২৭ জুন ২০২১, রবিবার, ১:৪৩

সড়কে-ফেরিতে মানুষের স্রোত

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সোমবার থেকে কঠোর লকডাউন ঘোষণা করেছে সরকার। লকডাউন কার্যকরের আগে প্রয়োজনীয় গন্তব্যে যেতে ছুটছে মানুষ। ঢাকা ছাড়তে এবং প্রবেশ করতে হিড়িক পড়েছে। গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও সড়কে-ফেরিতে দেখা যাচ্ছে রীতিমতো মানুষের স্র্রোত।
সরকারের বিধি-নিষেধের তোয়াক্কা না করেই যে যেভাবে পারছেন ছুটছেন নিজ নিজ গন্তব্যে। ঢাকার সঙ্গে পার্শ্ববর্তী জেলার গণপরিবহন বন্ধ থাকায় বিভিন্ন যানবাহনে একাধিক ধাপ ও কয়েকগুণ বেশি ভাড়া দিয়ে শহর ছাড়ছেন। এতে সড়ক ও মহাসড়কে বেড়েছে মানুষের চাপ। গ্রামমুখী মানুষের ভিড়ে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না কোথাও।
গাদাগাদি আর ভোগান্তির স্বীকার কেউ কেউ। তবুও থেমে নেই যাত্রা। এর আগে রমজান ও ঈদুল ফিতরে সরকারের বিধি-নিষেধ জারি থাকা সত্ত্বেও ঢাকা ছেড়েছিল ঘরমুখী মানুষ। তখন গণপরিবহন বন্ধ থাকায় অনেকেই বাড়িতে যেতে পারেননি। ফলে আসছে ঈদুল আজহার আগে লকডাউনের ঘোষণা আসায় ত্বরিত গতিতে ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছেন অনেকেই। বিধি-নিষেধ থাকা সত্ত্বেও প্রশাসনের চোখের সামনে দিয়েই যাতায়াত করছেন তারা। এতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেজ্ঞরা।
বাড়ি ফেরা অনেকেই জানান, বিগত সময়ে ৭ দিনের লকডাউন বেড়ে ২ থেকে ৩ মাস ধরে চলছে। এতে অনেকেই কর্মহীন হয়েছেন। দূরপাল্লার গণপরিবহন বন্ধ থাকায় বাড়ি ফিরতে না পেরে, রাজধানীতে সীমাহীন কষ্টে দিনযাপন করছেন তারা। অনেকেই পরিবার- পরিজন নিয়ে নানা অসুবিধায় পড়েছেন। ঈদুল ফিতরেও বাড়ি ফিরতে পারেননি কেউ কেউ। সম্প্রতি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রকট আকার ধারণ করেছে। কঠোর লকডাউন কিংবা শাটডাউন বাস্তবায়ন হলে ঈদের আগে কর্মহীন হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। এতে অনেকটা বাধ্য হয়েই বাড়ি ফিরছেন তারা। কেউবা পরিবার-পরিজনকে আগেই গ্রামে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।
গতকাল সরজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর প্রবেশ মুখে সকাল থেকেই বের হচ্ছেন মানুষ। সড়কে নেমেছে গ্রামমুখী মানুষের ঢল। মহাখালী বাসস্ট্যান্ড, আব্দুল্লাহপুর, গাবতলী, গুলিস্তান ও যাত্রাবাড়ী টার্মিনাল এলাকা থেকে প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, সিএনজি, মালবাহী ট্রাক ও মোটরবাইকে করে ঢাকা ছাড়ছেন তারা। এসব স্থানে বেড়েছে এক শ্রেণির দালালের দৌরাত্ম্য। এতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন বয়স্ক, নারী ও শিশুরা। চার-পাঁচগুণ বেশি ভাড়া দিয়ে গন্তব্যে যেতে হচ্ছে সবাইকে।
শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টায় যাত্রাবাড়ী এলাকা ঘুরে দেখা যায়, দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলগামী ঘরমুখো মানুষের চাপ বেড়েছে। বাসকাউন্টারের সামনে টিকিট দিয়ে মাইক্রোবাস ও ব্যক্তিগত প্রাইভেটকারে যাত্রী উঠানো হচ্ছে। ভাড়তি ভাড়ায় মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেলসহ অন্যান্য যানবাহনে ঢাকা ছাড়ছেন যাত্রীরা। যাদের অধিকাংশই শ্রমজীবী মানুষ। আছেন শিক্ষারর্থীরাও।
স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে যাত্রাবাড়ী এলাকায় প্রাইভেটকারের জন্য অপেক্ষা করছিলেন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ইলিয়াস মৃধা। মানবজমিনকে তিনি বলেন, গত লকডাউনের সময় চাকরি চলে গেছে। পরিবার-পরিজন নিয়ে খেয়ে না খেয়ে অনেক কষ্টে জীবন-যাপন করছি। আমি বুঝি আয় না থাকলে এত কষ্ট। সোমবার থেকে ফের শুরু হচ্ছে কঠোর লকডাউন। শুনেছি এই সময়ে জরুরি সেবা ছাড়া সব কিছু বন্ধ থাকবে। তাই পরিবার- পরিজনকে আগেভাগেই গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীতে পাঠাচ্ছি। ঢাকার চারপাশের জেলাগুলোতে কঠোর বিধি-নিষেধ চলার কারণে গণপরিবহন বন্ধ। তাই বিভিন্ন উপায় হিসেবে এক বন্ধুর মাধ্যমে একটা প্রাইভেটকার ভাড়া করেছি। ৭ হাজার টাকায় আরো ২ জন যাত্রীসহ গ্রামে পৌঁছে দেবে।
শিমুল নামের এক শিক্ষার্থী জানান, ঈদুল ফিতরের পর সবকিছু খুলে দেয়ায় রামপুরায় বড় ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে আসি। কয়েকদিন ধরে এখানে চাকরি খুঁজেছি। কোথাও চাকরি হয়নি। এখন সরকার আবার লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছে। শুনেছি এবার কঠোরভাবে লকডাউন পালন হবে। সবকিছু বন্ধ থাকবে। এজন্য গ্রামে ফিরে যাচ্ছি। বাড়তি ভাড়া আর যানবাহন কয়েকধাপে পরিবর্তন করে যেতে হচ্ছে। গ্রামে অন্তত মা-বাবার সঙ্গে ভালোভাবে থাকতে পারবো।
মহাখালী বাস টার্মিনাল এলাকায়ও পরিবহনের জন্য অপেক্ষা করছেন শত শত ঘরমুখো যাত্রী। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় বাড়তি ভাড়া আর ভোগান্তি নিয়ে ঢাকা ছাড়ছেন তারা। অনেকেই বলছেন, বিধি-নিষেধের এই সময়ে কর্মস্থল বন্ধ থাকার কারণেই রাজধানী ছাড়ছেন তারা। লকডাউনে কাজ নেই তাদের। এতে জীবন-যাপনের খরচ বহন করতে নানা অসুবিধায় পড়বেন তারা।
নিপা আক্তার নামের এক গার্মেন্টকর্মী বলেন, গত ঈদে বাড়ি ফিরতে পারিনি। কয়েকদিন বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও যাইনি। এখন শুনছি লকডাউন দিবে। এই লকডাউন কোরবানি ঈদের সময়ও থাকতে পারে। এজন্য বাড়িতে চলে যাচ্ছি। যদি কোরবানি ঈদের সময় না যেতে পারি।
একইচিত্র রাজধানীর গাবতলী এলাকায়। প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, সিএনজি, মোটরসাইকেলে ডেকে ডেকে যাত্রী তুলছেন চালকরা। প্রায় প্রতিটি মাইক্রোবাসে গাদাগাদি করে ১৪/১৫ জন যাত্রী উঠানো হয়। এসব বাহনের সামনে নানা পেশার স্টিকার লাগিয়ে যাত্রী পারাপার করতেন তারা। পৌঁছে দিচ্ছেন নির্দিষ্ট গন্তব্যে। অনেকেই আবার কয়েক ধাপে এসব বাহন পরিবর্তন করছেন।
বগুড়াগামী শিবু মিয়া জানান, সোমবার থেকে লকডাউন দেয়া হবে। তখন কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যাবে। এজন্যই চলে যাচ্ছি বাড়িতে। ঢাকায় না খেয়ে থাকলেও দেখার কেউ নেই। প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস যে কোনো একটা পেলেই তাতে করে গাদাগাদি করে চলে যাবো।
এদিকে, শনিবার সকাল থেকে শিমুলিয়া ও পাটুরিয়া ঘাটে যাত্রীর চাপ বেড়েছে কয়েকগুণ। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান যোগাযোগ মাধ্যম লঞ্চ বন্ধ থাকায়, ফেরিতেই ঝুঁকছেন অনেকে। ভোর থেকেই ফেরিতে গাদাগাদি করে পারাপার হচ্ছেন যাত্রীরা।
এদিকে বিভিন্ন উপায়ে গাদাগাদি করে, স্বাস্থ্যবিধি না মেনে বিভিন্ন বাহনে মানুষ ঢাকা ছাড়লেও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর তেমন একটা তৎপরতা দেখা যায়নি।

https://mzamin.com/article.php?mzamin=280656&cat=2