২৮ জুন ২০২১, সোমবার, ২:০৫

পরামর্শকে শত কোটি টাকা প্রকল্প তৈরিতে অনভিজ্ঞতা

বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা আধুনিকায়ন

ওজোপাডিকোর বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা আধুনিকায়ন প্রকল্পে পরামর্শক খাতে ১০১ কোটি টাকা খরচ প্রাক্কলনে আপত্তি জানিয়েছে খোদ পরিকল্পনা কমিশন। কারণ ডেসকোর একই জাতীয় প্রকল্পে ব্যয় মাত্র ১৬ কোটি টাকা। প্রকল্পের কার্যক্রম ও খরচের অনেক বিষয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের কাছে। ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই প্রকল্প প্রণয়নের কারণে একই কাজে অন্য কোম্পানির খরচের চেয়ে তাদের প্রাক্কলন অনেক বেশি বলে কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগ মনে করছে। তবে ওজোপাডিকোর প্রকৌশলী বলছেন, ডেসকোর সাথে তুলনা করলে হবে না। এই প্রকল্পের কাজের পরিমাণ ও ভৌগোলিক এলাকা সমান নয়।

প্রকল্প প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, ওজোপাডিকোর এলাকাভুক্ত উপকেন্দ্রে সার্বিক স্বয়ংক্রিয় পর্যবেক্ষণের জন্য সাবস্টেশন অটোমেশন সিস্টেম (এসএএস) ও স্ক্যাডা সিস্টেম স্থাপন, ৩৩/১১ কেভি উপকেন্দ্রগুলোর পুনর্বাসন এবং বে সম্প্রসারণসহ নতুন ৩৩ কেভি লাইন নির্মাণ, পুরাতন লাইনগুলোর পরিবর্তনের মাধ্যমে সিস্টেম লস কমিয়ে আনা, বিদ্যুতের চাহিদা অনুযায়ী বিতরণ ব্যবস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্যই এই প্রকল্পটির প্রস্তাবনা। দেশের ২১টি জেরার ৪০টি উপজেলায় এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। জেলাগুলো হলোÑ ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ, খুলনা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, মাগুরা, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, বরিশাল, ঝালকাঠি, বরগুনা, পিরোজপুর, পটুয়াখালী ও ভোলা।

প্রকল্পটি সাড়ে চার বছরে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিয়ে এর ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ১৩৮ কোটি ৬০ লাখ ৯১ হাজার টাকা, যার মধ্যে জার্মান উন্নয়ন ব্যাংকের ঋণ ও অনুদান মিলে ৭৪৪ কোটি ৯৫ লাখ ১৫ হাজার টাকা, বাংলাদেশ সরকারের ২৯৪ কোটি ৮৬ লাখ ৭২ হাজার টাকা। চলতি বছর অনুমোদন নিয়ে জুলাইয়ে কাজ শুরু করতে পারলে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পটি সমাপ্ত করার আশা ব্যক্ত করা হয়েছে। এই প্রকল্পে জার্মান ব্যাংক যে অর্থ প্রদান করবে তার মধ্যে ৯৭.৬২ শতাংশ বা ৭২৭ কোটি ২৭ লাখ ৯০ হাজার টাকা হলো ঋণ এবং ১৭ কোটি ৬৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা বা ২.৩৮ শতাংশ হলো অনুদান।

গত ২০২০ সালের আগস্টে প্রকল্পের যাচাই কমিটির প্রথম সভায় বেশ কিছু সুপারিশ দেয়া হয়। সেই সুপারিশের ৪.১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সরকারি অর্থের ওপর চাপ কমানোর জন্য বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিবের (পরিকল্পনা) নেতৃত্বে জিওবি অর্থের পরিমাণ হ্রাস করে প্রকল্প ব্যয় যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করতে হবে মর্মে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। ওই নিদের্শনা মোতাবেক অক্টোবরে এবং ডিসেম্বরে প্রকল্পের ব্যয় যথাযথকরণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। খরচ নিয়ে দফায় দফায় সভার পর গত এপ্রিলে এক হাজার ১৩৮ কোটি ৬০ লাখ ৯১ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে প্রেরণ করে। প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো, বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার নির্ভরযোগ্যতা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণ এবং অপারেশনাল দক্ষতা বৃদ্ধি করা। ক্রমবর্ধমান চাহিদা নিরসনের জন্য বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। ক্যাপটিভ এনার্জি ব্যবহার কমানো এবং গ্রিড দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমন কমানো।

প্রকল্পে ব্যয়ের হিসাব থেকে জানা গেছে, এতে তিন ধরনের পরামর্শক নেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। যাদের পেছনে খরচ হবে প্রায় ১০১ কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়ন ও সুপারভিশনে ২২৮ জনমাস পরামর্শকের পেছনে ব্যয় হবে ৪১ কোটি ৫২ লাখ ৯২ হাজার টাকা। ফলে এখানে প্রতি জনমাসে খরচ হবে ১৮ লাখ ২১ হাজার টাকার বেশি। ক্যাপাসিটি বাড়াতে ১০৬ জনমাস পরামর্শকের জন্য খরচ ধরা হয়েছে ২৩ কোটি ৯৫ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। ফলে প্রতি জনমাসে এখানে ব্যয় হবে ২২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। আর জিআইএস ম্যাপিংয়ে ১৫৬ জনমাস পরামর্শকের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। তাদের জন্য খরচ ধরা হয়েছে ৩৫ কোটি ৪৩ লাখ ৬৩ হাজার টাকা। ফলে এখানে প্রতি জনমাসে যাবে ২২ লাখ ৭২ হাজার টাকা। ফলে প্রতি জনমাস পরামর্শক খাতে গড়ে খরচ হচ্ছে ৭৩ লাখ ৫৩ হাজার টাকা।

এ দিকে ব্যয় প্রাক্কলন পর্যালোচনায় পিইসি বলছে, নতুন সঞ্চালন লাইন নির্মাণের ক্ষেত্রে ওজোপাডিকোর সমজাতীয় কোনো প্রকল্পের অনুরূপ নিমাণকাজ না থাকায় ব্যয় প্রাক্কলনের ভিত্তি উপস্থাপন করা যায়নি। ফলে এই নির্মাণকাজের দর প্রাক্কলনে অন্যান্য বিদ্যুৎ কোম্পানির বাস্তবায়নাধীন বা সমাপ্ত প্রকল্পের সাথে তুলনা করা হয়নি। বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির সমজাতীয় প্রকল্পভুক্ত আইটেমের প্রাক্কলন অপেক্ষা বেশি, যা পর্যালোচনা করে যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনা দরকার। প্রস্তাবিত প্রকল্প এলাকায় পিজিসিবির বৈদ্যুতিক সঞ্চালন লাইনের সাথে অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক রয়েছে। ওই নেটওয়ার্ক ব্যবহার না করে স্ক্যাডা সিস্টেমের জন্য আলাদা রেডিও লিংক স্থাপনের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করা হয়নি।

আটটি উপকেন্দ্র সাবস্টেশন অটোমেটেড সিস্টেম স্থাপন এবং ৯৭টি উপকেন্দ্রের মধ্যে রেডিও লিংক এবং ফাইবার অপটিক ক্যাবলের মাধ্যমে স্ক্যাডা সিস্টেম স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে একই সাবস্টেশনে একাধিক রেডিও লিংক স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রতিটি লিংকের আলাদা আলাদা করে এন্টেনা স্থাপনের কারণও ব্যাখ্যা করা হয়নি। প্রকল্পের সমীক্ষা ২০১৮-১৯ সালের প্রেক্ষাপটে করা হয়েছে। এটাকে হালনাগাদ করার জন্য কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।

প্রকল্পের আওতায় কাজগুলো হলো, ওজোপাডিকোর ৯৭টি ৩৩/১১ কেভি উপকেন্দ্রগুলোকে কেন্দ্রীয় স্ক্যাডা সিস্টেমের সাথে সংযুক্ত করার জন্য স্ক্যাডা সিস্টেমসহ অটোম্যাটিক মিটার রিডিং সিস্টেম স্থাপন। ২০টি ৩৩/১১ কেভি উপকেন্দ্রের সম্পূর্ণ পুনর্বাসন এবং আটটি অতিরিক্ত উপকেন্দ্রে সাবস্টেশন অটোমেশন সিস্টেম স্থাপন। ১২১.৬৮ কিলোমিটার ৩৩ কেভি নতুন লাইন নির্মাণ এবং ৬১.৬০ কিলোমিটার ৩৩ কেভি লাইন পুনর্বাসন করা। বিভিন্ন উপকেন্দ্রের সুইচিং স্টেশনে ২০টি ৩৩ কেভি বে সম্প্রসারণ। এর জন্য দুই একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে।

পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগ বলছে, প্রস্তাবিত প্রকল্পে মূল কার্যক্রম দু’টি। ওজোপাডিকোর এলাকায় স্ক্যাডা সিস্টেম স্থাপন এবং বিতরণ ব্যবস্থার ক্ষমতাবর্ধন। প্রকল্পের অনেক কার্যক্রম নিয়েও তাদের প্রশ্ন। কারণ অনেক কিছুই স্পষ্ট নয়। বলা হয়েছে ২০টি উপকেন্দ্রে ৩৩ কেভি বে স্থাপন করা হবে। কিন্তু আইটেমভিত্তিক ব্যয় বিভাজন অনুসারে বে স্থাপনের পরিবর্তে এক্সটেনশন করা হবে মর্মে প্রতীয়মান হয়।

প্রকল্পের ব্যাপারে ওজোপাডিকোর সদর দফতরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো: সাইফুজ্জামানের (উন্নয়ন ও পরিকল্পনা) কাছে গতকাল ফোনে জানতে চাওয়া হলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, গত ১৭ জুন পরিকল্পনা কমিশনে পিইসি হয়েছে। সেখান থেকে কিছু দিকনিদের্শনা দেয়া হয়েছে। একটি কমিটি করে দেয়া হবে। সেখানে বিদ্যুৎ বিভাগ ও পরিকল্পনা কমিশনের বিভিন্ন বিভাগের সদস্যরা থাকবেন। তাদের দেয়া সুপারিশ অনুযায়ী ডিপিপি সংশোধন করে আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। তারা সেটিকে আবার পরিকল্পনা কমিশনে পাঠাবে। স্ক্যাডা প্রকল্পে পরামর্শক খাতে খরচ বেশি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখানে তিন ধরনের পরামর্শক খাতে খরচ ও সিডি ভ্যাট আছে। ডেসকোর স্ক্যাডা প্রকল্পটি ১৫২ কোটি টাকার। তাদের ভৌগোলিক এলাকা আর এই প্রকল্পের ভৌগোলিক এলাকা সমান না। কাজের আকারও বেশি। ফলে পরামর্শক খাতে খরচ বেশি হবেই। এসব আমরা পিইসিকে বলেছি।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/591129