৩০ জুন ২০২১, বুধবার, ৩:০৮

ভুল ভাবনায় সবাই বিভক্ত

যদি এমন হতো পাক-ভারত সীমান্তে উত্তেজনা না থাকতো, ফিলিস্তিনে ইসরাইলী আগ্রাসন বন্ধ হতো, চীনে বন্ধ হতো উইঘুর মুসলিম নির্যাতন, ইরাক-আফগানিস্তান-লিবিয়া-সিরিয়ায় বন্ধ হতো বিশ্বরাজনীতির ভুল কৌশল, মিয়ানমারে বন্ধ হতো সামরিক জান্তার নির্মম নির্যাতন; তাহলে কেমন হতো? হয়তো আমরা আমাদের প্রিয় গ্রহ পৃথিবীটাকে পেতাম একটা কাক্সিক্ষত রূপে। প্রিয় পৃথিবীকে আমরা সেভাবে পাচ্ছি না কেন? এ জন্য কারা দায়ী? দায়ীদের চিহ্নিত করার কাজটি তেমন কঠিন কিছু নয়। কিন্তু প্রকৃত মানুষ তথা যোগ্য নেতার অভাবে সেই কাজটি হচ্ছে না। আপন স্বার্থে, ক্ষুদ্র চেতনায় মানুষ এবং রাষ্ট্র বিভক্ত হয়ে পড়েছে। সবাই নেমেছে শঠতা, চাতুর্য ও জিঘাংসার খেলায়। বন্ধুত্বের মুখোশ পরে সবাই হননে ব্যস্ত। ফলে সভ্যতায় বেড়ে যায় আস্থার সংকট। এমন সংকটে এখন মুখ্য প্রতিযোগিতা- মারণাস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা। অর্থাৎ চমৎকার সব কথামালার আড়ালে মানুষ মানুষকে, রাষ্ট্র রাষ্ট্রকে মারার কৌশল আঁটছে। এমন পরিণতির জন্যই কি মানুষ সমাজবদ্ধ হয়েছে, রাষ্ট্র গঠন করেছে?
আমাদের দুই বন্ধু দেশ ভারত ও চীন। কয়েক দশক ধরে দেশ দু’টির সীমান্তে স্থিতিশীল অবস্থা ছিল, কিন্তু এখন সেখানে চরম উত্তেজনা। কয়েক দফা কূটনৈতিক আলোচনার পরও পরিস্থিতির কোন উন্নতি হয়নি। ভারতের সাবেক নর্দান আর্মি কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল ডিএস হুদা বলেন, সীমান্ত পরিচালনা প্রটোকল ভেঙ্গে পড়ায় এবং উভয় দেশের অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি করেছে। এছাড়া উভয়পক্ষ আগ্রাসীভাবে বিতর্কিত সীমান্তে সেনা টহলের ব্যবস্থা করেছে। ফলে স্থানীয়ভাবে কোন ছোট ঘটনা অনিচ্ছাকৃত পরিণতির সঙ্গে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। ২৮ জুন ব্লুমবার্গ’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, চীন ও ভারত সীমান্তের বিতর্কিত অঞ্চলগুলোয় উভয়পক্ষের সেনা সমাবেশ বৃদ্ধির ফলে কোন ভুল গণনা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। উল্লেখ্য যে, লাদাখের উত্তরাঞ্চলে ভারত ও চীন গত বছর বেশ কয়েকবার সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল। এখন সেখানে এমন ২০ হাজার সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছে যারা আগে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে নিযুক্ত ছিল। ভারতীয় সেনাদের এ ধরনের পুনর্বিন্যাসের অর্থ হলো, ভারত হিমালয় অঞ্চলে লড়াইয়ের জন্য আরও সেনা গ্রহণ করবে এবং পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্তে নিয়োগকৃত সেনা সংখ্যা হ্রাস করবে। উপলব্ধি করা যায়, ভারত পাকিস্তান সীমান্তে মনোযোগ হ্রাস করে চীন সীমান্তে বর্ধিত করেছে। এমন বাস্তবতায় এ অঞ্চলে ভূ-রাজনীতিতে ভবিষ্যতে পরিবর্তন আসতে পারে। পরিস্থিতির কারণে কৌশলগত ক্ষেত্রে কোন পরিবর্তন আসলেও মারামারি বা জিঘাংসার ক্ষেত্রে কিন্তু কোন পরিবর্তন আসছে না। মারণাস্ত্রকে যে সভ্যতা নিয়ামক মনে করছে, সেই সভ্যতায় শান্তির পতাকা কে উড়াবে? তাই পাক-ভারত সংকটের চাইতেও ভারত-চীন সংকট এখন বড় হয়ে উঠছে। চেতনাগত সংকটের কারণে নিজ দেশেও শান্তির পতাকা উড়ানো এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।

জম্মু-কাশ্মীরে স্বাভাবিক অবস্থা ফেরানোর লক্ষ্যে ২৪ জুন সর্বদলীয় বৈঠকের আয়োজন করেছে ভারত সরকার। তবে এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না অল পার্টিস হুরিয়াত কনফারেন্স (এপিএইচপি) নেতারা। তাঁদের আমন্ত্রণও জানানো হয়নি। উপস্থিত কাশ্মীরী নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্পষ্ট করে বলেছেন, তাঁর সরকার কাশ্মীরকে ‘সংঘাতের এলাকা’ থেকে ‘শান্তির অঞ্চলে’ পরিণত করতে চায়। তিনি আরও বলেন, সরকার জম্মু-কাশ্মীরকে রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই বৈঠকের খবর পত্রপত্রিকায় গুরুত্বের সাথে মুদ্রিত হয়েছে। পর্যবেক্ষকরা নানাভাবে বিশ্লেষণও করছেন। কেউ মনে করছেন, সরকার হয়তো পূর্বশূরীদের ‘বৈচিত্র্যের ঐক্য’ তত্ত্বটি উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন। আবার কেউ বলছেন, এই বৈঠক আসলে একটি ‘আইওয়াশ’। তবে ভারত সরকার বৈঠকটিকে সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করছে।

মোদি সরকারের খুশির প্রধান কারণ, ৩৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে বৈঠকে জলঘোলা না হওয়া এবং বৈঠক ছেড়ে কোনো দলের চলে না যাওয়া। তবে সরকার চিন্তিত জম্মু-কাশ্মীরে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরুর পদ্ধতি নিয়ে। নির্বাচনী কেন্দ্রের পুনর্বিন্যাস বা ‘ডিলিমিটেশন’-এর পর বিধান সভার ভোট করানোর যে পরিকল্পনা কেন্দ্র ভেবে রেখেছে এবং বৈঠকেও জানিয়েছে তা কতটা বাস্তবায়ন করা সম্ভবপর হবে, চিন্তা তা নিয়েই। কেন না অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এই বিষয়ে একমত নয়। তারা চায় আগে পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেয়া হোক, তারপর নির্বাচন। তাছাড়া জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা, যা সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদে দেয়া হয়েছিল এবং যা বাতিল করেছে মোদি সরকার, ওই বিষয়টি ভুলতে পারেনি কাশ্মীরী নেতারা। ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, আমরা ৩৭০ অনুচ্ছেদ-এর দাবি ছাড়তে পারি না। আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি রাজনৈতিক লড়াইও জারি থাকবে। সেটা ৭০ সপ্তাহ হতে পারে, ৭০ মাস কিংবা ৭০ বছর। একই মনোভাব পিডিপি নেত্রী সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতিরও। সরকারের আপত্তি সত্ত্বেও বৈঠকে তিনি জোরের সঙ্গে ৩৭০ অনুচ্ছেদ পুনর্বহালের পক্ষে কথা বলেছেন। মেহবুবা বলেছেন, ৩৭০ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল না হওয়া পর্যন্ত কোনো নির্বাচনে তিনি দাঁড়াবেন না। কারণ তা হলে উপত্যকার মানুষ ভাববে, ৩৭০ আমাদের কাছে স্রেফ একটা শ্লোগান। একইভাবে ওমর আবদুল্লাহ বলেছেন, পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা না ফেরানো পর্যন্ত তিনিও ভোটে দাঁড়াবেন না। উপলব্ধি করা যায়, শুধু বৈঠকেই কোনো কিছুর সমাধান হয় না। এর জন্য প্রয়োজন হয় বাস্তব বিবেচনা এবং সঙ্গত সমাধান।

এদিকে কাশ্মীর নিয়ে নরেন্দ্রমোদির সর্বদলীয় বৈঠককে ‘আইওয়াশ’ বলে মন্তব্য করেছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কুরেশি। একই সঙ্গে একে ‘ফ্লপ শো’ হিসেবেও অভিহিত করেছেন তিনি। রাজনৈতিক এমন বক্তব্যের কারণ উপলব্ধি করা যায়। তবে উপমহাদেশের মানুষ হিসেবে আমরা কাশ্মীরে শান্তি চাই এবং কাশ্মীরের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতি সম্মান জানাই। ‘বৈচিত্র্যের ঐক্য’ চেতনায় কাশ্মীরে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয় কিনা, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

https://dailysangram.com/post/457224