২৭ জুন ২০২১, রবিবার, ১:৪৫

সোমবার থেকে সীমিত, বৃহস্পতিবার থেকে সর্বাত্মক

সমন্বয়হীনতায় পিছিয়ে গেল লকডাউন

সমন্বয়হীনতার কারণে শুরুর আগেই পিছিয়ে গেল 'কঠোর লকডাউন'। শুক্রবার সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, সোমবার সাত দিনের কঠোর লকডাউন শুরু হবে। কিন্তু শনিবার রাতে সে সিদ্ধান্ত বদলে যায়। জানানো হয়, দেশব্যাপী কঠোরভাবে সর্বাত্মক লকডাউন বৃহস্পতিবার (১ জুলাই) থেকে শুরু হবে। তবে সোমবার থেকে 'সীমিত পরিসরে' লকডাউন থাকবে। এই সময় থেকে গণপরিবহন বন্ধ হয়ে যাবে। জেলার ভেতরে এক উপজেলা থেকে অন্য উপজেলায় বাস বা অন্য কোনো গণপরিবহন যাতায়াত করতে পারবে না। এ সময় কিছু প্রতিষ্ঠান খোলা থাকবে। সর্বাত্মক লকডাউনের সময়েও রপ্তানিমুখী কার্যক্রম সচল রাখার স্বার্থে ব্যাংকিং সেবা চালু রাখা হবে।

গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সভাপতিত্বে উচ্চ পর্যায়ের এক সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। আজ রোববার প্রজ্ঞাপন দিয়ে সবকিছু স্পষ্ট করা হবে। সভায় উপস্থিত একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র সমকালকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।

একটি সূত্র সমকালকে জানায়, বৃহস্পতিবার থেকে সেনাবাহিনী মাঠে নামতে পারে। ওই দিন থেকে ঢাকায় রিকশা ও জরুরি প্রয়োজন ছাড়া অন্য কোনো গণপরিবহন চলতে দেওয়া হবে না। দেশব্যাপী সব ধরনের যানবাহন বন্ধ থাকবে।

একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, সোমবার থেকে কঠোর লকডাউনের ঘোষণা দেওয়া হলেও অর্থবছরের শেষ সময় হওয়ায় সিদ্ধান্তে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। মার্কেট, হোটেল, রেস্তোরাঁসহ কিছু কিছু ক্ষেত্রে সীমিত পরিসরে লকডাউন শুরু হবে। এই সময়ে কিছু কার্যক্রম চালু থাকবে। আর ১ জুলাই থেকে সাত দিনের সর্বাত্মক লকডাউন শুরু হবে। লকডাউনে জরুরি সেবা ছাড়া বাকি সবকিছু বন্ধ হয়ে যাবে।

এর আগে গত শুক্রবার সরকারের এক তথ্য বিবরণীতে জানানো হয়েছিল, সোমবার থেকে সারাদেশে সাত দিনের কঠোর লকডাউন শুরু হবে। এই সময়ে সব ধরনের সরকারি-বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে। জরুরি পণ্যবাহী ছাড়া সব ধরনের গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকবে। শুধু অ্যাম্বুলেন্স ও চিকিৎসাসংক্রান্ত কাজে যানবাহন চলাচল করতে পারবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আগেই অর্থবছর সমাপ্তির বিষয়টি মাথায় রাখা জরুরি ছিল। অর্থবছরের শেষে যেসব কার্যক্রম হয়, তা নতুন নয়; প্রতি বছরই এ সময় এমন কার্যক্রম চলে। তারপরও কেন সেসব মাথায় না রেখে একটা ঘোষণা দেওয়া হলো; আবার পরদিনই তা পিছিয়ে দেওয়া হলো? এসবই প্রমাণ করে- সমন্বয়হীনতা প্রকট মাত্রায় রয়েছে।

তাদের মতে, কঠোর লকডাউন বা শাটডাউনের সুপারিশ এসেছে মানুষের জীবন রক্ষার স্বার্থেই। বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে সরকারের সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা।

সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, আগের চেয়ে এবারের লকডাউন কঠোর হবে। মাঠ পর্যায়ে পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি দায়িত্ব পালন করবে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘরের বাইরে বের হতে পারবেন না। শুধু জরুরি সেবা ছাড়া আর কোনো কিছুই চলবে না। গণমাধ্যম (প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক) লকডাউনের আওতামুক্ত থাকবে। আপাতত এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন ঘোষণা করা হলেও পরবর্তী পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সময়সীমা বাড়ানো হতে পারে।

জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন সমকালকে বলেন, করোনাভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ রোধে পরামর্শ কমিটি কঠোর বিধিনিষেধ জারির সুপারিশ করেছে। সেই আলোকে সারাদেশে এক সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। পরে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সময় আরও বাড়ানো হতে পারে। মাঠ পর্যায়ে লকডাউন পালনে পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি দায়িত্ব পালন করবে। প্রয়োজনে সেনাবাহিনীও নামতে পারে।

সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা জানান, সরকার চাইলে লকডাউনে মাঠে নামবে সেনাবাহিনী। গত বছরও লকডাউনে মাঠে ছিলেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রজ্ঞাপনের পর বিষয়টি পরিস্কার হবে।

সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, 'কঠোর লকডাউন' বলতে যে চিন্তাটি করা হয়েছে সেটা হলো, শুধু জরুরি সেবা ছাড়া আর কোনো কিছুই চলবে না। এখন যেমন কিছু কিছু বিষয়ে নমনীয়তা দেখানো হচ্ছে, সেটি হয়তো তখন আর থাকবে না। বর্তমানে যে লকডাউন চলছে, সেখানে সব ধরনের গণপরিবহন চলছে। বাজার, শপিংমল খোলা রয়েছে। অফিস-আদালত, ব্যাংক, বীমা- সবকিছুই খোলা। বেসরকারি খাতেরও সবকিছু খোলা। তবে ওষুধ ও নিত্যপণ্যের দোকান জরুরি সেবার মধ্যেই পড়ে। তাই এগুলো লকডাউনেও খোলা রাখা যাবে।

কঠোর লকডাউনের ঘোষণায় শনিবার সকাল থেকে নিত্যপণ্যের বাজারে ভিড় বেড়েছে। রাজধানীর মোহাম্মদপুর, কারওয়ান বাজার, রামপুরা, রায়েরবাজার, ধানমন্ডি, গুলশানসহ বিভিন্ন এলাকার বাজার ও সুপারশপে ক্রেতার ভিড় তুলনামূলক বেশি চোখে পড়েছে। বিক্রেতারা বলছেন, ৭ থেকে ১৪ দিনের মতো বাজার করছেন বেশিরভাগ ক্রেতা। তবে পণ্যের দাম আগের মতোই আছে। এ ছাড়া লকডাউনের ঘোষণায় এরই মধ্যে রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের জেলা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে ছুটতে শুরু করেছেন অনেকেই। এ কারণে শনিবার সকাল থেকে মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাট, মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাটসহ দেশের অন্যান্য রুটেও যাত্রী, ব্যক্তিগত ও পণ্যবাহী গাড়ির চাপ বেড়েছে।

'ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই' :সোমবার থেকে দেশজুড়ে সর্বাত্মক লকডাউনের ঘোষণা দিয়ে আবার পিছিয়ে যাওয়ার খবরে বিশেষজ্ঞদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তাদের মতে, ঘোষণা দিয়ে পিছিয়ে যাওয়ায় যে দুর্বলতা পরিলক্ষিত হলো- সেটা এ ক্ষেত্রে সরকারের সমন্বয়হীনতার বার্তা বহন করে। কঠোর লকডাউনের বিকল্প নেই বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের অভিমত, যে 'কঠোর' লকডাউনের কথা বলা হচ্ছে, সেটি যেন কঠোরই হয়। জীবন রক্ষার স্বার্থেই এ ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। বিষয়টি যাতে পরিকল্পনামাফিক ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে করা হয় সেদিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। একই সঙ্গে দরিদ্র, শ্রমজীবী ও খেটে খাওয়া মানুষের জন্য খাদ্য সহায়তার ব্যবস্থা থাকতে হবে। অন্যথায় ভোগান্তি বাড়বে, কিন্তু কাজের কাজ হবে না।

কারিগরি কমিটি যে শাটডাউনের সুপারিশের সঙ্গে আরোপিত বিধিনিষেধ কিংবা লকডাউনের তফাত সম্পর্কে জানতে চাইলে কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো. সহিদুল্লা সমকালকে বলেন, বিধিনিষেধ হলো বিষয়ভিত্তিক। অর্থাৎ প্রয়োজন অনুযায়ী শর্তারোপ করা। আর শাটডাউন অথবা লকডাউন হচ্ছে, জরুরি সেবা ছাড়া সবকিছু বন্ধ থাকবে। অর্থাৎ গণপরিবহন থেকে শুরু করে অফিস-আদালত, সরকারি-বেসরকারি সবকিছু বন্ধ থাকবে। সংক্রমণ ও মৃত্যু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে এই ব্যবস্থার বিকল্প নেই।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, লকডাউন কিংবা বিধিনিষেধের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর গত বছরের মার্চের শেষ সপ্তাহে যে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল, তা যথাযথভাবে কার্যকর হয়নি। বিধিনিষেধ আরোপ করার পর হাজার হাজার মানুষ গ্রামে ফিরে গেছেন। মাঝখানে গার্মেন্ট শ্রমিকদের ছুটি বাতিল করে দেন মালিকরা। গ্রাম থেকে হাজার হাজার শ্রমিক আবার ঢাকাসহ বিভিন্ন নগরীতে ফিরতে সড়ক-মহাসড়কে ভিড় করেন। আবার তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ঈদেও মানুষের গ্রামে যাতায়াত আটকানো যায়নি। এরপর জুন-জুলাই মাসে সংক্রমণ চূড়ায় পৌঁছায়।

তিনি বলেন, সবকিছু খোলা রেখে বিধিনিষেধ আরোপ হাস্যকর। এবারও একই চিত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কঠোর লকডাউনের ঘোষণা আসতেই ঢাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ গ্রামে ছুটছেন। আবার গ্রাম থেকে ঢাকায়ও ফিরে আসছেন। সুতরাং এ পরিস্থিতি শঙ্কা জাগাচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ সমকালকে বলেন, লকডাউন বিজ্ঞানসম্মত না হলে তা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কাজে আসবে না। লকডাউনের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা। জনসমাগম এড়ানো। এটি কার্যকরভাবে করা গেলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে থাকে। কিন্তু জনসমাগম ও চলাচল অব্যাহত থাকলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে না। এ জন্য সরকারকে এ বিষয়টি কঠোর নজরদারির আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে সাত দিনের লকডাউন বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি নয়- এটি আগেও বলেছি। কারণ, মানবদেহে করোনাভাইরাসের সুপ্তিকাল এক থেকে ১৪ দিন পর্যন্ত। একটি ধাপের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে নূ্যনতম ১৪ দিন লকডাউন দিতে হবে। আর দুই ধাপের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ২৮ দিনের লকডাউন দিতে হবে। অন্যথায় যে উদ্দেশ্যে লকডাউন দেওয়া হচ্ছে, সেটি কার্যকর হবে না।

বিএমএর সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব সমকালকে বলেন, বিজ্ঞানসম্মত লকডাউন ছাড়া অন্য কোনো পদ্ধতিতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসবে না। দেশে গত বছরের মার্চ থেকে এ পর্যন্ত যতবার লকডাউন কিংবা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, সেগুলোর কোনোটিই বিজ্ঞানসম্মত ছিল না। একই সঙ্গে বিধিনিষেধ জারি করার আগে দরিদ্র, শ্রমজীবী ও খেটে খাওয়া মানুষের খাবার জোগান দিতে পরিকল্পনা ছিল না। খাদ্যের তাগিদ থেকে এসব মানুষ রাস্তায় নেমে গেছেন। এরপর সরকারকে বিধিনিষেধ তুলে নিতে হয়েছিল। সুতরাং অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবার যাতে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে কঠোর লকডাউন দেওয়া হয়, সরকারের কাছে সেই আহ্বান থাকবে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সমকালকে বলেন, সরকার লকডাউনের ওপর নির্ভরশীল হতে চায় না। কিন্তু বাধ্য হয়ে দিতে হচ্ছে। টিকাকরণ করা না গেলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের একমাত্র কার্যকর পন্থা লকডাউন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ পন্থা অবলম্বন করেই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এনেছে। লকডাউন দিলে নিম্ন আয়ের মানুষ বিপদে পড়েন। দেশের অর্থনীতির ক্ষতি হয়। কাজেই এই লকডাউন কাম্য নয়। তবুও মানুষের জীবন রক্ষার স্বার্থে লকডাউন দিতে হচ্ছে।

https://samakal.com/bangladesh/article/210666976/