে নতুন এ জাত উদ্ভাবন করেছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে কৃষকদের আধুনিক ধানচাষে উদ্বুদ্ধকরণ ও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। কৃষক মিলনের উদ্ভাবিত এ ধানের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। আগামীতে এ ধানের বিস্তার লাভ করবে বলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জানান।
ধানের চাল থেকে যেভাত হয় তা খেতে বেশ সুস্বাদু। চিকন ও সুগন্ধি নানারকম চাল হয়। এসব চাল থেকে পোলাও, বিরিয়ানির মতো সুস্বাদু খাদ্য প্রস্তুত হয়। চাল থেকে যেসব বিচিত্র সৌখিন খাবার প্রস্তুত হয়, তা আটা-ময়দা বা অন্যকোনও খাদ্যপণ্য থেকে হয় না। তাই চালের তুলনা চালই। চাল বা ভাতের তুলনা রুটি দিয়ে হয় না। হবেও না। অবশ্য চালের আটা দিয়ে রুটি-পরোটাও প্রস্তুত করা যায়। তবে গম, ভুট্টা দিয়ে ভাত বানানো বেশ মুশকিল বৈকি! এমনকি ফিরনি, পায়েস ইত্যাদিও আটা-ময়দা দিয়ে হয় না।

পৃথিবীতে অনেক রকম ধান যেমন হয়, তেমনই চালও। বাংলাদেশে সাধারণ ভাতের চাল ছাড়াও পোলাও, বিরিয়ানির জন্য বাসমতি, কাটারিভোগ, চিনিগুড়া, কালাজিরা, বেগুনবিচি ইত্যাদি রকম সুগন্ধি চাল হয় বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতে। চিনেও উৎপন্ন হয় চমৎকার চাল। থাইল্যান্ডে ‘জেসমিন’ নামে এক রকম চমৎকার চিকন চাল হয়, যা দেখতে অসাধারণ। খেতেও হয়তো তেমনই।

আজকাল ভাত, গমের আটার রুটির সঙ্গে আলু খাওয়া হয় বিভিন্ন দেশে। ইউরোপের অনেক দেশে আলু প্রধানখাদ্য। এমনকি ভাত ও রুটির চেয়ে আলুতে ভিটামিন বা খাদ্যপ্রাণ বেশি বলে জানিয়েছেন খাদ্যবিজ্ঞানীরা। কিন্তু এসবের পরও ভাতের প্রতি বাঙালির প্রাণের টান কমেনি আদৌও। তাই ভেতো বাঙালির ভাতবিনে চলে না। ভাত বাঙালির প্রাণ। ভাত বাঙালির মান। এ ভাতই বাঙালির সম্মান। তাই অধিক ফলনশীল ফাতেমাধানের আবিষ্কারক কুষ্টিয়া জেলার মিরপুরের কৃষক মিলন হোসেনকে অশেষ ধন্যবাদ এবং অভিনন্দন। তাঁর আবিষ্কৃত ‘ফাতেমাধান’ বোরো, আউশ ও আমন তিন মৌসুমেই আবাদ করা যায়। ফলনও তিন গুণ। এ ধানের চাল চিকন, ভাতও খেতে সুস্বাদু। কাজেই আগামীতে আমাদের কৃষকরা এমন উচ্চ ফলনশীল ধানই চাষ করবে। দেশও এগিয়ে যাবে ধানচাষে।

https://dailysangram.com/post/457405