২৮ জুন ২০২১, সোমবার, ২:১০

নিরাপত্তাকর্মীরাই নিরাপত্তাহীন

গত চার মাসে রাজধানী ও পাশের কেরানীগঞ্জ এলাকায় তিনজন নিরাপত্তাকর্মী খুন হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে দুজন দোকানের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন। দোকানে চুরি ও লুটে বাধা দেওয়ায় দুর্বৃত্তরা তাঁদের তুলে নিয়ে হত্যা করে ঘটনাস্থল থেকে দূরে লাশ ফেলে যায়। আরেকজনের মৃত্যু রহস্যজনক। এ ছাড়া যৌন নির্যাতনের মতো ঘটনাও ঘটছে।

এসব ঘটনায় পুলিশের তদন্তের তথ্য জানা না গেলেও বিভিন্ন বেসরকারি নিরাপত্তা সেবা প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ করা কর্মীরা বলছেন, তাঁরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েই উদ্বিগ্ন। কারণ তাঁদের নিরাপত্তার তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই।

জানা গেছে, নিরাপত্তাসেবা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় করা আইনে সামর্থ্যবান কর্মী নিয়োগ ও যথাযথ প্রশিক্ষণের বিষয়ে বলা হলেও এগুলো অনেক ক্ষেত্রে উপেক্ষিত হচ্ছে। এ ছাড়া নিরাপত্তাকর্মীদের বেতন কম।

সারা দেশেই বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বাসা-বাড়ি, শপিং মল ও আবাসিক ভবনের নিরাপত্তার জন্য চাহিদা অনুযায়ী কর্মী সরবরাহ করে বেসরকারি বিভিন্ন নিরাপত্তা সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান। ব্যক্তিগতভাবেও বাসা-বাড়িতে নিয়োগ দেওয়া হয় নিরাপত্তাকর্মী। অভিযোগ রয়েছে, বেশির ভাগ নিরাপত্তাকর্মীকে প্রশিক্ষণ ছাড়াই অল্প টাকায় নিয়োগ দেওয়া হয়। তাঁদের দিয়ে নিরাপত্তার কাজের বাইরে বকশিশ দেওয়ার কথা বলে বাজার করা, স্কুলে বাচ্চা নিয়ে যাওয়া, গাড়ি ধোয়ামোছাসহ নানা কাজ করানো হয়।

অনেক সময় বাসা-বাড়িতে অবাধে চলাফেরার সুযোগ থাকার কারণে অনেক সময় নিরপত্তাকর্মীরা নিজেরাও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটিয়ে থাকেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, নিরাপত্তাব্যবস্থা ও নিরাপত্তাকর্মীদের সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে হলে শারীরিক সামর্থ্যের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, তাঁদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এরপর কাজে নামাতে হবে। নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে প্রতিনিয়ত কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। এ ছাড়া নিরাপত্তাকর্মীদের বেতন খুবই কম। তাঁদের পর্যাপ্ত বেতন-ভাতা দেওয়ার ব্যাপারে নজর দিতে হবে। তাঁদের প্রত্যেককে নির্দিষ্ট পোশাক ও পরিচয়পত্র দিতে হবে। এ ছাড়া ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা নিরাপত্তা সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এসংক্রান্ত আইন মানতে বাধ্য করতে হবে।

বেসরকারি পর্যায়ে নিরাপত্তাসেবা দেওয়া ও সেবার মান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০০৬ সালে সরকার আইন করেছে। নিরাপত্তাসেবা আইন, ২০০৬-এ বলা হয়েছে, শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ না হলে, ১৮ বছরের বেশি বয়স না হলে কাউকে নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে নিয়োগ করা যাবে না। নিয়োগ করা কর্মীকে যথাযথ ও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ভালোভাবে প্রশিক্ষণ না দিয়ে তাঁকে নিরাপত্তাসেবা দেওয়ার কাজে নামানো যাবে না। নিয়োগ করা কর্মী যাতে কোনো অঘটন ঘটিয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেতে না পারেন, সে জন্য নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে আবেদন পর্যায়ে ওই ব্যক্তির পরিচয়, তাঁর আগের কার্যকলাপ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নিশ্চিত হতে হবে। নিয়োগ করা কর্মীর নাম-ঠিকানা, ছবি ও জীবনবৃত্তান্ত সংরক্ষণ করতে হবে এবং স্থানীয় থানায় সরবরাহ করতে হবে। নিয়োগ করা কর্মীকে পরিচয়পত্র ও নির্ধারিত পোশাক দিতে হবে। অবশ্য নিরাপত্তাসেবা দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি আগ্নেয়াস্ত্র, গুলি, গোলা ও বারুদের লাইসেন্স পাবেন না।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রহরীরা বলছেন, তাঁদের বেতন অল্প। রাতের বেলা কর্মস্থলে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। ব্যাংকের নিরাপত্তায় সীমিত আকারে গানম্যান থাকলেও এটিএম বুথ, বাসা-বাড়ি ও দোকানপাটের জন্য কোনো গানম্যান থাকে না। এ ছাড়া প্রহরীদের থাকে না তেমন প্রশিক্ষণ ও জীবন রক্ষার সামগ্রী। মাত্র এক থেকে তিন সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দিয়ে নামিয়ে দেওয়া হয় কাজে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক দিনও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দেশের সর্ববৃহৎ নিরাপত্তাসেবা প্রতিষ্ঠান এলিট সিকিউরিটি ফোর্স লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ আজিজ (অব.) কালের কণ্ঠকে বলেন, একজন আদর্শ নিরাপত্তাকর্মীর জন্য তিন মাসের প্রশিক্ষণ দরকার হয়। নানা সীমাবদ্ধতার কারণে এক দিন থেকে শুরু করে ক্ষেত্রবিশেষে চার সপ্তাহ পর্যন্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের দেশে বেশির ভাগ বয়স্ক ও সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যদের নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাঁদের শারীরিক ফিটনেস ঠিক না থাকার ফলে দুর্বৃত্তরা অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটিয়ে থাকে। এমনও শুনেছি, বাসায় চোর এসেছে শুনে নিরাপত্তাকর্মী লুকিয়ে পড়েছেন জীবনের ভয়ে। তাই ন্যূনতম ভরণ-পোষণ চালানো যায় এমন বেতন দিয়ে শক্তি-সামর্থ্যবান লোকবল প্রয়োজনীয় সরঞ্জামসহ নিয়োগ দিতে হবে। কারণ বেতন-ভাতা ঠিকমতো না হলে যেকোনো কর্মক্ষেত্রেই দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে।’

হত্যাকাণ্ডসহ যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানোর বিষয়ে নিরাপত্তাসেবা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে নিরাপত্তাকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কাজের এলাকায় সার্বক্ষণিক ক্লোজড সার্কিট (সিসি) টিভি ক্যামেরা নিশ্চিত করা; এ ছাড়া কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট থানার সঙ্গে তাত্ক্ষণিক যোগাযোগের ব্যবস্থা রাখার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সুরক্ষাসামগ্রী দিতে হবে।

এলিট সিকিউরিটি ফোর্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরীফ আজিজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দুর্বৃত্তায়নসহ যেকোনো দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে আমাদের পক্ষ থেকে তদন্ত হয়। মামলা করা হয়। তবে নিরাপত্তাকর্মীর জীবনের নিরাপত্তা যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করবে সে প্রতিষ্ঠানকেই দিতে হয়। এ ছাড়া নিরাপত্তাকর্মীদের বিভিন্ন গ্রেডিংয়ে বেতন-ভাতা বাড়ানোর জন্য সরকারিভাবে বোর্ড গঠন করা হয়েছে। আশা করি দ্রুতই এটির বাস্তবায়ন হবে।’

ডিফেন্স সিকিউরিটিজ লিমিটেডের নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, নিরাপত্তা প্রহরীদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও থানায় তাত্ক্ষণিক যোগাযোগের ব্যবস্থা রাখা হয়। তাঁদের মূল দায়িত্ব বিচক্ষণতা ও সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি দেখা। তাঁদের জীবনের নিরাপত্তা তাঁদেরই নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশও সহায়তা করে। কোনো দুর্ঘটনার শিকার হলে ওই কর্মীর ইনস্যুরেন্স করা থাকলে সে অনুসারে ক্ষতিপূরণ পান বলে জানান তিনি।

গত ১৬ মে রাতে রাজধানীর ভাসানটেক এলাকার জেসমিন টাওয়ারের কয়েকটি দোকান লুটে বাধা দেওয়ায় নিরাপত্তাকর্মী সুজন মিয়াকে (৪০) দুর্বৃত্তরা মাথায় আঘাত করে। এ সময় আব্দুল মজিদ নামের আরেক নিরাপত্তাকর্মী আহত হন। এক পর্যায়ে সুজনকে গলায় গামছা পেঁচিয়ে পিকআপ ভ্যানে তুলে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। পরে তাঁকে হত্যা করে শেরেবাংলানগরের ৬০ ফিট এলাকায় মরদেহ ফেলে যায়।

এর আগে ৮ মে কেরানীগঞ্জের গদারবাড়ি এলাকায় দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে সামসুল হক (৪৪) নামের এক নিরাপত্তাকর্মী খুন হন।

এর আগে গত ১০ মার্চ খিলগাঁও চৌরাস্তার দোকানের নিরাপত্তাকর্মী কাজী সালাউদ্দিন মাসুমকে (৬০) কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তিনটি দোকানে চোররা তালা ভেঙে চুরি করার সময় বাধা দেওয়ায় তাঁকে পিকআপে তুলে নিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে আধাকিলোমিটার দূরে খিদমাহ হাসপাতালের সামনের ফুটপাতে ফেলে রেখে যায় দুর্বৃত্তরা। সর্বশেষ ২৪ জুন ডেমরার নিউ টাউন আবাসিক এলাকায় মিজান (৪৫) নামের এক নিরাপত্তাকর্মীর রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে।

রাজধানীর লালবাগ নূর ফাতাহ লেনের একটি বাসার নিরাপত্তাকর্মী জমির উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গভীর রাতে যখন গেটে থাকি, প্রতিটি মুহূর্ত কাটে আতঙ্কে। কোনো নিরাপত্তাকর্মী খুন হওয়ার কথা শুনলেও অস্থিরতায় ভুগি।’

ভাটারা থানার জগন্নাথপুর এলাকার ফেয়ারওয়েল সোসাইটির নিরাপত্তাকর্মী বাবুল মিয়া বলেন, ‘আমাদের খুবই অল্প বেতনের চাকরি। তেমন কোনো প্রশিক্ষণও নাই। দুর্ঘটনা ঠেকাতে অস্ত্র হিসেবে একটি লাঠি আর সাহসই ভরসা।’

নিরাপত্তাকর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারের অতিরিক্ত উপকমিশনার ইফতেখায়রুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, নিরাপত্তাকর্মীদের নিরাপত্তা ও তাঁদের মাধ্যমে কোনো দুর্ঘটনার শিকার না হতে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে প্রায়ই বিভিন্ন ধরনের নির্দেশনা দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে একাধিক লোক নিয়োগ দেওয়া, সিসিটিভি নিশ্চিত করা ও সংশ্লিষ্ট থানায় যোগাযোগ রাখা।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2021/06/28/1047672