২৮ জুন ২০২১, সোমবার, ২:১৭

আগের বছরের চেয়ে কমেছে নাজুক রাস্তা

তিন হাজার কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়ক বেহাল

সারাদেশে তিন হাজার পাঁচ কিলোমিটার জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং জেলা সড়ক ভাঙাচোরা। যা দেশের সড়ক-মহাসড়কের সোয়া ১৬ ভাগ। এসব রাস্তা মেরামতে আগামী পাঁচ বছরে ২০ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা প্রয়োজন। গত বছর ভাঙাচোরা ছিল দেশের মোট তিন হাজার ৫৯১ কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়ক। অর্থাৎ চলতি বছর রাস্তার উন্নয়ন ঘটেছে।

চলতি বছরের হিসাব অনুযায়ী, দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থাৎ জাতীয় মহাসড়কের ৪৮৭ কিলোমিটার ভাঙাচোরা; যা জাতীয় মহাসড়কের দৈর্ঘ্যের প্রায় সাড়ে ১৩ শতাংশ। এর মধ্যে ১৩২ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়কের অবস্থা খুবই খারাপ বা যান চলাচলের অনুপযুক্ত। বিপরীতে দেশের প্রায় ৬৫ শতাংশ রাস্তা ভালো অবস্থায় রয়েছে।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) মহাসড়ক উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ (এইচডিএম) বিভাগের প্রতিবেদনে এসব তথ্য এসেছে। গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত জরিপ করে ২০২১-২২ সালের এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে গতকাল রোববার। সওজের এইচডিএম বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. মনিরুজ্জামান জানিয়েছেন, প্রতি বছরের ধারাবাহিকতায় প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।

সওজের প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সারাদেশে সড়ক ও মহাসড়কের দৈর্ঘ্য ২২ হাজার ৪২৮ কিলোমিটার। এর মধ্যে জাতীয় মহাসড়ক তিন হাজার ৯৮৯ কিলোমিটার, আঞ্চলিক মহাসড়ক চার হাজার ৮৯৭ কিলোমিটার এবং জেলা সড়ক ১৩ হাজার ৫৪১ কিলোমিটার। সদ্য প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৮ হাজার ৪৭৩ কিলোমিটার সড়ক ও মহাসড়ক জরিপ করা হয়েছে। প্রায় চার হাজার কিলোমিটার রাস্তা জরিপ করা যায়নি উন্নয়ন কাজ চলমান থাকায় এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবে।

জরিপে ভালো, মোটামুটি, নাজুক, খারাপ ও খুব খারাপ- এই পাঁচ শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে সড়ক-মহাসড়ককে। সওজ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যেসব রাস্তা খুব খারাপ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলো আসলে যান চলাচলের উপযোগী নয়। এ হিসাবে দেশের ৬৯১ কিলোমিটার রাস্তা যান চলাচলের উপযুক্ত নয়। গত বছর এমন রাস্তা ছিল ৯৪৩ কিলোমিটার। তার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯-২০ সালের জরিপে খুব খারাপ সড়কের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার।

চলতি বছরের জরিপ অনুযায়ী, সবচেয়ে খারাপ অবস্থা জেলা সড়কের। ৪৪৮ কিলোমিটার জেলা সড়কের অবস্থা খুবই খারাপ বা যান চলাচলের উপযোগী নয়। ১১০ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়কের একই হাল। সারাদেশে খারাপ রাস্তার দৈর্ঘ্য ৭৮৯ কিলোমিটার। এর মধ্যে ১৩৫ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক, ১৪১ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং বাকি ৫১৩ কিলোমিটার জেলা সড়ক।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এক হাজার ৫২৪ কিলোমিটার রাস্তার অবস্থা নাজুক। এর মধ্যে জাতীয় মহাসড়ক ২১৯ কিলোমিটার, আঞ্চলিক মহাসড়ক ২৩৮ কিলোমিটার এবং জেলা সড়ক এক হাজার ৬৫ কিলোমিটার। আগের বছরের তুলনায় নাজুক সড়কের দৈর্ঘ্য কমেছে।

ভালো সড়ক বেড়েছে আগের বছরের তুলনায়। প্রতিবেদন অনুযায়ী, জরিপকৃত তিন হাজার ৬৩৬ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়কের প্রায় ৬৯ শতাংশ অর্থাৎ দুই হাজার ৫১২ কিলোমিটারের অবস্থা ভালো। এসব মহাসড়ক যান চলাচলের জন্য নিরাপদ ও ভোগান্তিভুক্ত। গত বছর জাতীয় মহাসড়কের ৬৫ শতাংশ ভালো অবস্থায় ছিল। জাতীয় মহাসড়কের বাকি ৬৩৬ কিলোমিটারের অবস্থা মোটামুটি। বাকি ৪৮৭ কিলোমিটারের অবস্থা নাজুক, খারাপ ও খুব খারাপ; যা মোট জাতীয় মহাসড়কের ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ।

আঞ্চলিক মহাসড়কেরও উন্নতি হয়েছে গত এক বছরে। জরিপের আওতায় আসা চার হাজার ২০৪ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়কের ৭০ শতাংশের বেশি বা দুই হাজার ৯৪৮ কিলোমিটারের অবস্থা ভালো। মোটামুটি ভালো অবস্থায় রয়েছে ৭৬৫ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়ক। বাকি ৪৯১ কিলোমিটারের অবস্থা নাজুক, খারাপ ও খুব খারাপ; যা জরিপের আওতায় আসা আঞ্চলিক মহাড়কের ১১ দশমিক ৬৭ শতাংশ।

জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাড়কের তুলনায় কম উন্নতি হয়েছে জেলা সড়কের। প্রায় ১৯ শতাংশ জেলা সড়ক ভাঙাচোরা। গত বছর ২৩ শতাংশ জেলা সড়ক ভাঙাচোরা ছিল। জরিপের আওতায় আসা ১০ হাজার ৬৩২ কিলোমিটার জেলা সড়কের ছয় হাজার ৫৪১ কিলোমিটার ভালো অবস্থায় রয়েছে; যা মোট সড়কের ৬১ শতাংশ। মোটামুটি অবস্থায় রয়েছে দুই হাজার ৬৩ কিলোমিটার জেলা সড়ক। বেহালদশা বাকি দুই হাজার ২৭ কিলোমিটারের।

সারাদেশে ১০টি বিভাগে বিভক্ত সওজ। জরিপের তথ্যানুযায়ী, গোপালগঞ্জ বিভাগের সড়ক-মহাসড়কের অবস্থা সবচেয়ে ভালো। এ বিভাগের প্রায় ৮৫ শতাংশ মহাসড়ক, ৬৬ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং ৭৫ শতাংশ জেলা সড়ক ভালো অবস্থায় রয়েছে। সড়কের সবচেয়ে বেহালদশা চট্টগ্রাম বিভাগে। এ বিভাগের ৫৭ শতাংশ জাতীয় মহাসড়ক, ৬০ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং ৪৪ শতাংশ জেলা সড়ক ভালো অবস্থায় রয়েছে। তবে যান চলাচল অনুপযোগী সড়ক সবচেয়ে বেশি কুমিল্লা বিভাগে। এ বিভাগের ১১ শতাংশ জাতীয় মহাসড়ক, ৮ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং ১১ শতাংশ জেলা সড়কের অবস্থা খুবই খারাপ।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভাঙাচোরা সড়ক-মহাসড়ক মেরামতে আগামী পাঁচ বছরে ২০ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা প্রয়োজন। এর মধ্যে আসন্ন ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রয়োজন ১৪ হাজার ৯০২ কোটি টাকা। যদিও আগামী অর্থবছরের বাজেটে সড়ক পরিবহনের সব প্রকল্প মিলিয়ে ২৮ হাজার ৪২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।

সওজ কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতি বছরই চাহিদার তুলনায় সামান্য বরাদ্দ পাওয়া যায়। ফলে সড়ক-মহাসড়কের যথাযথ পুনর্নির্মাণ, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করা যায় না। সওজের প্রধান প্রকৌশলী আবদুস সবুর বলেছেন, আগের বছরগুলোর তুলনায় ধারাবাহিকভাবে সড়ক-মহাসড়কের অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। ভাঙাচোরা সড়ক কমে আসা তার উদাহরণ।

অপ্রতুল বরাদ্দের বিষয়ে তিনি বলেছেন, প্রতিবেদনে যে অর্থ চাহিদা উল্লেখ করা হয় তা মূলত তাত্ত্বিক। কিন্তু সরকার যা বরাদ্দ দেয়, তা দিয়েই সড়ক-মহাসড়ক মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ করে যাত্রীদের স্বস্তিতে চলাচলের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

গত ১২ বছরে যোগাযোগ খাতে বিপুল বিনিয়োগ করা হয়েছে। প্রায় প্রতি জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং জেলা সড়ক মেরামত ও পুনর্নির্মাণের আওতায় এসেছে বলে একাধিকবার জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। মেরামত ও পুনর্নির্মাণ টেকসই না হওয়ার বিষয়ে প্রধান প্রকৌশলী আবদুস সবুর বলেছেন, এর পেছনে নানা কারণ রয়েছে। অতিরিক্ত পণ্যবাহী যান চলাচল, অতিরিক্ত যান চলাচল ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে সড়ক ভেঙেচুরে যায়।

তবে যোগাযোগ খাত-সংশ্নিষ্টরা বলছেন, সড়ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষনে বড় ধরনের গলদ রয়েছে। নিম্নমানের নির্মাণ কাজের কারণেই সড়ক বারবার ভাঙে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেছেন, একটি মহাসড়ক ভালোভাবে নির্মাণ করলে আট বছর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় হওয়ার কথা নয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক চার লেনের বয়স এখনও পাঁচ বছর হয়নি। কিন্তু আরও আগে থেকেই এগুলো ভাঙছে ও মেরামত করতে হচ্ছে। নির্মাণের পরের বছর থেকেই যদি মেরামত করতে হয়, তাহলে কীভাবে সেটা সড়ক হলো!

https://samakal.com/bangladesh/article/210667112