রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা রোগীদের ভর্তি করা নিয়ে স্বজনদের ছোটাছুটি। ছবি:যুগান্তর
২১ জুন ২০২১, সোমবার, ১২:৩৮

করোনায় ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু ৮২, খুলনা বিভাগেই ৩২

ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের দাপট

দুই সপ্তাহে নমুনা পরীক্ষার হার ২২, শনাক্তের হার ৫৫, মৃত্যুহার ৪৬ শতাংশ বেড়েছে

এ পর্যন্ত বিশ্বের সর্বোচ্চ সংক্রমণশীল ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রভাবে দেশে করোনায় শনাক্ত ও মৃত্যুহার উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। মাত্র দুই সপ্তাহে নমুনা সংগ্রহের হার বেড়েছে ২২ শতাংশ। শনাক্তের হার বেড়েছে ৫৫ শতাংশ। এই সময়ে শনাক্ত রোগীর মৃত্যুহার বেড়েছে ৪৬ শতাংশ। শনাক্ত ও মৃত্যুর হার এভাবে বাড়তে থাকলে দেশের করোনা পরিস্থিতি আশঙ্কাজনকভাবে অবনতি ঘটতে পারে।

গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্তদের মধ্যে ৮২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে খুলনা বিভাগেই মারা গেছেন ৩২ জন। করোনা শনাক্তের পর এটাই একদিনে এ বিভাগে সর্বোচ্চ মৃত্যু।
সব মিলিয়ে করোনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৫৪৮। ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে নতুন করে আরও ৩ হাজার ৬৪১ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়েছে। আগের দিন শনাক্ত হয়েছিল ৩ হাজার ৫৭ জন।

এ নিয়ে করোনায় শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ৫১ হাজার ৬৬৮। সরকারি হিসাবে আক্রান্তদের মধ্যে একদিনে আরও ২ হাজার ৫০৯ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। এ পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ৭ লাখ ৮২ হাজার ৬৫৫ জন। রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সবচেয়ে সংক্রমণশীল। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, এই (ডেল্টা) ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণশীলতা ২ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ ডেল্টা আক্রান্ত একজন রোগী থেকে কমপক্ষে তিনজন সংক্রমিত হতে পারে। বর্তমানে দেশে করোনা শনাক্তের ৬৮ শতাংশই প্রাণঘাতী এই (ডেল্টা) ভাইরাসের শিকার।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, দেশে কোভিডে শনাক্ত ও মৃত্যুহার উদ্বেগজনক। শনিবার পরীক্ষিত নমুনার শতকরা ১৮ শতাংশের বেশি শনাক্ত হয়েছে। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, টাঙ্গাইলে শনাক্তের হার বেশি দেখা যাচ্ছে। রাজশাহীতে শনাক্তের হার ১৭ শতাংশের বেশি। খুলানার অবস্থা বেশ উদ্বেগজনক। বর্তমানে নাটোরে শনাক্তের হার ৩৭ শতাংশ, নওগাঁয় ৩৫, খুলনায় ৩৮, চুয়াডাঙ্গায় ৩৬ এবং সীমান্তবর্তী যশোর জেলায় ৩৮ শতাংশ। দেশের অন্য যে কোনো স্থানের তুলনায় এ জেলাগুলোয় সংক্রমণের হার বেশি। রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত বুলেটিনে তিনি এসব তথ্য জানান।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জানুয়ারিতে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ২১ হাজার ৬২৯ জন। এরপর মার্চ থেকে রোগী বাড়তে শুরু করে। এপ্রিলে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১ লাখ অতিক্রম করে। ২০ জুন পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৪৭ হাজার ছড়িয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ের রোগতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, সংক্রমণের ২৩তম সপ্তাহে (৬ থেকে ১২ জুন) ১ লাখ ২২ হাজারের বেশি নমুনা সংগৃহীত হয়েছে। ২৪তম সপ্তাহে (১৩ থেকে ১৯ জুন) সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৯ হাজার ১৪০টিতে। নমুনা বৃদ্ধির হার ২২ দশমিক ১৪ শতাংশ এবং শনাক্ত বৃদ্ধির হার ৫৫ দশমিক ১৬ শতাংশ। মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে মৃত্যুহার বেড়েছে ৪৬ দশমিক ৩০ শতাংশ। ১ থেকে ১২ জুন যেখানে মৃত্যু হয়েছিল ২৭০ জন, সেখানে ১৩ থেকে ১৯ জুন মৃত্যু হয়েছে ৩৯৫ জনের।

বিগত ৭ দিনে শনাক্তের হার ক্রমবর্ধমান হারে বাড়তে শুরু করেছে। অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা গেছে, ১৩ জুন শনাক্তের হার ছিল ১২ দশমিক ৯৯ শতাংশ, ১৪ জুন ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ, ১৫ জুন ১৪ দশমিক ২৭ শতাংশ, ১৬ জুন ১৬ দশমিক ৬২ শতাংশ, ১৭ জুন ১৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ, ১৮ জুন ১৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ এবং ১৯ জুন ১৮ দশমিক ২ শতাংশ। মাত্র সাতদিনের ব্যবধানে শনাক্তের হার বেড়েছে ৬ শতাংশ, যা একই সঙ্গে উদ্বেগ ও আতঙ্কের।

অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশও কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সক্ষমতা বাড়িয়ে চলেছে। নমুনা পরীক্ষা ল্যাবের সংখ্যা, হাসপাতালের শয্যা ও আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) শয্যা অনেক বাড়ানো হয়েছে। এ ধরনের সুবিধা আরও বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানতে তিনি দেশবাসীর প্রতি অনুরোধ জানান।

সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে করোনা শনাক্তের ৬৮ শতাংশই প্রাণঘাতী এই (ডেল্টা) ভাইরাসের শিকার। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র-আইসিডিডিআর,বির গবেষণায় এমন তথ্য পাওয়া গেছে। আইসিডিআির,বির সিনিয়র সায়েন্টিস্ট ও ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান ড. মোস্তাফিজুর রহমান গণমাধ্যমকে জানান, মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু করে জুনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এই সময়ের করোনা পরিস্থিতি বিশ্লেষণের জন্য তারা ৬০টি নমুনার জিনোম সিকুয়েন্সিং করেন। যার মধ্যে ৬৮ শতাংশ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। অর্থাৎ বর্তমানে শনাক্ত প্রতি ১০০ জন রোগীর মধ্যে ৬৮ জনের বেশি মানুষ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দ্বারা সংক্রমিত, যা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়েছিল গত বছর ৮ মার্চ। তা আট লাখ পেরিয়ে যায় এ বছর ৩১ মে। সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যে ৭ এপ্রিল রেকর্ড ৭ হাজার ৬২৬ জন নতুন রোগী শনাক্ত হন। গত বছরের ১৮ মার্চ দেশে প্রথম মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর আড়াই মাস পর ১০ জুন মৃতের সংখ্যা ১ হাজার ছাড়ায়।

এরপর ৫ জুলাই ২ হাজার, ২৮ জুলাই ৩ হাজার, ২৫ আগস্ট ৪ হাজার, ২২ সেপ্টেম্বর ৫ হাজার ছাড়ায় মৃতের সংখ্যা। এরপর দেশে মৃত্যু কিছুটা কমতে থাকে। ৪ নভেম্বর ৬ হাজার, ১২ ডিসেম্বর ৭ হাজারের ঘর ছাড়ায় মৃত্যু।

এ বছরের ২৩ জানুয়ারি ৮ হাজার এবং ৩১ মার্চ মোট মৃত্যুর সংখ্যা ৯ হাজার ছাড়ায়। সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর ১৫ দিনেই এক হাজার কোভিড-১৯ রোগীর মৃত্যু ঘটে। ১৫ এপ্রিল মৃতের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। এর পরের এক হাজার মানুষের মৃত্যু হয় মাত্র ১০ দিনে।

মোট মৃতের সংখ্যা ১১ হাজার ছাড়িয়ে যায় ২৫ এপ্রিল। এর ১৬ দিন পর ১১ মে করোনাভাইরাসে মৃত্যু ১২ হাজার ছাড়িয়ে যায়। এর সঙ্গে আরও এক হাজার নাম যুক্ত হতে সময় লাগে এক মাস। ১১ জুন করোনায় মৃত্যু ছাড়ায় ১৩ হাজার। এরপর নয়দিনে করোনায় কেড়ে নিয়েছে আরও ৫০০ জনের প্রাণ।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/433935/