২৮ জুন ২০২১, সোমবার, ২:১৮

লকডাউন নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের মতো দোদুল্যমান রাজধানীর খেটেখাওয়া মানুষ

দেশে মহামারি করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় সরকারের পক্ষ থেকে একেক সময় একেক সিদ্ধান্তের কথা জানানো হচ্ছে। মহামারির এ বিস্তার রোধে অথেনটিক সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না সরকার। টিকার মজুদ না থাকায় দিশেহারা হয়ে বিভিন্ন দেশের সরণাপন্ন হচ্ছেন। আবার দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা মাথায় রেখে পূর্ণ লকডাউন দিতেও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। কঠোর লকডাউন দেওয়া নিয়ে দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছে সরকার। একই রকম অবস্থা রাজধানীর খেটে খাওয়া মানুষের। পূর্ণ লকডাউন দেওয়া হলে তারা কি করবেন কি খাবেন তার কূলকিনারা করতে পারছেন না। কঠোর লকডাউন দিলে তা কতদিন স্থায়ী হবে এ সব চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে তাদের মাথায়। এমতাবস্থায় রাজধানীতে থাকবেন না-কি গ্রামে চলে যাবেন এমন দোদুল্যমান অবস্থায় আছেন এ সব দরিদ্র জনগোষ্ঠী। সরকারের লকডাউন পরিকল্পনার সাথে এসব জনগোষ্ঠীর কি হবে এমন নির্দেশনা না থাকায় কেউ কেউ রাজধানীতে থাকার চিন্তা করছে। আবার অনেকে কঠোর লকডাউনের আগেই ঢাকা ছাড়তে মরিয়া। তবে গ্রামে গিয়ে কি করবেন সে ব্যাপারেও রয়েছে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা।

তথ্য বিশ্লষণে দেখা যায়, করোনা সংক্রমণ রোধে সিদ্ধান্ত নেয়া এবং পরিবর্তন করা শুরু থেকেই এটা চলে আসছে। করোনা সংক্রমণের সর্বশেষ কঠোর লকডাউনের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটলো। শুক্রবার রাতে সরকারি দপ্তরের বার্তা পাওয়া গেল, সোমবার থেকে কঠোর লকডাউন। জানানো হলো, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বের হওয়া যাবে না। কিছুক্ষণ পর জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন জানালেন, পুলিশ-বিজিবির পাশাপাশি মোতায়েন হতে পারে সেনাবাহিনী। তিনিও নিশ্চিত করলেন, সোমবার থেকেই কঠোর লকডাউন। বলা হলো শনিবার সব বিস্তারিত জানানো হবে। কিন্তু জানানো হলো নতুন খবর। বলা হলো, সর্বাত্মক লকডাউন শুরু হবে বৃহস্পতিবার থেকে। যা বুঝা গেলো, সোমবার থেকে হবে হালকা লকডাউন। করোনা মোকাবিলায় দেশে দেশে লকডাউনের মতো নানা পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে বাস্তবতা কতা আমলে নেয়া হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেছে। এদেশে হোম কোয়ারেন্টিন সম্ভব নয় বলে প্রায় সবাই একমত। কিন্তু এটা চলেই আসছে।

দেখা যাচ্ছে নানা ফরম্যাটে লকডাউন চলছে দফায় দফায়। কিন্তু কখনই খেটে খাওয়া মানুষকে সহযোগিতার বিষয়টি সেভাবে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। এদেশের জনগোষ্ঠীর একটি বিপুল অংশই প্রতিদিন, সপ্তাহ অথবা মাসিক আয়ের ওপর নির্ভরশীল। আয় বন্ধ হয়ে গেলে তাদের বাসার চুলা বন্ধ হয়ে যায়। যেকোনো কার্যকর লকডাউনের ক্ষেত্রেই এসব নাগরিককে রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা করা প্রয়োজন।

এটা সত্য, করোনা পরিস্থিতি আবার নিয়ন্ত্রণহীন। যেহেতু দেশের মানুষের উল্লেখযোগ্য অংশকে টিকা দেয়া সম্ভব হয়নি তাই লকডাউনের মতো ব্যবস্থার খুব বেশি বিকল্পও নেই। তবে এক্ষেত্রে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সহযোগিতা।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, লকডাউন কার্যকর করতে হলে সাম্যতার প্রয়োজন হয়। গণপরিবহন বন্ধ থাকবে কিন্তু ব্যক্তিগত যানবাহন চলবে এটা হয় না। পোশাক কারখানা খোলা থাকবে কিন্তু দোকানপাট বন্ধ থাকবে সেটাও হয় না। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সব বন্ধ রাখতে হবে। করোনা ছাড়ানো বন্ধ করতে হলে সঠিকভাবে লকডাউন কার্যকর করতে হবে। এরজন্য অতীতে সঠিক কোনো পরিকল্পনা ছিলো না। ফলে সফল হয়নি। এবার যে কঠোর লকডাউনের কথা বলা হচ্ছে তার জন্য পরিকল্পনা কী তা এখনো স্পষ্ট নয়।

একই ধরনের কথা জানান বিএসএমইউ'র সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল ইসলাম। তিনি জানান, লকডাউনের আগে একটি প্রস্তুতি থাকতে হয়। লকডাউনের সময় পুরো দেশ কিভাবে চলবে। জরুরি সেবাসহ খাদ্য ও পণ্য সরবরাহ কিভাবে হবে তার গাইডলাইন থাকতে হয়। লকডাউন মানতে আইনের প্রয়োগ করতে হয়। কিন্তু এখনো সেই পরিকল্পনা স্পষ্ট নয়। লকডাউনে গরিব মানুষ কী খাবে। তাদের ঘরে রাখা যায় কীভাবে তার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা দিতে হয়। তাদের যদি খাবার না থাকে, আয় না থাকে তাহলে তাদের ঘরে আটকে রাখা যাবে না। তাই তাদের যা প্রয়োজন তার ব্যবস্থা করতে হবে। আর মানুষ যাতে ঘরে বসে খাদ্য ও জরুরিসেবা পেতে পারে তার সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে না পারলে লকডাউন কার্যকর করা অসম্ভব।

এদিকে করোনা সংক্রমণ রোধে সারাদেশ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে রাজধানীকে। ঢাকার চারপাশের জেলাগুলোতে ‘লকডাউন’ ঘোষণায় এবং সড়কে কড়া পুলিশ পাহারা চলছে। অতীতের তুলনায় এবারের ‘লকডাউনে’ যান ও জনসাধারণের চলাচল নিয়ন্ত্রণে অনেক কঠোরতা দেখা গেছে। করোনার বিপজ্জনক ভারতীয় ধরন ঠেকাতে আকস্মিক বিধিনিষেধ জারি করায় যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে কঠোরতা আরোপে জনদুর্ভোগ হচ্ছে। স্বল্প সময়ের ঘোষণা ও ব্যবধানে ‘লকডাউন’ কার্যকর করায় অনেকে পথে নামার পর জানতে পারেন, ঢাকা থেকে বেরোনো ও প্রবেশের পথ বন্ধ। অনেকে হেঁটে ঢাকা ছেড়েছেন বা ঢাকায় প্রবেশ করেছেন। বিশেষ করে যারা আশপাশের জেলা থেকে ঢাকায় এসে অফিস করেন কিংবা ঢাকা থেকে আশপাশের জেলা-উপজেলায় অফিস করেন, তাদের এই দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। গত এপ্রিলে জারি করা ‘সর্বাত্মক লকডাউনে’ প্রাইভেটকার চলাচলে তেমন বাধা ছিল না। কিন্তু এবার প্রাইভেট গাড়িকেও চেকপোস্টে জবাবদিহি করে চলতে হচ্ছে। জবাব সন্তোষজনক না হলে চেকপোস্ট থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে দিচ্ছে পুলিশ। ঢাকা থেকে দূরপাল্লার বাসের মতো যাত্রীবাহী নৌচলাচলও বন্ধ হয়ে গেছে। রেল যোগযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে জরুরি সেবায় নিয়োজিত যানবাহন পারাপারে রাখা ফেরিতে নিয়ম ভেঙে পদ্মা পার হচ্ছেন বহু যাত্রী। কার্যত দেশের সঙ্গে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন রয়েছে রাজধানী ঢাকা।

জানা যায়, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ঠেকাতে দেশে গত ৫ এপ্রিল থেকে বিধিনিষেধ জারি করা হয়। এতে বন্ধ হয়ে যায় দূরপাল্লার বাস ও লঞ্চ। ঈদুল ফিতরের পর ২৪ মে থেকে বাস ও লঞ্চ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হলে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন শ্রমিকেরা। আবার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। মহাখালী বাস টার্মিনালে বসে থাকা একাধিক বাস শ্রমিকের সাথে কথা হয়। তারা জানান, কিছুদিন পরপর সরকার বাস চলা বন্ধ করে দেয়। দেড় বছর ধরে সংসার কীভাবে চলছে, সে খোঁজ তো কেউ রাখে না।

এদিকে আগের সময় পরিবর্তন করে আগামী ১ জুলাই থেকে কঠোর লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। সরকারঘোষিত লকডাউনের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রাজধানীর কর্মস্থল ছেড়ে দেশের দক্ষিণবঙ্গগামী মানুষের ঢল নেমেছে মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাটে। গতকাল রোববার ভোর থেকে ঘাট এলাকায় হাজার হাজার যাত্রীর ভিড় দেখা যায়। যাত্রীর চাপে শিমুলিয়া থেকে বাংলাবাজারমুখী ফেরিগুলোতে পণ্যবাহী ও জরুরি যানবাহন পারাপারে বেগ পেতে হচ্ছে। পারাপারের অপেক্ষায় শিমুলিয়া ঘাট এলাকায় আটকা পড়ে কয়েকশ গাড়ি।

পুলিশের বসানো চেকপোস্ট উপেক্ষা করে বিভিন্ন পথে ছোট যানবাহনে যাত্রীরা ঘাট এলাকায় উপস্থিত হচ্ছেন। ঘাটে পণ্যবাহী ও ব্যক্তিগত গাড়ির দীর্ঘ সারি। শিমুলিয়া থেকে বাংলাবাজারগামী প্রতিটি ফেরিতে যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড়। মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব। অনেকের মুখে মাস্কও দেখা যায়নি।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) শিমুলিয়া ঘাটের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) সাফায়েত আহমেদ বলেন, নৌরুটে বর্তমানে ১৫টি ফেরি সচল রয়েছে। সকাল থেকে যাত্রীদের কিছুটা ভিড় রয়েছে। লকডাউনের আওতামুক্ত গাড়ি পারাপারের কথা থাকলেও যাত্রীরা ঘাটে আসছে। যাত্রী নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব আমাদের নয়। ঘাট এলাকায় সাড়ে চার শতাধিক গাড়ি পারাপারের অপেক্ষায়। মাওয়া ট্রাফিক পুলিশের ইনচার্জ জাকির হোসেন জানান, লকডাউনের কথা শুনে ঘাটে মানুষের খুব চাপ বেড়েছে। একইসঙ্গে গাড়ির চাপেও আছে। যাত্রীদের ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যথাসম্ভব চেষ্টা করা হচ্ছে।

এছাড়া করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় সোমবার (২৮ জুন) থেকে সারাদেশে সীমিত পরিসরে লকডাউন দিয়েছে সরকার। আর বৃহস্পতিবার (১ জুলাই) থেকে সাতদিনের জন্য সারাদেশে সর্বাত্মক লকডাউন শুরু হবে। এ অবস্থায় গতকাল রোববার নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড মোড়ে যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। গণপরিবহন না থাকায় যাত্রীদেরও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। সেখানকার বেশিরভাগ যাত্রী ঘরমুখো। সড়কে গণপরিবহন কম থাকায় অতিরিক্ত ভাড়ায় মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার ও মোটরসাইকেলে করে যাত্রীরা গন্তব্যের পথে রওনা হচ্ছেন। কেউবা পিক-আপে করে রওনা হয়েছেন।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত কয়েকদিনে সংক্রমণ হার প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে শাটডাউন বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। এ সুপারিশের আলোকেই লকডাউন বাস্তবায়নের রূপরেখা তৈরি হচ্ছে। প্রধান তথ্য কর্মকর্তা সুরথ কুমার সরকার জানান, সোমবার থেকে সীমিত পরিসরে লকডাউন শুরু হবে। বৃহস্পতিবার থেকে সাত দিনের জন্য সর্বাত্মক লকডাউনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে প্রজ্ঞাপন জারি হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে সারা দেশেই উচ্চ সংক্রমণ, পঞ্চাশোর্ধ জেলায় অতি উচ্চ সংক্রমণ লক্ষ্য করা যায়। রোগ প্রতিরোধের জন্য খণ্ড খণ্ডভাবে গৃহীত কর্মসূচির উপযোগিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী লকডাউন নিয়ে সরকারের অবস্থান তুলে ধরে জানান, যদি আপনার হাতে ভ্যাকসিন না থাকে তাহলে লকডাউনই করোনা সংক্রমণ রোধে একমাত্র কার্যকরী পন্থা। বিশ্বের সকলেই লকডাউন দিয়ে করোনাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে।

https://dailysangram.com/post/456932