২৯ জুন ২০২১, মঙ্গলবার, ১:২৪

বিধিনিষেধে সাড়া নেই

মহাসড়কে চলছে বাস-মিনিবাস : ঢাকায় বাস ছাড়া সবই সচল সমন্বয় সাধন করা অতিজরুরি : ড. হোসেন জিল্লুর রহমান

করোনার উর্ধ্বমুখি সংক্রমণরোধে সীমিত আকারে বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে সরকার। গত রোববার সরকারের জারি করা প্রজ্ঞাপনে শুধুমাত্র রিকশা ছাড়া সব ধরনের গণপরিবহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। একই সাথে মার্কেট, বিপনী বিতান, হোটেল বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। প্রথম দিনে গতকাল সোমবার সারাদেশেই দেখা গেছে ঢিলেঢালা ভাব। বিধি-নিষেধে তেমন সাড়া মেলেনি। বরং নিয়ম ভেঙ্গে পুলিশের চোখের সামনেই মহাসড়কে চলেছে দূরপাল্লার বাস, টেম্পু, লেগুনা, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক। রাজধানীতে পাড়া মহল্লায় খোলা ছিল মার্কেট, দোকান, বিপনী বিতান ও হোটেল-রেস্টুরেন্ট।

অন্যদিকে, অন্যান্য দিনের মতো গতকালও বিভিন্ন উপায়ে ঢাকা ছেড়ে গেছে হাজার হাজার মানুষ। ঢাকার বাইরে থেকে মানুষ ঢাকায় এসেছে। দিনভর উপচে পড়া ভিড় ছিল পাটুরিয়া ও শিমুলিয়া ফেরিঘাটে। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে ছিল যানবাহনের ভিড়। আর ঢাকার বিমান ববন্দর সড়ক আটকে ছিল যানজটে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বার বার বিধি-নিষেধের রুপ বদলানোর কারণে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। আবার সাধারণ মানুষের মধ্যে এসব বিধি-নিষেধ মানার প্রবণতাও কম। তাদের উপর আইন প্রয়োগ করে মানাতে বাধ্য করার বিকল্প নেই। অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, লকডাউন দেয়া হলো বেশ কয়েকবার এবং বিভিন্ন আঙ্গিকে। কিন্তু লকডাউনের মধ্য দিয়ে মানুষকে আসলে কী মেসেজ দেয়া হচ্ছে? গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, মানুষের বেঁচে থাকা অর্থাৎ জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করা দরকার। তিনি বলেন, সমস্যাগুলো আলাদা করে চিহ্নিত করা দরকার এবং এর মধ্যে সমন্বয় সাধন করা অতিজরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে, তা বোঝা যাচ্ছে। পরিস্থিতি সামলে আনতে লকডাউনের মতো কঠোর অবস্থান নেয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। ইউরোপ-আমেরিকাও তাই করেছে। আমরা হয়তো সেরকম পারব না। কিন্তু চেষ্টা তো হতে পারে। সে চেষ্টায়ও যদি তথ্যের গরমিল থাকে, তাহলে কোনো কিছুই আর কাজে আসে না। এ কারণে লকডাউনের প্রতি মানুষের আস্থাও নেই। বরং সরকারের দেয়া বিভ্রান্তিকর তথ্যই আতঙ্ক বাড়াচ্ছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধের প্রথম দিনে প্যাডেলচালিত সাধারণ রিকশার পাশাপাশি ঢাকার রাস্তায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পরও গণপরিবহনহীন নগরে দৌরাত্ম্য দেখা গেছে এসব রিকশার। গতকাল প্রথম দিনে রাজধানীর মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, হাজারীবাগ, লালবাগ, মালিবাগ, বাড্ডা, মিরপুর এলাকার সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশার উপস্থিতি দেখা গেছে।

সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, সোমবার সকাল ৬টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ঢাকার রাস্তায় কোনো গণপরিবহন চলাচল করতে পারবে না। তবে চলাচল করবে রিকশা। কিন্তু এর আগেই ব্যাটারিচালিত রিকশাকে রাজধানীতে অবৈধ বিবেচনা করে তা বন্ধ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।

সরকারের এমন ঘোষণায় অনেকটা নড়েচড়ে বসে ব্যাটারিচালিত রিকশার মালিক এবং শ্রমিকরা। ঘোষণার পরদিন থেকে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে আন্দোলনও করে তারা। তবুও অবৈধ এ পরিবহন বন্ধের বিষয়ে অনড় অবস্থানে সরকার। ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে পুলিশকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কিন্তু গতকাল সকাল থেকে ঢাকার অধিকাংশ এলাকায় এ পরিবহনের উপস্থিতি দেখা গেছে। রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে বের হয়েছিলেন মিজান মিয়া। তিনি জানান, তিনি প্রতিদিনই ব্যাটারিচালিত রিকশা চালান। জীবিকার তাগিদে সড়কে বের হয়েছেন তিনি। মিজান বলেন, সরকার তো কত কিছুই কয়। বহুবার কইছে বন্ধ কইরা দিব। বন্ধ তো করে নাই। আমগো তো চলা লাগে। বড় রাস্তায় যাইতে পারি না। তাই মহল্লার মধ্যে চালাই। মিজানের কথায় সুর মেলালেন ব্যাটারিচালিতে রিকশার আরও একজন চালক। সলিম উদ্দিন নামের ওই চালকের বসবাস রায়েরবাগ এলাকায়। তিনি বলেন, লকডাউনে যাত্রী বেশি পাওয়া যাচ্ছে। বেশিরভাগ যাত্রীই মহাসড়কে যাতায়াত করছে। এ কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে রিকশা চালাচ্ছি।

অন্যদিকে, গণপরিবহন না থাকায় গতকাল রাজধানীতে ছিল রিকশার রাজত্ব। সুযোগ পেয়ে রিকশাচালকরা ছিল বেপরোয়া। দ্বিগুণ-তিন গুণ ভাড়া হাঁকতেও দ্বিধা করেনি তারা। গতকাল সকাল থেকে রাজধানীর মতিঝিল, টিকাটুলী, দয়াগঞ্জ, গুলিস্তান, পুরান পল্টন, কাকরাইল এলাকা ঘুরে চোখে পড়েছে রিকশা আর রিকশা। গণপরিবহন বন্ধ থাকার কারণে ব্যাংকসহ জরুরি যেসব অফিস খোলা রয়েছে, তাদের কর্মীরা পড়েছেন বিপাকে। দীর্ঘক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়েও তারা পরিবহন পাননি। অনেকেই পায়ে হেঁটে রওনা হয়েছিলেন গন্তব্যে। গণপরিবহনমুক্ত সড়কে রিকশার আধিপত্য থাকলেও, বিশাল সংখ্যক মানুষের জন্য সেটি পর্যাপ্ত ছিলো না। রিকশাওয়ালারা ভাড়াও হাঁকছেন অনেক বেশি। অনেক রাস্তায় ভ্যানে করেও মানুষকে অফিসে যেতে দেখা গেছে। এর পাশাপাশি ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলে করেও অনেকে অফিসে গিয়েছেন। মতিঝিল শাপলা চত্বরে একজন ব্যাংকার বলেন, ব্যাংকের একটি জরুরি কাজে আমাকে ধানমণ্ডির শংকরে যেতেই হবে। কিন্তু এখন কোনো যানবাহন পাচ্ছি না। রিকশা বা মোটরসাইকেলে যে ভাড়া চাচ্ছে, তা দিয়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। জানি না, কীভাবে যাবো ব্যাংকে। সিদ্ধেশ্বরীর বাসিন্দা বশির উদ্দিন কাজ করেন গুলশানের একটি বেসরকারি সংস্থায়। সিএনজিচালিক অটোরিকশা বা ভাড়ায় চালিত প্রাইভেটকারে অফিস করেন তিনি। খরচ গড়ে প্রতিদিন দেড়শ টাকা। তিনি বলেন, আমাদের তো অফিস খোলা। মানে যেতেই হবে। সিএনজিতে করে দেড়শ টাকায় অফিস চলে যেতাম। আজকে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে তারপর রিকশা করে অফিসে গেলাম ১৮০ টাকায়। জানি না ফেরার সময় কি হবে? ভাড়া যে শুধু বেশি লাগছে, তাই শুধু নয়; অফিসে যেতেও দেরি হয়ে যাচ্ছে। নয়াপল্টনের বাসিন্দা আব্দুল হালিম কাজ করে বারিধারার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। ব্যক্তিগত মোটরসাইকেল নষ্ট হওয়ায় রিকশায় করে অফিসে গিয়েছেন তিনি। বলেন, নয়াপল্টন থেকে কাকরাইল মোড় পর‌্যন্ত টানা এক ঘণ্টা হেঁটে তারপরে মিলেছে রিকশা। ভাড়াও লেগেছে দুইশ টাকা। এ টাকার জ্বালানি মোটরসাইকেলে ভরলে দুই থেকে তিনদিনে আরামে চলতে পারতাম।

অন্যদিকে, নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাজধানীর পাড়া মহল্লায় মার্কেট, বিপনী বিতান, দোকান-পাট সবই খোলা ছিল। মোহাম্মদপুরে দেখা গেছে, মার্কেট খুলে বেচাকেনার অপেক্ষায় ক্রেতারা। যাত্রাবাড়ীর দনিয়া এলাকায় সবগুলো মার্কেটই খোলা ছিল। একই সাথে হোটেল রেস্টুরেন্টও খোলা ছিল। ডেমরা এলাকায় গিয়ে বিধি-নিষেধের কোনো আলামত চোখে পড়েনি। মাতুয়াইল থেকে স্টাফ কোয়ার্টার হয়ে কোনাপাড়া, বামৈল হয়ে যাত্রী নিয়ে ছুটেছে হিউম্যান হলার ও সিএনজি অটোরিকশা। শনির আখড়ার জিয়া সরণীতে অর্ধশতাধিক সিএনজি অটোরিকশা চলাচল করেছে। দনিয়া থেকে ধোলাইপাড় পর্যন্ত শত শত ইজিবাই চলাচল করেছে সকাল থেকেই। শনিরআখড়া বাজারের সূর্যেবানু হোটেলে সকালেও অনেক মানুষ বসে নাস্তা সেরেছেন। দুপুরে দনিয়া বর্ণমালা স্কুল রোডের চাইনিজ রেস্টুরেন্টগুলো ছিল খোলা। সেগুলোতে মানুষকে বসে বসেই খাবার খেতে দেখা গেছে। মিরপুর এলাকায় বড় বড় মার্কেটগুলো বন্ধ থাকলে বিপনী বিতানগুলো খোলাই ছিল। মিরপুরের দিয়াবাড়ীতে অবাধে চলেছে সিএনজি ও ইজিবাইক। একই চিত্র রাজধানীর হাজারীবাগ, রামপুরা, খিলগাঁও, জুরাইন, শ্যামপুর, পুরান ঢাকার লালবাগ, কচুক্ষেত, বাড্ডা, উত্তরখান, দক্ষিণ খান, মিরপুর-১২, শেওড়া পাড়া, কল্যাণপুর, কাজীপাড়াসহ নগরীর বিভিন্ন এলাকায়।

এদিকে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শিমরাইল মোড়ে ঘরমুখো মানুষের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। গত দুদিনের তুলনায় যাত্রী সংখ্যা কম। তবে তিন দিনের সীমিত লকডাউনে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় ভোগান্তিতে পড়তে হয়। মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার ও পিকআপের মাধ্যমে গন্তব্যে রওনা হচ্ছেন অনেক। এতে গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া। এ বিষয়ে কাঁচপুর হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুজ্জামান বলেন, সড়কে আজ গাড়ির চাপ কম। জরুরি কারণ ছাড়া প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস সড়কে চলাচল করলে মামলা দেয়া হচ্ছে।

অন্যদিকে, গতকাল ও হাজার হাজার মানুষ বিভিন্ন উপায়ে ঢাকা ছেড়ে গেছে। অনেকে আবার ঢাকায় এসেছে। মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার শিমুলিয়া ঘাটে দেখা গেছে, হাজারো মানুষের ঢল। গতকাল থেকে শুরু হওয়া লকডাউনের আগেই পরিবার-পরিজন নিয়ে শহর ছাড়ছেন অনেকেই। অনেকেই আবার বাড়ি থেকে শহরে ফিরছেন। এদিকে যাত্রীদের সাথে সাথে বেড়েছে প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাসের সংখ্যাও। সকাল থেকেই ঘাট এলাকায় পারাপারের অপেক্ষায় রয়েছে ৩-৪ শতাধিক গাড়ি। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে দেখা গেছে পুলিশের একাধিক চেকপোষ্ট এড়িয়ে অনেকেই পায়ে হেঁটে বা পণ্যবাহী গাড়িতে করেই যাচ্ছেন।

https://www.dailyinqilab.com/article/393920/