প্রতীকী ছবি
৩০ জুন ২০২১, বুধবার, ১:৩০

সরঞ্জামে ব্যয় সাড়ে ১২ কোটি টাকা

অস্ত্রোপচার নেই তবুও ক্রয়

এক লটে কেনা হয়েছে দুটি অপারেশন থিয়েটার উইথ গাইডেড এয়ারফ্লো সিস্টেম, দুটি ডাবল ডেমো এলইডি লাইট উইথ ক্যামেরা সিস্টেম অ্যান্ড মনিটর

রাজধানীর একটি হাসপাতালে গত দেড় বছর ধরে কোনো অস্ত্রোপচার হয় না। আগামীতে কবে নাগাদ অস্ত্রোপচার শুরু হবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। অথচ এর জন্য কেনা হয়েছে সাড়ে ১২ কোটি টাকার বেশি মূল্যের অস্ত্রোপচার কক্ষের যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য সরঞ্জাম।

কিন্তু কোভিডসংক্রান্ত কোনো সরঞ্জাম নেই ক্রয় তালিকায়। এসব কেনাকাটার দায়িত্ব নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে দিতে নেয়া হয়েছে বিশেষ কৌশল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ সময়ে যন্ত্রপাতিগুলো হাসপাতালের কোনো কাজে আসবে না। তবে তত্ত্বাবধায়কের বক্তব্য, কোভিড শেষ হলে এগুলোর প্রয়োজন দেখা দেবে তাই আগেই কেনাকাটা সম্পন্ন করা হয়েছে।

রাজধানীর কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালকে দেশের প্রথম কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসাবে করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত করা হয়। গত দেড় বছর ধরে এ হাসপাতাল কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে আসছে। তাই এখানে কোনো রোগীর অস্ত্রোপচার হয় না।

বর্তমানে কোভিড ছাড়া অন্য কোনো চিকিৎসাও এখানে হচ্ছে না। কিন্তু সম্প্রতি এ হাসপাতালের জন্য দুটি পরিপূর্ণ অপারেশন থিয়েটার কেনা হয়েছে পৌনে ৭ কোটি টাকা দিয়ে। এছাড়া হৃদরোগ ও অস্ত্রোপচারসংক্রান্ত আরও কিছু যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। আগামী দু-এক বছরেও যেগুলো ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই বলে মনে করছেন সংশিষ্টরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি যে কেনাকাট হয়েছে তার মধ্যে দুটি অপারেশন থিয়েটার উইথ গাইডেড এয়ারফ্লো সিস্টেম, দুটি ডাবল ডেমো এলইডি লাইট উইথ ক্যামেরা সিস্টেম অ্যান্ড মনিটর, দুটি মাল্টিপারপাস ইলেকট্রো মেকানিক্যাল ওটি টেবিল, দুটি অটোমেটিক অ্যানেস্থেশিয়া মেশিন রয়েছে। এগুলো এক লটে কেনা হয়েছে। কোভিডকালে এ হাসপাতালে সব ধরনের অস্ত্রোপচার বন্ধ রয়েছে। তাই এখন যন্ত্রপাতিগুলো কেনার কোনো প্রয়োজন ছিল না। আরেক লটে কেনা হয়েছে, হেমাটোলজি অটো অ্যানালাইজার একটি, ইটিটি মেশিন একটি, হলোটার মনিটরিং সিস্টেম একটি, ১০০০ এমএম ডিজিটাল এক্সরে মেশিন একটি, ডিফেব্রিলেটর একটি এবং লেপারোস্কপি সার্জারি মেশিন একটি।

এ লটের মধ্যে হেমাটোলজি অ্যানালাইজার মেশিন ছাড়া বাকি মেশিনগুলো কোভিড হাসপাতালের জন্য অপ্রয়োজনীয়। আরেক লটে কেনা হয়েছে একটি ইকো কালার ডপলার মেশিন এবং একটি আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন। কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় এ মেশিনের কোনো প্রয়োজন নেই। অন্য লটে কেনা হয়েছে অটো বায়োকেমিস্ট্রি মেশিন একটি, ব্লাড ব্যাংক রেফ্রিজারেটর (-২০ থেকে -৪০) একটি এবং মেডিকেল রেফ্রিজারেটর (২ থেকে ৮ ডিগ্রি) একটি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ হাসপাতালে ব্লাড ব্যাংক রেফ্রিজারেটারের কোনো প্রয়োজন নেই। ডিজিটাল ইকো কালার ডপলার গত অর্থবছরেও কেনা হয়েছে। এছাড়া ডিজিটাল আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন আগে থেকেই ওই হাসপাতালে ছিল। যেহেতু এই হাসপাতালে অস্ত্রোপচার হয় না তাই ওটি যন্ত্রপাতি কেনার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তাছাড়া আগে থেকে কেনা ওটি টেবিল হাসপাতালে পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে।

আরও জানা গেছে, অটো হেমাটোলজি অ্যানালাইজার মেশিন হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগে আগে থেকেই আছে। এছাড়া ইটিটি ও হলোটার মেশিন হৃদরোগ বিভাগে প্রয়োজন কোভিড হাসপাতালে নয়। গত অর্থবছরে দুটি এক্সরে মেশিন কেনা হয়েছে তাই এক্সরে মেশিন কেনার কোনো দরকার ছিল না।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক অনুমোদনের জন্য এ কেনাকাটাসংক্রান্ত ফাইল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতালে শাখায় পাঠান। বিষয়টি এখতিয়ারবহির্ভূত হওয়ায় অধিদপ্তর ফাইল ফেরত পাঠায়। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে ফাইলের প্রশাসনিক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এমনকি মালামাল বুঝে না পেয়েই বিল পরিশোধ করা হয়েছে। ওই টাকা দিয়েই মালামাল কেনা হবে বলেও জানা গেছে।

সংশিষ্ট্ররা বলছেন, সরকারি নীতিমালা অনুসারে একজন তত্ত্বাবধায়ক সর্বোচ্চ দুই কোটি টাকার বেশি ব্যয় করতে পারেন না। কিন্তু কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে তত্ত্বাবধায়ক ১২ কোটি ৫৭ লাখ ৯৯ হাজার টাকার কেনাকাটা করেছেন।

এ ধরনের কেনাকাটা করতে হলে সিএমএসডির (সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরস ডিপো) মাধ্যমে করতে হবে। তাছাড়া তিনি মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক আদেশ না পেয়েই ‘নোটিফিকেশন অ্যাওয়ার্ড’ বা ‘নোয়া’ দিয়ে এসব যন্ত্রপাতি কেনাকাটা করেছেন। যা পিপিআর (পাবলিক প্রকিউরমেন্ট) বিধি পরিপন্থি।

এ বিষয়ে ২৬ জুন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেয়ারম্যান বরাবর অভিযোগ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সেহাব উদ্দীন পরিকল্পিতভাবে স্পেসিফিকেশন নির্ধারণ করে দরপত্র আহ্বান করে এবং সর্বোচ্চ দরদাতাকে কার্যাদেশ দিয়েছে। দরপত্রে ৭টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ দরদাতা কার্যাদেশ পেয়েছে। এ অভিযোগের অনুলিপি রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।

মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, একজন বিতর্কিত ঠিকাদারকে কাজ দিতে নানা কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ। দরপত্রে ফ্রিজ কেনার ক্ষেত্রে এমন একটি সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে যা শুধু একটি প্রতিষ্ঠান দিতে পারে। এমনকি এ প্রতিষ্ঠান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এমএসআর (মেডিকেল সার্জিক্যাল রিকুজিট) এবং রোগীদের ডায়েট (প্রতি দিনের খাবার) সরবরাহ করে।

কিন্তু মালামাল না দিয়ে বিল আদায় এবং ডায়েট ঠিকমতো না দেওয়ায় সম্প্রতি হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আলাউদ্দিন আল আজাদ প্রতিষ্ঠানের বিল আটকে দেয়। যার প্রেক্ষিতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন হাসপাতালের উপ-পরিচালকে লাঞ্ছিত করে। এ বিষয়ে রাজধানীর শাহবাগ থানায় একটি মামলা করা হয়।

এর আগে গত বছর কোভিড শুরুর পরে কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কেনাকাটায় অনিয়ম বিষয়টি সরকারে অডিট রিপোর্ট প্রকাশ পায়। সেখানে বলা হয়, এ হাসপাতালে তত্ত্বাবধায়ক আইসিইউর জন্য এয়ার ফিল্টার, পিসিআর সেটআপ, সিরিঞ্জ পাম্পসহ বিভিন্ন ভারি যন্ত্রপাতি কেনে। ওই সময়ও একইভাবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মালামাল বুঝিয়ে দেওয়ার আগেই বিল পরিশোধ করা হয়। তবে এত কিছুর পরেও এই তত্ত্বাবধায়কের কর্মকাণ্ডে নিশ্চুপ মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. সেহাব উদ্দীন যুগান্তরকে বলেন, কোভিড-১৯ কোনো স্থায়ী সমস্যা নয়। কিছু দিন পরে দেশে কোভিড থাকবে না। তখন রোগীদের সার্জারির প্রয়োজন হবে তাই এসব মালামাল কেনা হয়েছে। ওটি টেবিল ও অন্যান্য সরঞ্জাম থাকা সত্ত্বে আবার কেন কেনা হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেগুলো আছে সেগুলো ব্যবহারোপযোগী নেই।

তিনি বলেন, হাসপাতালে সব বিষয়ে চিকিৎসক রয়েছেন, তাই সব ধরনের চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে স্পেসিফিকেশন নির্ধারণ করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, দরপত্র যাচাই, মূল্যায়ন সব কিছুই কমিটির মাধ্যমে হয়েছে। তাছাড়া এ কেনাকাটায় মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন রয়েছে। এমনকি বিল পরিশোধের আগেই মালামাল বুঝে পেয়েছেন বলেও জানান তিনি।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/437290/