২ জুলাই ২০২১, শুক্রবার, ২:১২

কেইস স্টাডি ত্ব-হা আদনানের প্রত্যাবর্তন

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী:

তরুণ ইসলামী বক্তা তথা ইসলাম প্রচারক ত্ব-হা মোহাম্মদ আদনান আট দিন নিখোঁজ থাকার পর ফিরে এসেছেন। তার অন্তর্ধানের পর থেকে গোটা সমাজে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। অভিযোগ উত্থাপিত হয় যে সরকার তাকে গুম করেছে। তার স্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলন করে ত্ব-হাকে ফেরত চান। সংবাদপত্রগুলোতে শিরোনাম হতে থাকে যে, ত্ব-হাকে ফেরত দেয়া হোক।

ত্ব-হা ফেরত আসার পর তিনি নিজ মুখে সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি; কিংবা কথা বলতে দেয়া হয়নি। ত্ব-হা কি বলেছেন, না বলেছেন সে কথা পুলিশ আমাদের জানিয়েছে। সুতরাং ঐ বক্তব্য সম্পর্কে গভীর সংশয় রয়েছে। উধাও হওয়ার আগপর্যন্ত ত্ব-হার সঙ্গে ছিলেন তার দুই সহযোগী ও গাড়ির চালক। পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী তারা সবাই এক সঙ্গে ফিরে আসেন। ফিরে এসে যে যার বাড়ি চলে যান। আশ্চর্য ঘটনা হলো এই যে, তারাও গত আটদিন কোনো শব্দ করেনি। ত্ব-হা ও তার দুই সহযোগী রংপুরে বক্তৃতা করতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরে একটি মসজিদে খুদবা দেয়ার কথা ছিলো। কিন্তু একটি ভাড়া গাড়িতে গাবতলী আসার পর তিনি তার সহযোগী ও গাড়ি চালক গাড়িসহ অপহৃত হন। রাত দুইটা সাঁইত্রিশ মিনিটে (১১ই জুন) তিনি তার স্ত্রীকে জানান যে, তিনি গাবতলীতে আছেন। তারপর থেকেই তার সঙ্গে আর যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না। তার অন্তর্ধানের পর, তার স্ত্রী সাবেকুন নাহার এক সাংবাদিক সম্মেলনে তার গুমের খবর জানান এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছে তার স্বামীকে ফেরত দেয়ার আবেদন জানান। তিনি বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীর দফতরে যোগাযোগ করেন। তার সন্দেহ ছিলো যে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তার স্বামীকে তুলে নিয়ে গেছে।

যাই হোক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রংপুর পুলিশ বলেছে, কিছু পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে আদনান আত্মগোপনে গিয়েছিলেন। আদনানের (৩১) অন্তর্ধানের পর, তার মা আজেদা বেগম ১১ই জুন রংপুর কোতোয়ালী থানায় একটি জিডি করেন। পুলিশ বলেছে, আদনানের দুই স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী আবিদার আছে তিন বছরের একটি মেয়ে আর দেড় বছরের একটি ছেলে। তার প্রথম স্ত্রী থাকেন রংপুর। দ্বিতীয় স্ত্রী ঢাকায়, এটিও পুলিশের ভাষ্য। আলাদা আলাদাভাবে প্রমাণ করা হয়নি।

যেদিন আদনানকে উদ্ধার করা হয়, সেদিন পুলিশ আদনানের সঙ্গী মিঠাপুকুরের জায়গীরহাটের বাসা থেকে আটক করে। বগুড়ার শিবগঞ্জ থেকে আটক করে ফিরোজ নামের অপর সহযোগীকে। আর ড্রাইভার আমির উদ্দিনকে আটক করে ঊনিশ তারিখে যখন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তখন তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল।

এরপর পুলিশের কাহিনী একটি নতুন ধারায় মোড় নেয়। রংপুর মেট্রোপলিটান পুলিশের ডিসি মারুফ হোসেন সাংবাদিকদের জানান যে, সহযোগী ও ড্রাইভারকেসহ গত ১০ জুন রাতে এই চারজন গাইবান্ধার ত্রিমোহনীতে পৌঁছেন। তারা আদনানের বন্ধু সিয়ামের বাড়িতে ছিলেন। আর ঐ বাড়িতে থাকা অবস্থায় ঐ চারজনের সকলেরই টেলিফোন বন্ধ ছিলো। পুলিশ বলেছে বিভিন্ন পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে এই চারজন স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে ছিলেন।

ডিসি আবু মারুফ হোসেন জানান, আদনান ও তার সহযোগীরা ১০ জুন বিকেলে রংপুর থেকে ঢাকা যান। আদনান তার ভ্রমণসঙ্গীদের বলেন, তার কিছু ব্যক্তিগত সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। তিনি তখন অন্যদের সঙ্গে কথা বলেন এবং আত্মগোপনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ডিসি মারুফ বলেছেন যে, রাষ্ট্র বা সরকারকে বিব্রত করার জন্য আদনান আত্মগোপনে গিয়েছিলেন কি সেটি তারা তদন্ত করে দেখছে। তিনি বলেন, আদনান তার ব্যক্তিগত কিছু সমস্যা পুলিশের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। পুলিশ তা খতিয়ে দেখছে। আর একটি তথ্য হলো এই যে, গত ১৮ তারিখ দিবাগত রাতে আদনান, মুহিত ও ফিরোজকে রংপুরের একটি আদালতে হাজির করা হয়। আদালত তাদের মুক্তি দিয়ে দেন। একজন শীর্ষস্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, তিনি আদনানের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কিছু বলতে চান না। তদন্তের পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। সে সময়কার সর্বশেষ তথ্য ছিলো এই যে, পুলিশের বক্তব্য সম্পর্কে সাবেকুননাহারের দুই ভাই ও মায়ের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তাদের ফোন ও সুইচ অফ ছিলো। পুলিশ বলেছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ না থাকায়, তাদেরকে তাদের পরিবারের জিম্মায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। লক্ষ্য করবেন কি করা হয়েছে, কিংবা হয়নি। ত্ব-হা আদনানরা কি বলেছেন, কি বলেন নি তা সবই আমদের শুনতে হচ্ছে পুলিশের মুখ দিয়ে। ত্ব-হাকে সাংবাদিকদের সামনে আনাতো হয়ইনি। বরং তাকে নিয়ে এক সময় এক কথা বলা হয়েছে। কখনো বলা হয়েছে ত্ব-হা করোনা আক্রান্ত। কখনো বলা হয়েছে তিনি গভীর ঘুমে আছেন। এ সবের কোনো কথাই কারো কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। ত্ব-হা তার বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয় নিতে পারেন। কিন্তু ত্ব-হার ভাড়া করা গাড়ির ড্রাইভার সেখানে আত্মোগোপন কেন করবে। ভাড়ার গাড়ি চলে গিয়ে ভাড়া খাটবে। কিন্তু না সে চালক ত্ব-হার সঙ্গে একইভাবে আটকে ছিলেন।

ত্ব-হা আদনান বলেছেন, পথে পথে কেউ তাকে ফলো করছিলো। এক পর্যায়ে তার মনে হয়েছিলো তাকে কেউ অপরহণ করতে চায়। সম্ভাব্য অপহরণকারীর হাত থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য তিনি একটি পেট্রোল পাম্পেও আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারপর গাবতলী এসে “অপহরণকারী”দের ভয়ে তিনি চলে গিয়েছিলেন, গাইবান্ধা। সেখানে তার বন্ধু সিয়ামের মা তাদের সকলকে আশ্রয় দেন। ইন্টারেস্ট্রিং হলো এই যে, এখানেও গাড়ি চালক আদনানের সঙ্গে থাকেন। তাদের কেন ধরে রাখা হলো, সে প্রশ্নের সদোত্তর নেই।

এইভাবে যাদের গুমকরা হয়, কিংবা যারা নিখোঁজ হন, সাধারণত তারা গুমকালীন অবস্থায় তাদের উপর কি ঘটেছিলো, সেকথা প্রকাশ করেননি। সেটা ফরহাদ মাজহারও প্রকাশ করেন নি, মুহাম্মদ ত্ব-হা আদনানও প্রকাশ করেন নি। তারও আগে গুম হয়েছিলেন মেজর মারুফ জামান। তিনি সরকারি কর্মচারি ছিলেন, কূটনীতিক ছিলেন, বিদেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। এয়ারপোর্ট রোডে মেয়েকে আনতে যাওয়ার পথে হঠাৎ হাওয়া। ফিরে এসে সেই যে মুখ বন্ধ করেছেন আর কোনো কথা বলেননি। এখন স্বাভাবিক অবস্থায় আর কেউ যে কোনো কথা বলতে পারবে না, এমন কি ত্ব-হা মোহাম্মদ আদনানও না। সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। ত্ব-হা মোহাম্মদ আদনান আর যাই হোক নিজ মুখে পুলিশের সাজানো কোনো বয়ান হাজির করেন নি। সত্য তিনি প্রকাশ করতে পারেন বটে কিন্তু মিথ্যার দূত হিসেবে নিজেকে হাজিরও করেননি।

কোনো একদিন না একদিন তো এই সব মিথ্যাবাদির ভাষ্য বেরিয়ে যাবে। তখন সত্য প্রকাশিত হবে। এই যে অত্যাচার ইসলাম প্রচারকদের স্তব্ধ করে দেওয়া। নির্মম নির্যাতনের শিকার করা-তার সবকিছুর জন্য এখনকার উদপীড়কদের জবাব দিতে হবে। আমরা সেই সুদিনের অপেক্ষায় আছি।

https://dailysangram.com/post/457266