১ জুলাই ২০২১, বৃহস্পতিবার, ৩:১৭

অপরিকল্পিত বিদ্যুৎ উৎপাদন এখন গলার কাঁটা!

দেশে একটা সময় ছিল, যখন সারাদেশে বিদ্যুৎ ঘাটতির কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং হতো। বাসাবাড়ি, কলকারখানায় মানুষের দুর্ভোগের শেষ ছিল না। কারণ, উৎপাদন হতো চাহিদার অর্ধেকেরও কম। এখন চিত্র পুরোপুরি উল্টো। চাহিদার দ্বিগুণ উৎপাদন ক্ষমতা। আর এই অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতাই এখন সরকারের গলার কাঁটা। উদ্বৃত্ত উৎপাদন ক্ষমতা নিয়ে স্বস্তিতে নেই বিদ্যুৎ বিভাগ। অপরিকল্পিতভাবে বিদ্যুৎ শক্তি বৃদ্ধির কারণে মোটা অঙ্কের আর্থিক ক্ষতিপূরণ গুনতে হচ্ছে সরকারকে।

বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাবে, ২০০৯ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল চার হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২২ হাজার ২৩ মেগাওয়াট। কিন্তু গ্রাহক চাহিদা গরমকালে ১২ থেকে সর্বোচ্চ ১৩ হাজার মেগাওয়াট এবং শীতকালে সাত হাজার মেগাওয়াট। অর্থাৎ উৎপাদন ক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। অলস বসিয়ে রাখতে হচ্ছে সচল বিদ্যুৎকেন্দ্র।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২২ হাজার ২৩ মেগাওয়াট আর সর্বোচ্চ উৎপাদন হয় গত ২৭ এপ্রিল, যার পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ৭৯২ মেগাওয়াট। অর্থাৎ সর্বোচ্চ উৎপাদনের চেয়ে সক্ষমতা বেশি রয়েছে আট হাজার ২৩১ মেগাওয়াট।

প্রতিবেদনের তথ্যমতে, চলতি বছর উৎপাদনে আসবে তিন হাজার ৫৭ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র। তবে কিছু কেন্দ্র অবসরে যাওয়ার পর ২০২১ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়াবে ২২ হাজার ২৬৯ মেগাওয়াট। কিন্তু চলতি বছর সর্বোচ্চ চাহিদা দাঁড়াবে ১৪ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। এতে চলতি বছর শেষে সাত হাজার ৭৬৯ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র বসে থাকবে।

এদিকে ২০২২ সালে সর্বোচ্চ চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে ১৫ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। পরের বছর এ চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে ১৭ হাজার ১০০ মেগাওয়াট, ২০২৪ সালে ১৮ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট ও ২০২৫ সালে ১৯ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট। তবে সে সময় উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়াবে ২৬ হাজার ৯০৪ মেগাওয়াট, যা চাহিদার চেয়ে ৩৫ শতাংশ বেশি।

পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকারীরা বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমতি পেতে অস্থির হয়ে আছে। অথচ বিদ্যুতের মাস্টার প্ল্যানের বাইরে নতুন কেন্দ্রের প্রয়োজন নেই। তাই নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন না দিতে সরকারের কাছে সুপারিশ করা হয়েছে।

জ্বালানি বিশ্নেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য এটা বড় বোঝা। বিদ্যুৎ বিভাগের দূরদর্শী পরিকল্পনার অভাবে সরকারি কোষাগার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। তাদের মতে, চাহিদার চেয়ে উৎপাদন ক্ষমতা সামান্য পরিমাণ বেশি থাকতেই পারে। কিন্তু তা দ্বিগুণ করে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ অলস বসিয়ে রাখার কোনো যুক্তি নেই।

বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, ক্রয়বিধি অনুসারে দরপত্র প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করা বেশ কঠিন ছিল। এ জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন পাস করা হয়।

বিশ্নেষকদের মতে, এটা একরকম দায়মুক্তি আইন। এ আইনের পর বেসরকারি খাতে বিনা টেন্ডারে তেলভিত্তিক রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ধুম পড়ে যায়। উৎপাদনও দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে। এই অতিরিক্ত বিদ্যুৎই এখন সরকারের গলার কাঁটা হয়ে দেখা দিয়েছে। উৎপাদন ক্ষমতার অর্ধেক মালিকানা বেসরকারি খাতের।

বিদ্যুৎ এমনই একটা পণ্য, যা মজুদ বা সংরক্ষণ করা যায় না। যখন যতটুকু উৎপাদন হয়, তখন ঠিক ততটুকুই সরবরাহ হবে। বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ অত্যন্ত ব্যয়বহুল। হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ অলস বসে থাকার কারণে অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

পিডিবির তথ্যমতে, ২০০৭-০৮ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত ১৩ বছরে বেসরকারি খাত থেকে কেনা হয় ২৫ হাজার ৩১ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ। এ জন্য পিডিবিকে পরিশোধ করতে হয় এক লাখ ৫৯ হাজার ৬৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ৬৪ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা।

২০১৯-২০ অর্থবছরে বেসরকারি বিদ্যুৎ মালিকদের বিল দেয়া হয় ২০ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ দেয়া হয় ১০ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিল দেয়া হয় ২০ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা, যার মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ আট হাজার ৭২২ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বেসরকারি কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনতে ব্যয় হয় ১৬ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল ছয় হাজার ২৪১ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীরা আয় করেন ১৪ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা, এর মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল পাঁচ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা। এভাবে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে পাঁচ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে চার হাজার ৬৬৪ কোটি, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে চার হাজার ৭১৪ কোটি, ২০১২-১৩ অর্থবছরে পাঁচ হাজার ৪৯০ কোটি, ২০১১-১২ অর্থবছরে পাঁচ হাজার কোটি, ২০১০-১১ অর্থবছরে দুই হাজার ৯৭৩ কোটি, ২০০৯-১০ অর্থবছরে এক হাজার ৭৯০ কোটি, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে এক হাজার ৫০৬ কোটি ও ২০০৭-০৮ অর্থবছরে এক হাজার ২৮০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে দেয়া হয়।

বিদ্যুৎ বিভাগের গবেষণা শাখা পাওয়ার সেল বলছে, নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের আর প্রয়োজন নেই। ২০৩১ সালে দেশে চাহিদা হবে ২৯ হাজার মেগাওয়াট। অনুমোদন পাওয়া ও নির্মাণ প্রক্রিয়ায় থাকা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের পর উৎপাদন ক্ষমতা হবে ৩৭ হাজার মেগাওয়াট। এরপরও নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি হচ্ছে।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশনের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে রেন্টাল ও কুইক রেন্টালসহ শতাধিক প্রকল্প উৎপাদনে আনা হয়। তারপরও এগুলো থেকে মানসম্মত বিদ্যুৎ মেলেনি। দলীয় ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হয়েছে। চাহিদা না থাকায় এসব কেন্দ্র প্রায়ই বন্ধ থাকে। বসে থেকে বছর বছর ক্যাপাসিটি পেমেন্ট নিচ্ছে। আবার সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রেখে বেসরকারি কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে।

তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে অলস বসে আছে প্রায় ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র। উৎপাদন না হলেও বেসরকারি খাতের এসব কেন্দ্রের জন্য মোটা অঙ্কের ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হচ্ছে। ভারসাম্যহীন পরিকল্পনার কারণে সরকারকে এ খাতে প্রতি বছর প্রচুর ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এ অবস্থায় নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া বন্ধ করা উচিত।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘বিদ্যুতের মাস্টার প্ল্যান আমরা রিভিউ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বাংলাদেশে বিদ্যুতের প্রকৃত চাহিদা কত, সেটা এখন আবার নিরূপণ করা দরকার। কারণ অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসে থাকে। এতে সরকারের ক্ষতি হয়। এর মধ্যে আবার কভিড-১৯-এর কারণে চাহিদার যে প্রাক্কলন করা হয়েছিল, সেটিও হবে না। মাস্টার প্ল্যান রিভিউ করার পর যদি দেখা যায় প্রাক্কলনের চেয়ে চাহিদা কম, তাহলে পরিকল্পনাধীন কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিল করা হবে। এছাড়া তিন হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে, যার বেশির ভাগই রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল।’

তথ্যমতে, কয়লাভিত্তিক যে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বাদ দেয়া হচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে, পটুয়াখালীর দুই হাজার ৬৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি কেন্দ্র। এ দুটি কেন্দ্রই চীনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে একটি কেন্দ্র নির্মাণে চুক্তি করা হয় ২০১৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর ও অপরটি ২০১৯ সালের ৫ মার্চ। এছাড়া উত্তরবঙ্গের এক হাজার ২০০ মেগাওয়াটের একটি, মাওয়ায় ৫২২ মেগাওয়াটের একটি, ঢাকার ২৮২ মেগাওয়াটের একটি, চট্টগ্রামের ২৮২ মেগাওয়াটে একটি, খুলনায় ৫৬৫ মেগাওয়াটের একটি, মহেশখালীর এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের একটি, কক্সবাজারের কোহেলীয়ায় বাংলাদেশ-সিঙ্গাপুর ৭০০ মেগাওয়াটের একটি এবং সিপিজিসিবিএল-সুমিতোমোর এক হাজার ২০০ মেগাওয়াটের একটি কেন্দ্র।

১০টি ছাড়াও আরও ২৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসার প্রক্রিয়ায় আছে। এগুলো উৎপাদন শুরুর পাশাপাশি বাড়বে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি। সবমিলিয়ে ২০২৫ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়াবে ২৬ হাজার ৯০৪ মেগাওয়াট। যদিও সে সময় সম্ভাব্য সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ চাহিদা দাঁড়াবে ১৯ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট।

এদিকে ২০৩০ সাল নাগাদ আরও কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এজন্য কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। এছাড়া পাওয়ার সেক্টর মাস্টার প্ল্যান আধুনিকায়ন করে বিদ্যুতের চাহিদা ও উৎপাদন পরিকল্পনা সংশোধনের উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। এতে সব মিলিয়ে ২০৪১ সাল নাগাদ চাহিদার অতিরিক্ত ১৩ মেগাওয়াটের কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে নসরুল হামিদ বলেন, ‘সময়মতো উৎপাদনে আসতে না পারায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। তবে এগুলো বাদ দেয়ার ফলে বিদ্যুতের ঘাটতি হবে না। আর ভবিষ্যতে কোন অঞ্চলে কী পরিমাণ বিদ্যুৎ লাগবে, তার ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তৈরি করা হচ্ছে। আমাদের হাতে যে পরিমাণ পাওয়ার প্লান্ট আছে এবং আগামীতে যে পরিমাণ আমরা পাব, এতে দেখা যাচ্ছে আমাদের প্রায় ১৩ হাজার মেগাওয়াট পাওয়ার প্লান্ট আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে সিস্টেমে অতিরিক্ত থাকবে।’

https://dailysangram.com/post/457228