২৮ জুন ২০২১, সোমবার, ২:০৮

নির্মাণ শিল্পে বিপর্যয়ের শঙ্কা

রড উৎপাদন কাঁচামাল স্ক্র্যাপের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি ৬ মাস আগেও ১ টন রডের দাম ছিল ৫২ হাজার টাকা, বর্তমানে পড়ছে ৭৫ হাজার টাকা

দেশের নির্মাণ শিল্পের অন্যতম অনুষঙ্গ রড। রড উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত প্রধান কাঁচামাল গলনশীল স্ক্র্যাপ (মেল্টিং স্ক্র্যাপ)। দেশে ব্যবহৃত ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত স্ক্র্যাপ আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমদানী করতে হয়। দেশের ভেতর থেকে যোগান দেয়া হয় বাকী ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। এই শিল্প মূলতঃ আমদানী নির্ভর। এসব স্ক্র্যাপ আমদানী হয় যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর কারণে এসব দেশে সরবরাহ যেমন কমেছে তেমনি তাদের নিজস্ব চাহিদাও বেড়েছে। তাই বিশ্ববাজারে আগের সব রেকর্ড ভেঙ্গে রড তৈরির কাঁচামাল স্ক্র্যাপের দাম বাড়ছে। যার প্রভাবে দেশের বাজারে নির্মাণ খাতের অন্যতম অনুসঙ্গ রডের দামও বাড়ছে লাগাতার। এদিকে চীন যেখানে ২০০৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত তাদের নিজস্ব কাঁচামাল থেকেই লৌহজাত পণ্য উৎপাদন করতো সেখানে করোনাকালীন চীন সরকার মেল্টিং স্ক্র্যাপ আমদানী উন্মুক্ত করে দেয়ায় তাদের চাহিদার একটা বড় প্রভাব পড়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে। যে কারণে, মেল্টিং স্ক্র্যাপ’র মূল্য যেখানে গত অক্টোবর ছিল ৩০০ থেকে ৩৫০ ইউএস ডলার, বর্তমানে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৫৫০ থেকে ৫৯০ ইউএস ডলার পর্যন্ত দাড়িয়েছে। ফলে ভারতসহ বেশ কিছু দেশ রডের কাঁচামালের আমদানির উপর শুল্ক কমিয়েছে।

এ খাতের উদ্যোক্তাদের মতে, কাস্টম ডিউটি, আমদানি অগ্রিম আয়কর ও ভ্যাট না কমালে রড তৈরির কাঁচামালের সঙ্কট দেখা দিবে। পাশাপাশি রডের মূল্য অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে বাজারে প্রতি টন ৫০০/ি৬০ গ্রেডের রড ৭০ হাজার থেকে ৭৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত ৬ মাস আগেও যা ছিল ৬০ হাজার থেকে ৬৫ হাজার টাকার মধ্যে। দাম বাড়লে নির্মাণ খাত স্থবির হয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, রড তৈরির কাচামাল স্ক্র্যাপ’র অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় রডের দাম গ্রাহকের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাবার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এছাড়া এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। ফলে এর সামগ্রিক প্রভাব পড়তে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতিতেও।
পুরান ঢাকার বংশাল, নয়াবাজার রডের দোকান ঘুরে জানা যায়, অবকাঠামো উন্নয়নের অন্যতম অনুসঙ্গ এই নির্মাণ সামগ্রীর বিক্রি কমেছে অনেক। অনেকের হিসাব, দুমাস আগে যে পরিমাণ বিক্রি হয়েছে বর্তমানে তা নেমে এসেছে অর্ধেকের নিচে।

কারণ জানতে চাইলে দি প্যারাডাইজ এন্টারপ্রাইজের সত্ত্বাধিকারী সাজ্জাদ হোসেন সোহেল বলেন, রডের দাম বাড়ছে। তাই কেনা কমিয়ে দিয়েছেন ক্রেতারা। গত ৬ মাস আগেও এক টন রডের দাম যেখানে পড়ত ৫০ থেকে ৫২ হাজার টাকা সেখানে বর্তমান দাম পড়ছে ৭০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা। দিনের বেশিরভাগ সময়ই তারা দোকান খুলে বসে থাকেন ক্রেতার অপেক্ষায়।

নিজের দোকানের সামনে চেয়ার পেতে বসে থাকতে দেখা গেল মেসার্স নিউ আকবর স্টিল হাউজের সত্ত্বাধিকারী মো. আমির হোসাইন রাজিবকে। বেচাকেনার খবর জানতে চাইলে তিনি জানান, যেভাবে প্রতিদিন দাম বাড়ছে তাতে আর কেউ নতুন করে বাড়িঘর নির্মাণে হাত দিচ্ছেন না। আবার যারা আগে কাজ শুরু করেছেন তাদেরও আর রড কিনতে দোকানে আসতে দেখা যাচ্ছে না। তার দোকানে বিক্রি নাই বললেই চলে। রডের দাম বৃদ্ধির প্রভাব সম্পর্কে জানতে কথা হল আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন রিহ্যাবের সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি লিয়াকত আলী ভূইয়ার সঙ্গে। তিনি জানান, নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়লে তা আসলে দিন শেষে টানতে হয় ফ্ল্যাটের ক্রেতাদের। তাই এই রডের দাম বৃদ্ধির প্রভাবও পড়বে ক্রেতাদের ওপর।

বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ শহিদউল্লাহ ইনকিলাবকে বলেন, বর্তমানে মেল্টিং স্ক্র্যাপ আমদানি শুল্ক (সিডি) টনপ্রতি ১৫০০ টাকা, আমদানি অগ্রিম আয়কর (এআইটি) টনপ্রতি ৫০০ টাকা। ২০২১-২২ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে আমদানি পর্যায়ে আরোপিত ৪ শতাংশ অগ্রিম কর (এটি) প্রত্যাহার করা হয়েছে। এই অগ্রিম কর (এটি) প্রত্যাহারে রডের মূল্য কমার তেমন কোন সুযোগ নাই। কারন এই অগ্রিম কর বিক্রয় পর্যায়ে রডের উপর টনপ্রতি আরোপিত ২ হাজার টাকা ভ্যাট থেকে রড উৎপাদনকারীরা সমন্বয় করতে পারতেন। রডের মূল্য কমাতে হলে টনপ্রতি আমদানি শুল্ক ১৫শ’ টাকা হতে ৫শ’ টাকা, আমদানি অগ্রিম আয়কর ৫শ’ টাকা হতে ৩শ’ টাকা এবং বিক্রয় পর্যায়ে যেখানে ভ্যাট ২ হাজার টাকা আছে তা কমিয়ে ৫শ’ টাকা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত প্রধান কেমিক্যাল ফেরো অ্যলয়স যার মূল্য প্রতিটন ছিল ৮শ’ থেকে ৮শ’ ৫০ ইউএস ডলার। বর্তমানে তা ১৪শ’ থেকে ১৪শ’ ৫০ ইউএস ডলারে ক্রয় করতে হচ্ছে।

মুহাম্মদ শহিদউল্লাহ বলেন, করোনা মহামারির কারনে কন্টেইনার জাহাজগুলো সবদেশেই ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়। যার ফলে কাঁচামাল সরবরাহকারী কন্টেইনারের সঙ্কট দেখা দিয়েছে এবং কন্টেইনারের ভাড়া দ্বিগুন করা হয়েছে। এছাড়া সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো জুলাই মাস থেকে কন্টেইনারের ভাড়া আরও বৃদ্ধি করবে। এ অবস্থায় সরকার শুল্ক-করাদি না কমালে রডের মূল্য আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

সূত্র মতে, নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধির কারনে ইতোমধ্যেই অনেক বড় বড় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কাজের গতি কমিয়ে দিয়েছে। কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধির কারনে সামগ্রিকভাবে দেশের নির্মাণ শিল্পে ভাটা দেখা দিয়েছে। ফলে নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে জড়িত সিমেন্ট, ইট, বালু, পাথর, হার্ডওয়্যার, টাইল্স ফ্যাক্টরীগুলো বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। এ সমস্যা পুনরুদ্ধারের ব্যবস্থা গ্রহন না করা হলে দেশের নির্মাণ ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন ব্যাহত হবে এবং নির্মাণ ও অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন শ্রেনী ও পেশার প্রায় ২ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হবে। ফলে দেশে এক অর্থনৈতিক মহামারীর সৃষ্টি হবে।
ঠিকাদারদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কন্সট্রাকশন- বাসির সভাপতি প্রকৌশলী এস এম খোরশেদ আলম জানান, এভাবে রডের দাম হঠাৎ বাড়তে থাকায় চলমান কাজ সময়মতো শেষ করা নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন তারা। কাজে এরইমধ্যে ধীরগতি নেমে এসেছে। তাদের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। কারণ, তারা যখন টেন্ডার জমা দিয়েছিলেন সেখানে এই নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়তে শঙ্কায় বর্ধিত মূল্য নির্ধারণের সুযোগ ছিলো না। অথচ এখন বর্ধিত দামে কিনতে হচ্ছে। তিনি জানান, স্টিল নির্ভর যে কোন অবকাঠামো নির্মাণে রডের দরকার হয় ২৫ ভাগ। আর এই রডের দাম যদি ২৫ ভাগ বেড়ে যায় তাহলে পুরো প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যায় ৬ থেকে ৭ শতাংশ। অথচ বর্তমান প্রতিযোগিতার বাজারে কোন প্রকল্প থেকে ৫ শতাংশ লাভ করা যায় না।

ঢাকার ডেমরা এলাকার শাহরিয়ার স্টিল মিল ঘুরেও দেখা গেল কারখানা প্রাঙ্গণে আগের মতো আর স্ক্র্যাপের মজুদ নেই। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মাসাদুল আলম মাসুদ ইনকিলাবকে বলেন, স্ক্র্যাপের দাম বৃদ্ধির বড় একটি কারণ ২০০৮ সাল থেকে স্ক্র্যাপ আমদানি বন্ধ রাখার পর গতবছর থেকে চীন আবার এই কাঁচামাল আমদানি শুরু করেছে। চীনের স্ক্র্যাপ আমদানির সিদ্ধান্ত এবার বিশ্ববাজারে এই উপকরণের দাম বৃদ্ধির বড় একটি কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া, করোনাকালে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, অস্ট্রেলিয়াসহ স্ক্র্যাপ সরবরাহকারী দেশগুলোতেও এই কাঁচামাল রফতানিতে স্থবিরতা নেমে এসেছে। চাহিদা-যোগানের হিসাব মিলাতে গিয়েই স্ক্র্যাপের দাম বাড়ছে। বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশনের সাবেক এই সভাপতি বলেন, দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য রডের কাঁচামালের উপর ভ্যাট, ট্যাক্স, শুল্ক কমাতে হবে। তিনি বলেন, বর্তমান থেকে দাম বাড়লে নির্মাণ খাত স্থবির হয়ে পড়তে পারে। পাশাপাশি দু’দিন পর পর উন্নয়নে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।

https://www.dailyinqilab.com/article/393583/