২৯ জুন ২০২১, মঙ্গলবার, ১:২০

রিকশার শহরে পরিণত রাজধানী

বিধিনিষেধে বাড়ছে ভোগান্তি

দুপুর তখন ১২টা। যাত্রাবাড়ী মোড়ে কম হলেও দুই শ’ রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। যাত্রীসংখ্যাও কম নয়। গণপরিবহন নেই। সিএনজি অটোরিকশা যে দু-চারটি চলছে, তা খালি নেই। রিকশাই ভরসা যাত্রীদের। কিন্তু ভাড়ার কথা শুনে মাথায় হাত। ৩০ টাকার ভাড়া ১০০ টাকা! বাধ্য হয়ে যাত্রীরা রিকশায় চড়ছেন। হেঁটে আর কত যাওয়া যায়। এই ছিল গতকালের রাজধানীর চিত্র। রাস্তায় কেবল রিকশা আর রিকশা। প্রাইভেট গাড়ির সংখ্যাও কম নয়। পথচারীদের মন্তব্য, ‘করোনা শুধুই বাসের জন্য। আর তো কিছুই বন্ধ নেই। অযথা বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে পথচারীদের।’

করোনার বিধিনিষেধের কারণে গতকাল সোমবার থেকে গণপরিবহন বন্ধ রয়েছে। রাজধানীতে গতকাল কোনো যাত্রীবাহী বাস চলতে দেখা যায়নি। তবে রিকশা, সিএনজি অটোরিকশা, অটোরিকশা, লেগুনা ও প্রাইভেট কারসহ অন্যান্য যানবাহন চলতে দেখা গেছে। একাধিক পথচারী বলেছেন, কর্মস্থল সচল। কর্মস্থলে না গিয়ে কোনো উপায় নেই। বাধ্য হয়ে বাসা থেকে বের হতে হয়েছে। না হলে চাকরি থাকবে না। সুজন নামের এক পথচারী গতকাল বলেন, তিনি থাকেন যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়ায়। চাকরি করেন পল্টনের একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে। প্রতিদিন বাসে করেই যাতায়াত করেন। কিন্তু গতকাল বাস বন্ধ থাকায় তাকে চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয়। তিনি বলেন, অফিসে না গেলে চাকরি থাকবে না। চাকরি না থাকলে এ সময় কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন। বাধ্য হয়েই রাস্তায় বের হয়েছেন। শনির আখড়া থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত হেঁটে এসেছেন। মনে করেছিলেন, যাত্রাবাড়ী গিয়ে গাড়ি পাবেন। কিন্তু এসে দেখেন কোনো বাস নেই। আর হাঁটতেও পারছিলেন না। যাত্রাবাড়ী থেকে পল্টন পর্যন্ত দুই শ’ টাকা দিয়ে রিকশায় গেছেন। অথচ এই রাস্তাটুকুর জন্য অতিরিক্ত হলে ৮০-১০০ টাকা ভাড়া হওয়ার কথা। সুজন জানান, এত টাকা রিকশা ভাড়া দিয়ে যাতায়াত করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি বলেন, ধনী মানুষের জন্য কোনো বিধিনিষেধ নেই। প্রাইভেট কার ঠিকই চলছে।

গতকাল বিকেলে মতিঝিল এলাকায় গিয়ে দেখা যায় তুঘলকি কাণ্ড। পুরো এলাকায় রিকশা আর রিকশা। এরা যাত্রী বহনের জন্য বসে আছে। আর ভাড়া কয়েক গুণ। যারা যাবেন, তারা বাধ্য হয়েই বেশি ভাড়া দিয়ে যাবেন; রিকশাচালকদের এটিই টার্গেট! সেলিম নামের এক যাত্রী জানালেন, সারাদিন অফিস করে হেঁটে বাসায় যাওয়ার মতো শক্তি নেই। বাধ্য হয়ে দুই শ’ টাকা ভাড়া দিয়ে বাসাবো যাচ্ছেন। সেলিম জানান, এভাবে আর সম্ভব হবে না।

গতকাল রাজধানীর সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, মার্কেট-বিপণিবিতান, সরকারি-বেসরকারি অফিস খোলাই ছিল। একাধিক পথচারী বলেছেন, এগুলো খোলা রেখে বিধিনিষেধ আরোপ করা অনেকটাই ‘হাস্যকর’। কর্মস্থল খোলা থাকলে মানুষকে রাস্তায় নামতে হবে। সে ক্ষেত্রে মানুষের ভোগান্তি আরো বাড়ছে। গতকাল বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, প্রাইভেট কারগুলো অতিরিক্ত ভাড়ায় যাত্রী বহন করা হচ্ছে। প্রাইভেট নাম দিয়ে যাত্রী বহন করা হচ্ছে ওই সব গাড়িতে। কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব পরিবহনে তাদের কর্মীদের আনা-নেয়া করছে। রাজধানীর গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা থাকলেও তাদের কর্মীদের আনা-নেয়ার ব্যাপারে অধিকাংশেরই নিজস্ব কোনো ব্যবস্থা নেই।

শিমুলিয়ায় যাত্রীর চাপে ফেরিতে পণ্যবাহী গাড়ি পারাপার ব্যাহত
মুন্সীগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, লকডাউনের নির্দেশনা অনুযায়ী মাওয়ার শিমুলিয়া-মাদারীপুরের বাংলাবাজার নৌরুটে শুধু পণ্যবাহী ও জরুরি গাড়ি পারাপারে সচল রয়েছে ফেরি। কিন্তু গতকাল সোমবার সকাল থেকে দলে দলে মানুষ ফেরিতে উঠেছে। বিধি উপেক্ষা করে শিমুলিয়া ঘাটে উপস্থিত হওয়া দক্ষিণবঙ্গগামী হাজারো যাত্রী পারাপার হয় সকাল থেকে। হাইওয়ে দিয়ে সিএনজি অটোরিকশা, লেগুনা চলাচল করছে এখনো। ফলে যাত্রীরা অনায়াসেই শিমুলিয়া ঘাটে এসে পৌঁছে যাচ্ছে।

গত রোববার যাত্রী ও ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যাপক চাপ থাকায় দিনভর ব্যাহত হয় পণ্যবাহী গাড়ি পারাপার। ফলে ঘাট এলাকায় একদিকে তৈরি হয় এসব গাড়ির দীর্ঘ সারি, অন্য দিকে ভোগান্তিতে পড়েন শত শত ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান চালক। ১৮ থেকে ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় অপেক্ষা করেও ফেরিতে উঠতে পারেননি এ সব গাড়ির চালকরা।

গতকাল সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় দেখা যায়, ফেরিতে উঠার অপেক্ষায় রয়েছে প্রাইভেটকারসহ অন্তত ৪ শতাধিক ট্রাক। এর মধ্যে কোনো চালক ৮ ঘণ্টা, কেউ ১৮ ঘণ্টা আবার অনেকে ২৪ ঘণ্টা অপেক্ষা করেও ফেরিতে উঠতে পারেননি। লকডাউনে দোকান বন্ধ থাকায় খাবার কেনাসহ বিভিন্ন সমস্যা পোহাতে হয়েছে তাদের। বিশেষ করে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে তাদের বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার কারণে আর্থিক ক্ষতি আর খাবারের কষ্টে চরম দুর্ভোগে পড়েন এসব চালক। ট্রাকচালক জমির বলেন, ‘লকডাউনে ঘাটের দোকানপাট বন্ধ। আমাদের খেয়ে না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। আর সাধারণ মানুষ আসছে-যাচ্ছে। আমাদের দেখার কেউ নেই। একদিন গাড়ি নিয়ে বসে থাকলে ৩-৪ হাজার টাকা লোকসানের কবলে পড়তে হচ্ছে।’

এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিসি শিমুলিয়া ঘাটের সহকারী ব্যবস্থাপক সাফায়েত আহমেদ বলেন, ‘রোববার দিনভর ঘাটে যাত্রীদের প্রচণ্ড চাপ ছিল। তাই পণ্যবাহী গাড়ি পারাপার কিছুটা ব্যাহত হয়েছে। এখনো লোকজন আসছে। তবে অপেক্ষমাণ পণ্যবাহী ট্রাক রয়েছে সারিবদ্ধ। প্রাইভেট কার ও যাত্রীর চাপ রয়েছে আজকেও।’ তিনি বলেন, যাত্রীদের ক্ষেত্রে আমাদের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা নেই। তবে গণপরিবহন বন্ধ থাকার নির্দেশনা রয়েছে। ঘাটে যারা আসছে তারা পার হচ্ছে। বর্তমানে নৌরুটে ১৪টি ফেরি সচল রয়েছে।

দৌলতদিয়া ফেরিঘাট ফাঁকা
গোয়ালন্দ ও বালিয়াকান্দি (রাজবাড়ী) সংবাদদাতা জানান, গত কয়েকদিন যাবৎ দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া রুটের দৌলতদিয়া ফেরি ঘাটে ঘরমুখো যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় ছিল। ব্যস্ততম এই ঘাটে গতকাল সোমবার সকাল থেকে যাত্রীর সংখ্যা কমেছে। যে সব ফেরি পণ্যবাহী ট্রাক নিয়ে পাটুরিয়া ঘাট থেকে ছেড়ে আসছে সেগুলোতে যাত্রীর সংখ্যা গত কয়েক দিনের চেয়ে অনেক কম। তবে প্রতিটি ফেরিতে ব্যক্তিগত যানবাহন দেখা যায়। এ দিকে মহাসড়কে গণপরিবহন না থাকলে রয়েছে অটোবাইক, তিন চাকার ইঞ্জিনচালিত বিভিন্ন প্রকার গাড়ি ও মোটরসাইকেল। এ সব যানবাহনে যাত্রীরা চলাচল করছে।

বিআইডব্লিউটিসির দৌলতদিয়া ঘাট শাখার ব্যবস্থাপক ফিরোজ শেখ জানান, পণ্যবাহী ট্রাক ও জরুরি যানবাহন পারাপার করার জন্য দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া রুটে ফেরি চলাচল স্বাভাবিক রাখা হয়েছে। সেই সাথে যাত্রীও আসছে। তবে গত কয়েক দিনের চেয়ে যাত্রী অনেক কম।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/591343