৩০ জুন ২০২১, বুধবার, ১:৩৪

তেল শোধনাগারে তেলেসমাতি

মেয়াদোত্তীর্ণ ইস্টার্ন রিফাইনারি : একক নির্ভরতায় ব্যয়-অপচয় বাড়ছেই দ্বিতীয় ইউনিট বাস্তবায়নে বাধা-জটিলতা

জ্বালানি নিরাপত্তা যে কোন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়। জ¦ালানি খাতের প্রধান দিক জ্বালানি তেল। কৃষি-খামার, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, শিল্পায়ন-বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবহনসহ জীবনযাত্রার চালিকাশক্তি। দেশে জ্বালানি তেল সম্পূর্ণ আমদানি-নির্ভর। অপরিশোধিত জ¦ালানি তেল (ক্রুড অয়েল) পরিশোধন করে রাষ্ট্রায়ত্ত একমাত্র শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি (ইআরএল)। তবে চাহিদা অনুপাতে ইআরএল’র উৎপাদন সক্ষমতা পাঁচ ভাগের এক ভাগ। ১৯৬৮ সালে স্থাপিত এই শোধনাগারের যথানিয়মে অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল অতিবাহিত হয়ে গেছে ২৫ থেকে ৩০ বছর আগে।

অথচ ৫৩ বছরের পুরনো মেয়াদোত্তীর্ণ ইআরএল’র উপর আজও একক নির্ভর হয়ে আছে দেশ। বিকল্প রিফাইনারি না থাকায় তেল পরিশোধন সক্ষমতা ৮০ ভাগই নেই। এ কারণে সরাসরি ফিনিশড বা পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে ইআরএল’র জরাজীর্ণ যন্ত্রপাতি, কল-কব্জা জোড়াতালি ঝালাই-সারাই-মেরামত চলছে প্রতিনিয়ত। মেরামতের খরচ যোগ হয়ে তেল পরিশোধন ব্যয় বাড়ছেই। বাড়ছে তেলের মূল্য। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। খেসারত দিচ্ছে সরকার এবং গ্রাহক জনসাধারণ। অথচ চাহিদার সমপরিমাণ অপরিশোধিত জ¦ালানি তেল আমদানি করে দেশেই পরিশোধন হলে দ্বিগুণ ব্যয় সাশ্রয় নিশ্চিত হতো। যার অঙ্ক বার্ষিক ৬ থেকে ৮ হাজার কোটি টাকা।

দেশে ডিজেল, কেরোসিন, এলপিজি, পেট্রোল, বিমান জ¦ালানি (জেট ফুয়েল), অকটেন, ন্যাপথা, বিটুমিন, ফার্নেস অয়েলসহ অন্তত ১৭ ধরনের জ¦ালানি তেল ও তেলের উপজাতের (বাই-প্রোডাক্ট) বার্ষিক চাহিদা ৬৫ লাখ মেট্রিক টন। তবে ইআরএল’র সক্ষমতা ১৫ লাখ টন। এর বিপরীতে উৎপাদন করছে মাত্র ১২ লাখ টন। যা চাহিদার মাত্র পাঁচ ভাগের এক ভাগেরও কম। অথচ বিশে^র কোন দেশ একটি মাত্র রিফাইনারির উপর নির্ভর করে বসে নেই।

১৯৬৩ সালে দেশে তেল শোধনাগার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়। ১৯৬৮ সালের ৭ মে চট্টগ্রাম নগরী ও বন্দর লাগোয়া পতেঙ্গা গুপ্তখালে স্থাপিত ইস্টার্ন রিফাইনারি উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করে। ৫৩ বছরের পুরনো জরাজীর্ণ ইআরএল সংস্কার-মেরামত করে উৎপাদন প্রক্রিয়া কোনমতে চালিয়ে নেয়া হচ্ছে। এই সুবাদে পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি), ইআরএল’র কতিপয় অসৎ কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট আমলারা দীর্ঘদিন ধরে ‘মেরামত বাণিজ্য’ চালিয়ে যাচ্ছেন এমন অভিযোগ ওপেন সিক্রেট।

কারিগরি মেরামত, জোড়াতালি, বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি ক্রয়সহ নানা উপায়ে তাদের পকেট ভারি হচ্ছে। তেল শোধনাগার নিয়ে চলছে রীতিমতো নানামুখী তেলেসমাতি। ‘মেরামত বাণিজ্যে’ ফায়দা তুলতে একটি চক্র নতুন রিফাইনারি প্রতিষ্ঠা ঠেকিয়ে রাখতে দীর্ঘদিন চক্রটি মরিয়া হয়েই তৎপর। তারা চাইছে না পরিশোধন সক্ষমতা বাড়ুক। নেপথ্যে চক্রটি নানামুখী বাধা-বিপত্তি, জটিলতা তৈরি করছে।

এর পাশাপাশি পরিশোধিত জ্বালানি তেল সরবরাহকারী (সাপ্লায়ার্স) ও তাদের এজেন্টরাও চাইছে না দেশে নতুন রিফাইনারি হোক। কেননা সরাসরি পরিশোধিত বা ফিনিশড জ¦ালানি আমদানিতে তাদেরই বেশি লাভ। অপরিশোধিত (ক্রুড) আমদানি হলে ব্যবসা কমে যাবে।

বিপিসি, ইআরএল সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অপরিশোধিত জ¦ালানি তেল পরিশোধন ব্যয় গত দশ বছরের ব্যবধানে ৯০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যার মূল কারণ ৫৩ বছরের পুরনো ইআরএল’র ক্রমাগত মেরামত ব্যয়, অপচয়-অনিয়ম। কোম্পানির বার্ষিক প্রতিবেদনে জানা যায়, জ¦ালানি তেল পরিশোধন বা উৎপাদনে ২০০৯ সালে প্রতিটনে ব্যয় হয় ৬৩০ টাকা। দশ বছর ব্যবধানে এখন টনপ্রতি ১২শ’ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ইআরএল’র ১২ লাখ ৭১ হাজার টন তেল পরিশোধনে ব্যয় হয় ৮০ কোটি ১৬ লাখ টাকা। দশ বছর ব্যবধানে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১১ লাখ ৬৬ হাজার টন তেল পরিশোধনে ব্যয় হয় ১৩৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। ইআরএল’র কারিগরি সক্ষমতা ও অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল ২৫-৩০ বছর আগেই অতিবাহিত হওয়ায় একে সচল রাখতে গিয়ে প্রতিনিয়ত সংস্কার, মেরামত, যন্ত্রপাতি পরিবর্তন ও সংযোজন করা হচ্ছে। মেরামতি খরচ যতই বাড়ছে তা সমন্বয় হয়ে বেড়ে যাচ্ছে উৎপাদন ব্যয়।

প্রথমত. পরিশোধিত জ¦ালানি তেল আমদানি নির্ভরতা কাটিয়ে বাড়তি ব্যয় হ্রাস, দ্বিতীয়ত. অপরিশোধিত তেল আমদানি করে পরিশোধন লাভজনক- সরকার এ দু’টি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে ২০১০ সালে ‘ইস্টার্ন রিফাইনারি দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপন প্রকল্প’ গ্রহণ করে। যার উৎপাদন টার্গেট ৩০ লাখ মেট্রিক টন। ইআরএল’র পুরনো ও নতুন ইউনিট মিলিয়ে ৪৫ লাখ টন অর্থাৎ দেশের মোট চাহিদার ৭৫ ভাগ পরিশোধনের লক্ষ্য ধার্য্য করা হয়।

অন্যদিকে পদে পদে জটিলতা, অদৃশ্য বাধায় ১১ বছর যাবত ঝুলে আছে জ¦ালানি খাতের গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্প। এ যাবত দশ দফায় প্রকল্পের ডিপিপি সংশোধন করা হয়েছে। গত দশ বছরের দীর্ঘসূত্রতায় প্রকল্প ব্যয় প্রায় ৫৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা হয়েছে। অথচ এখনও সম্পন্ন হয়নি আর্থ-কারিগরি সম্ভাব্যতা যাচাই। হয়নি নির্মাতা ঠিকাদার নিয়োগ। সর্বশেষ সংশোধিত ডিপিপিতে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ইআরএল-২ ইউনিট প্রকল্পে ইতোমধ্যে বিনিয়োগে আগ্রহ ব্যক্ত করেছে সউদি আরব, চীন, আরব আমিরাত, ইউরোপ, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের এনার্জি জায়েন্ট।

ইআরএল-২ ইউনিটের প্রকল্প ব্যবস্থাপনা পরামর্শক (পিএমসি) ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্ডিয়া লিমিটেড (ইআইএল)। ২০১৬ সালের ১৯ এপ্রিল ইআইএল’র সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে বিপিসি। যা ২০২৪ সাল পর্যন্ত বর্ধিত মেয়াদে বাড়তি মূল্য ১৮৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা। ১৯৬৮ সালে ইস্টার্ন রিফাইনারির ডিজাইন বা নকশা তৈরি করে ফ্রান্সের কোম্পানি টেকনিপ। ২০১৭ সালের ১৮ জানুয়ারি ইআরএল-২ প্রকল্পের নকশার কাজও টেকনিপকে দেয়া হয়েছে। এ প্রকল্পে টেকনিপের নকশা অনুসারে ভৌত অবকাঠামো কাজ ও যন্ত্রপাতি বসাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩২২ কোটি টাকা। ইআরএল-২ ইউনিটে ১০টি প্রসেসিং ইউনিট রাখা হয়েছে। প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে পরিশোধিত অবস্থায় পাওয়া যাবে এলপিজি, গ্যাসোলিন ইউরো-৫, ডিজেল ইউরো-৫, গ্রুপ-৩ বেসঅয়েল, জেট এ-১, ফুয়েল অয়েল, বিটুমিন ও সালফার।

ইস্টার্ন রিফাইনারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. লোকমান গত রোববার দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, ইআরএল ইউনিট-২ প্রকল্পে নিয়োজিত ফ্রান্সের টেকনিক্যাল প্রতিষ্ঠান টেকনিপ তথ্য-উপাত্ত সহকারে প্রস্তাবনা দিয়েছে। এর ভিত্তিতে গত ১৭ মে থেকে ১৮ জুন এক মাস পর্যালোচনা করেছি। এর আলোকে একটি সারপত্র তৈরি হচ্ছে। প্রকল্প ব্যবস্থাপনা পরামর্শক (পিএমসি) ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্ডিয়া লিমিটেডের (ইআইএল) সঙ্গে সেটি সমন্বয় ও যাচাই করা হবে। শিগগিরই তা বিপিসিতে যাবে। এরপর আশা করি প্রকল্পের কাজে আর দেরি হবে না। তিনি বলেন, রিফাইনারি প্রকল্প স্থাপনের বিষয়টি জটিল ও হাইলি টেকনিক্যাল বিষয়। আমাদের দেশের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। তাই সময় লাগছে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, ইআরএল-২ প্রকল্প বাস্তবায়নে জটিলতা ও বিলম্বের পেছনে বহুদিন ধরে নানামুখী তদবিরের খেলা চলছে। একটি মহল ফরাসী প্রতিষ্ঠান টেকনিপকে আসতে দিতে চায় না। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পরিশোধিত জ¦ালানি তেল আমদানি করতে গিয়ে বিরাট অঙ্কের আর্থিক গচ্ছা দিতে হচ্ছে। অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, বহু আগেই ৫০ লাখ মেট্রিক টন পরিশোধন ক্ষমতাসম্পন্ন রিফাইনারি স্থাপন করা প্রয়োজন ছিল। জ¦ালানি তেলের চাহিদা ৬৫ লাখ মেট্রিক টন। আগামী ৫ বছরের ব্যবধানে তা এক কোটিতে দাঁড়াবে। দেশে আরও দুই তিনটি তেল শোধনাগার স্থাপন করা প্রয়োজন।

https://www.dailyinqilab.com/article/394234/