২৯ জুন ২০২১, মঙ্গলবার, ১:২১

আইসিইউতে কাতরাচ্ছে ছেলে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন মা

পঁচিশোর্ধ্ব ইমরান হোসেন। বেঙ্গল মিট নামে একটি প্রতিষ্ঠানে সেলসম্যানের চাকরি করতেন। মগবাজার ওয়্যারলেস গেটে বিকট শব্দে বিস্ফোরণে এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ইমরান। ৯০ শতাংশ দগ্ধ শরীর নিয়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি। আইসিইউর বাইরে চলছে তার স্বজনদের হৃদয়বিদারক আহাজারি। কেউ বুক চাপড়াচ্ছেন, কেউ অচেতন হয়ে পড়ছেন, কেউ মাথা ঠুকে কান্না করছেন। ইমরানের মা লিজা আক্তার আল্লাহর দরবারে ছেলের প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে দু’হাত তুলে বুক ভাসাচ্ছেন কেঁদে কেঁদে। তার পাশেই অচেতন হয়ে পড়ে আছেন ইমরানের স্ত্রী তামান্না। মেয়ের মাথা কোলে নিয়ে বসে অজোরে কাঁদছেন ইমরানের শাশুড়ি তাসলিমা বেগম। ভাইয়া আমাদের ছেড়ে যেও না বলতে বলতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে বোন আইরিন। সবার একটিই চাওয়া মৃত্যুর কোল থেকে ফিরে আসুক তাদের ইমরান। গতকাল সোমবার দুপুরে রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের আইসিইউ ইউনিটে গিয়ে এমন মর্মস্পর্শী দৃশ্য চোখে পড়ে। শুধু ইমরান হোসেনই নয় মগবাজারের বিস্ফোরণে বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি প্রত্যেকের স্বজনরাই এখন দিশেহারা।

এদিকে ঢাকা মেডিক্যাল মর্গে স্বজনদের সাথে বাবা আবুল কাশেমের লাশ নিতে এসেছে ছোট্ট মেয়ে মিম। বাবার একমাত্র আদরের দুলালী। এই মেয়েকে ঘিরে বাবার কতই না স্বপ্ন ছিল। মিমের মা সোহাগী বেগমের ডান পা প্যারালাইজড হয়ে আছে দু বছর ধরে। স্ত্রীকে ভারতে নিয়ে চিকিৎসা করানোর কথা ছিল তার। তাইতো প্রতিদিন সকাল হতে না হতেই গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যেতেন উপার্জনের আশায়। রাতে যখন বাবা ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরতেন অমনি বাবাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরত মিম। আজ মিমের বাবা নেই। নেই বাবার আদরও। তাই মেয়েটি কাঁদছে আব্বু আব্বু বলে। হঠাৎ ভয়াবহ বিস্ফোরণ মিমের বাবাকে বাঁচতে দিলো না। অনেক কষ্ট করে ১৩ লাখ টাকা ঋণ করে একটি বাস কিনেছিলেন আবুল কাশেম। এখনো ঋণ শোধ হয়নি। অসুস্থ শরীরে স্বামীর লাশ দেখে বিলাপ করছেন মিমের মা সোহাগী বেগম। তার চিৎকার আর আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গের পরিবেশ। এক সময় জ্ঞান হারান সোহাগী। এ সময় মাকে জড়িয়ে ধরে ছিল ছোট্ট মিম। শেষ বিকেলে এক রাশ অনিশ্চয়তা আর মলিন মুখে বাবার লাশ অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে মায়ের সাথে রওনা হয় মিম। এমন একাধিক বেদনাবিধুর ঘটনা জড়িয়ে আছে মগবাজার ট্র্যাজেডিতে।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ইমরানের বোন আইরিন চোখ মুছতে মুছতে বলেন, আমার বাবা আবদুল মজিদ মিয়া কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে লিফটম্যানের চাকরি করেন। আমি বাবা-মার সাথে শান্তিনগরের একটি বাসায় থাকি। ভাইয়া (ইমরান) বিস্ফোরণ ঘটা ভবনের নিচতলায় বেঙ্গল মিট নামে একটি দোকানে সেলসম্যানের চাকরি করে। তিন বছর আগে বিয়ে করে ভাইয়া। এরপর থেকে ভাবীকে নিয়ে মগবাজারের একটি বাসায় সাবলেট থাকেন ভাইয়া। রোববার সন্ধ্যায় বিস্ফোরণের পর মগবাজারের একটি হাসপাতাল থেকে ফোন দিয়ে দ্রুত সেখানে যেতে বলা হয়।

আমি আর আম্মু সিএনজিতে ওঠার পর আবার ফোন দিয়ে দ্রুত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আসতে বলা হয়। এখানে এসে ভাইয়ার চেহারা চেনার উপায় ছিল না বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন আইরিন। পাশে থাকা তার মা লিজা আক্তার, বুক চাপড়াতে চাপড়াতে বলতে থাকেন, পোলাডা খালি কইলো, মা আমি, মা আমি। আর কিছুই বলতে পারল না। কত কষ্ট পাচ্ছে পোলাডা। আমার কোলে ফিরে আয় আব্বা। তোর কিছু হবে না। লিজার মতোই অন্য পাশে কান্না করছিলেন আইসিইউতে থাকা নুরনবী মন্ডলের স্ত্রী পপি আক্তার। গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ীর পাংশায় হলেও জীবিকার তাগিদে স্ত্রী ও ছয় বছরের ছেলে আবদুল্লাহ আল মামুনকে গ্রামে রেখে ঢাকায় ভ্যান চালান নুরনবী। গত ২২ দিন আগে গ্রাম থেকে বেরিয়ে আসেন। থাকতেন এলিফ্যান্ট রোডের একটি মেসে। পপি আক্তার বলেন, ও চলে গেলে আমাদের কী হবে? ছেলেটাকে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করেছি। কত স্বপ্ন, বলতেই চোখ গড়িয়ে অনর্গল পানি পড়তে শুরু করে পপির। দূর পানে তাকিয়ে আর কথা বলতে চাইলেন না। দোয়া করতে বলে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। বার্ন ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডা: সামন্ত লাল সেন বলেন, বর্তমানে পাঁচজনকে ভর্তি রাখা হয়েছে। এদের মধ্যে আইসিইউতে থাকা ইমরান হোসেন ও নুরনবী এবং এইচডিওতে থাকা রাসেলের শরীরে ৯০ শতাংশ দগ্ধ থাকায় অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক। জাফর ও কালু নামে দুজনকে ওয়ার্ডে ভর্তি রাখা হয়েছে। তারাও শঙ্কামুক্ত নয়।
এদিকে, বার্ন ইউনিটের মতোই আহাজারি চলছে ঢাকা মেডিক্যালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে। ১০২ নম্বর ওয়ার্ডের ১ নম্বর বেডে গিয়ে দেখা যায়, পুরো মাথা, দুই হাত ও পেট ব্যান্ডেজে মোড়া এইচ এম কামাল হোসেন ব্যথায় কাতরাচ্ছেন। পায়ের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষত চিহ্ন থাকায় নড়াচড়া করতে পারছেন না। বিস্ফোরণে আগুনের স্ফুলিঙ্গ চোখে লাগায়, চোখ খুলতে পারছেন না। কথা বলারও যেন শক্তি নেই। তবে, বিড় বিড় করে স্ত্রী ছানোয়ারা খান সানুকে যন্ত্রণার কথা বলছেন। আর কান্নায় চোখ ভাসাচ্ছেন ছানোয়ারা। স্বামী চোখ খুলতে না পারায় ছানোয়ারা অন্যদের বলতে থাকেন, বিয়ের ১০ বছরেও বাচ্চা হইলো না, যাকে নিয়ে বাঁচব সে চোখটাও খুলতে পারছে না। ওর কিছু হয়ে গেলে কী নিয়ে বাঁচব আমি।

জানতে চাইলে ছানোয়ারা বলেন, শাহজাহানপুরে শ্বশুরবাড়িতে থেকে টিউশনি করাতেন একসময়ের গফরগাঁওয়ের ধরলা স্কুল অ্যান্ড কলেজের লেকচারার ছিলেন কামাল হোসেন। করোনার সময় ছাত্র না থাকায় তারা গ্রামে চলে যান। মগবাজারের একটি দোকানে অর্ডার করা চশমা আনতে গিয়ে আহত হন কামাল। সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে কামাল ফিস ফিস করে বলেন, কারা যেন আমার পকেটে থাকা ২০ হাজার টাকা ও মোবাইল নিয়ে গেছে। আমি দেখতে পারি নাই। তাকাতে পারছিলাম না। পুলিশ সাত হাজার টাকা ফেরত দিলেও চিকিৎসার খরচ বাবদ আড়াই হাজার টাকা নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ করেন ছানোয়ারা। একই ওয়ার্ডের ১৭ নম্বর বেডে কাতরাতে দেখা যায় বরিশাল বিএম কলেজের মাস্টার্স বাংলা বিভাগের ছাত্র মো: হৃদয় হোসেনকে। তিনি বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত আল-মক্কা বাসে ছিলেন।

ঢাকা মেডিক্যালের জরুরি বিভাগের আবাসিক সার্জন মোহাম্মদ আলাউদ্দিন জানান, তিনজন ভর্তি আছেন। তাদের সুস্থতার বিষয়ে তারা আশাবাদী।

স্বজনের আর্তনাদ আর আহাজারি : অ্যাম্বুলেন্স থেকে ব্যান্ডেজে মোড়া একটি লাশ নামানো হচ্ছে মর্গে। লাশের পাশে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে কয়েকজন যুবক। কাছে গিয়ে জানা গেল, লাশটি বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত রেডিও ধ্বনির আরজে মোস্তাফিজুর রহমানের। লাশটি মর্গের ভেতরে নেয়া হলেও পানিতে টলমল করা দৃষ্টিতে সেদিকে নির্বাক তাকিয়ে আছে নাঈম নামে এক যুবক। সে মোস্তাফিজের সাথে একই মেসে থাকে এবং এক সাথে কবি নজরুল সরকারি কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষে পড়েন। জানতে চাইলে নাঈম বলেন, ও খুব ভালো আবৃত্তি করত। কণ্ঠ ভালো হওয়ায় মনোযোগ দিয়ে কথা শুনতাম। এখন আর কেউ আবৃত্তি করে শোনাবে না। সময় মতো খেয়েছি কিনা সেই খোঁজও নিবে না। এসময় পাশে বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল মোস্তাফিজের মাদরাসার বন্ধু আরিফসহ আরো ৩-৪ যুবক। সবার চোখে মুখে শোকের ছায়া। মোস্তাফিজ গফরগাঁওয়ের আবদুর রাজ্জাকের ছেলে। শনিরআখড়ায় একটি মেসে থাকতেন। ডাক্তার দেখিয়ে ওয়ারলেস অফিসে যাওয়ার সময় এ ঘটনা ঘটে বলে জানান নাঈম।

মোস্তাফিজের মতোই ময়নাতদন্তের জন্য আরো তিনটি লাশ মর্গে নেয়া হয়। তারা হলেন, মগবাজার আড়ংয়ের সিনিয়র সেল্সম্যান জয়পুরহাটের পাঁচবিবি এলাকার ডা: খয়বার মণ্ডলের ছেলে রুহুল আমিন নোমান, ক্ষতিগ্রস্ত আজমেরী বাসের চালক ও মালিক কুমিল্লা চৌদ্দগ্রামের উনকুট গ্রামের বাসিন্দা আবুল কাশেম মোল্লা (৪৫), প্রাইভেটকার চালক মগবাজার চেয়ারম্যান গলির বাসিন্দা স্বপন (৩৫)। ময়নাতদন্ত শেষে তাদের লাশ তখন পরিবারের কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছিল। তাদের স্বজনদের মধ্যেও দেখা যায় শোকের মাতম। এ ঘটনায় নিহত জান্নাত কাকলী ও তার ৯ মাস বয়সী মেয়ে সোবহানা তাইয়েবার লাশ ইতোমধ্যে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানান ডিএমপি রমনা বিভাগের ডিসি সাজ্জাদুর রহমান।

এদিকে, বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহতদের দাফনের জন্য পরিবারকে ২০ হাজার ও আহতদের পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে দিয়েছে ঢাকা জেলা প্রশাসক।

খোঁজ মিলছে না কেয়ারটেকার হারুনের : বিস্ফোরণের পর থেকে হারুনর রশিদ (৬৫) নামে এক বৃদ্ধ নিখোঁজ রয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তার মেয়ে হেনা বেগম এই হাসপাতাল থেকে ওই হাসপাতালে ছুটে বেড়াচ্ছেন বাবার খোঁজে। যে ভবনে বিস্ফোরণ হয়, সেখানে তিনি কেয়ারটেকার হিসেবে প্রায় আড়াই বছর ধরে চাকরি করেন। একাই একটি কক্ষে থাকতেন বলে জানা গেছে। হারুনর রশিদের মেয়েজামাই জুলহাস মিয়া বলেন, রোববার রাত থেকে খুঁজতেছি। পাঁচ থেকে সাতটা হাসপাতালে ঘুরছি, পাই নাই। থানায় গিয়ে জানাব। দেখি কী হয়।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/591341