১ জুলাই ২০২১, বৃহস্পতিবার, ৩:২৫

করোনার মধ্যে ডেঙ্গুর চোখ রাঙানি

বর্ষার শুরুতেই রাজধানীতে বেড়েছে এডিস মশার প্রকোপ। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে বেশকিছু এলাকায় ব্যাপকহারে ছড়িয়েছে এর বিস্তার। ফলে বেড়েছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। চলতি বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৭১ জন। প্রতিদিনই হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে নতুন নতুন রোগী। করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে ডেঙ্গুর বিস্তার বেড়ে যাওয়ায় নগরীর মানুষের দিন কাটছে ভয় আর আতঙ্কে। কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, গত বছরের চেয়ে রাজধানীতে এবার ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার মধ্যে ডেঙ্গুর বিস্তার বাড়তে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। এখনই সিটি করপোরেশন কার্যকরী পদক্ষেপ না নিলে, বিগত বছরের তুলনায় পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।

প্রতি বছর জুন থেকেই ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে থাকে। বাসাবাড়ির আনাচে কানাচে, নির্মাণাধীন ভবন, ফুলের টবে জমা পানিতে এডিস মশার বিস্তার ঘটে। ফলে আগে থেকেই মশার লার্ভা শনাক্ত করে তা ধ্বংস করতে সিটি করপোরেশনকে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় জুলাই ও আগস্টে রোগী সামাল দেয়া দুষ্কর হয়ে পড়বে।

৩০শে জুন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রিপোর্টে দেখা যায়, গত ৬ মাসে রাজধানীতে ৩৭১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ২৯৭ জন। ঢাকার ৪১টি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন আরও ৭২ জন। তবে মোট আক্রান্তের অর্ধেকের বেশি আক্রান্ত হয়েছে জুন মাসে। সর্বশেষ ৩০শে জুন একদিনে আক্রান্ত হয়েছে ১৮ জন। এদিকে সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে রাজধানীর উত্তরা, গুলশান, বনানী, মোহাম্মদপুর, শাহবাগ, পরিবাগে এডিসের ঘনত্ব স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। প্রতিটি ওয়ার্ডেই বেড়েছে এডিস মশা। ব্রুটো ইনডেক্সে ঘনত্ব পাওয়া গেছে ২৫ থেকে ৫০ পর্যন্ত।

নগরবাসীর অভিযোগ, প্রতিবছর এই সময়ে সিটি করপোরেশনকে তৎপর দেখা গেলেও, এবছর এডিস নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। কিছু এলাকায় মশক নিধন অভিযান পরিচালনা করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। সিটি করপোরেশনের চেষ্টা থাকলেও মশককর্মীদের দায়িত্বে অবহেলায় ডেঙ্গু আতঙ্ক বাড়ছে। এদিকে করোনা সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে অনেকেই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলেও হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে নারাজ। ফলে ডেঙ্গু রোগীর সঠিক সংখ্যা প্রকাশ পাচ্ছে না। রাজধানীতে পরিত্যক্ত টায়ার, বাড়ির ছাদ, নির্মাণাধীন ভবনসহ বিভিন্ন স্থানে জমছে পানি। এতে এডিস মশার বিস্তার বাড়ায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকেই।

এর আগে ২০১৯ সালে দেশের স্বাস্থ্যখাতে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল ডেঙ্গু। ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব মোকাবিলা করেছে বাংলাদেশ। সে বছর এপ্রিল থেকে দেখা দেয়া ডেঙ্গু জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে মহামারি রূপ ধারণ করে। ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা সরকারি হিসাবে এক লাখে পৌঁছে ছিল। এর মধ্যে তখন মারা গেছেন ১২১ জন। যদিও বেসরকারি হিসেবে সারা দেশে লক্ষাধিক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এদের মধ্যে তিনশ’র বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এ কারণেই চলতি বছরে করোনাভাইরাসের মধ্যে ডেঙ্গুর প্রভাব সর্বত্র দেখা দিয়েছে আতঙ্ক।

মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা আক্তার হোসেন বলেন, তিনি গত ২২শে জুন জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানতে পারেন তার ডেঙ্গু হয়েছে। পরদিন তার ছোট ভাই মুক্তারও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন। ১ সপ্তাহ ধরে তারা হাসপাতালে ভর্তি আছেন।

বনানীর বাসিন্দা ও এনজিও কর্মী রাসেল আহম্মেদ জানান, গত কয়েকদিন ধরে মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। করোনার এই দুঃসময়ে মশা নিয়ে আমরা আতঙ্কে দিন পার করছি। সিটি করপোরেশনের কর্মীদেরকে ওষুধ ছিটাতে দেখা গেলেও তা কোনো কাজেই আসছে না। মশা মরছে না।

মালিবাগের বাসিন্দা মো. হুমায়ুন কবির জানান, বাসার দরজা, জানালা বন্ধ থাকলেও মশার প্রকোপ কমছে না। দিনের বেলায় কয়েল জ্বালিয়ে রাখতে হয়। তাতেও রক্ষা হচ্ছে না।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের দাবি, জুন মাসে রাজধানীতে টানা কয়েকদিনের বৃষ্টিতে বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে। বাসাবাড়ির আনাচে-কানাচে ও নির্মাণাধীন বিভিন্ন স্থাপনায় জমে থাকা পানিতে এডিস মশা বংশবিস্তার করে। জনগণের অসচেতনতার ফলে রাজধানীতে মশার বিস্তার ঘটছে। এডিস নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার মানবজমিনকে বলেন, প্রতিবছর জুন থেকে এডিসের বিস্তার বাড়তে থাকে। এবছরও বিগত বছরগুলোর চেয়ে কয়েকগুণ এডিস মশা বেড়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মশার এডিসের লার্ভা শনাক্ত করা হয়েছে। সিটি করপোরেশনকে এ বিষয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি নগরবাসীকে এই বিষয়ে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। যাতে বৃষ্টির পানি ৩ দিনের বেশি সময় কোথাও জমে না থাকে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গু নিয়ে যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে এটা সঠিক। জুন মাসের শুরু থেকে রাজধানীতে এডিস মশার প্রকোপ বেড়েছে। কারণ দীর্ঘদিন পানি জমে থাকলে এডিসের লার্ভা সৃষ্টি হয়। এর থেকে মশার বিস্তার ঘটে। উত্তর সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন এলাকায় নির্মাণাধীন কাজ চলমান থাকায় সেখানে পানি জমে থাকে, এতে মশার উৎপত্তি ঘটে। এ ছাড়া বাসাবাড়ি, ছাদ বাগান ও ফুলের টবে পানি জমে সেখানে মশার বংশবিস্তার ঘটায়। আমরা এসব নিয়ে নগরবাসীকে সচেতন করছি। নিয়মিত ওষুধ প্রয়োগ করে মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংস করছি। এ কাজ চলমান আছে। চলতি বছর এপ্রিল থেকে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে এডিসের লার্ভা শনাক্ত করে আসছি। ৪৬টি প্রতিষ্ঠান থেকে ২৪ লাখ টাকা জরিমানাও করা হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিয়ে সচেতন করা হয়েছে। ডেঙ্গু সচেতনতায় লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া ডিএনসিসির ৪৭টি সেন্টারে বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষা করা হচ্ছে। অভিযান চলাকালে সম্ভাব্য সকল এডিস মশার প্রজননস্থলে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম পরিচালনাপূর্বক কীটনাশক ছিটানো হয়েছে। জনসাধারণকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতেও বলা হয়েছে। নগরীতে বসবাসকারীরা একটু সচেতন থাকলেই এডিস মশা বংশ বিস্তার করতে পারবে না। এতে করে ডেঙ্গুর আতঙ্ক কেটে যাবে।

https://mzamin.com/article.php?mzamin=281379&cat=2