৪ এপ্রিল ২০১৭, মঙ্গলবার, ১০:২৫

জনপ্রতিনিধি বিরোধী দলের হলেই বরখাস্ত

‘গণবরখাস্তের কারণে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অর্থহীন হয়ে পড়ছে’

নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরও জনগণের সেবা করার সুযোগ পাচ্ছেন না দেশের অনেক জনপ্রতিনিধি। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি বিরোধীদলের হলেই রাজনৈতিক মামলাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে তাদের সাময়িক বরখাস্ত করা হচ্ছে। এ ছাড়া গ্রেফতার করে কারারুদ্ধও করা হচ্ছে অনেককে। এতে এক দিকে যেমন সংশ্লিষ্ট এলাকার অধিবাসীরা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন; অন্য দিকে ব্যাহত হচ্ছে স্থানীয় সরকারের উদ্দেশ্য।
প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেও জনগণের বিপুল সমর্থন নিয়ে বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল রাজশাহীর মেয়র নির্বাচিত হন। কিন্তু দায়িত্ব নেয়ার কিছু দিনের মধ্যেই ২০১৫ সালের ৭ মে তাকে বরখাস্ত করে সরকার। দীর্ঘ ২০ মাস পর উচ্চ আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে গত রোববার দায়িত্ব নেয়ার মাত্র ১০ মিনিটের মাথায় আবারো তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
জনগণের সমর্থন নিয়ে সিলেটের মেয়র নির্বাচিত হন আরিফুল হক চৌধুরী। কিন্তু তিনি বেশি দিন নগরবাসীর সেবা করার সুযোগ পাননি। একটি বোমা হামলার মামলায় তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারি তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। দীর্ঘ ২৭ মাস আইনি লড়াই চালিয়ে তিনি মেয়রের পদ ফিরে পান। কিন্তু গত রোববার দায়িত্ব নেয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই তাকেও আবার সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার নয়া দিগন্তকে এ প্রসঙ্গে বলেন, এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের আগে একবার বরখাস্ত করা হয়েছিল। আইনি লড়াই করে তারা কেবল অফিসে বসেছিলেন। কিন্তু তাদেরকে আবার বরখাস্ত করা হলো। রাজনৈতিক কারণে এভাবে বরখাস্ত করা গণতন্ত্রের জন্য অশনি সঙ্কেত। এটা সরকারের জন্যও শুভ ফল বয়ে আনবে না।
২০১৩ সালের ৬ জুলাই গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আওয়ামী লীগের আজমত উল্লাহর চেয়ে সোয়া লাখের বেশি ভোট পেয়ে জয়ী হন বিএনপির অধ্যাপক এম এ মান্নান। নির্বাচনের দেড় মাস পর ১৮ আগস্ট তিনি দায়িত্ব নেন। ১৮ মাসের মাথায় ২০১৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি একটি নাশকতার মামলায় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। ১২ মাস ১৮ দিন কারাভোগের পর গত বছরের ২ মার্চ তিনি মুক্তি পান। ৪২ দিনের মাথায় ১৫ এপ্রিল আবার গ্রেফতার হন তিনি। আট মাস ২২ দিন কারাবন্দী থাকার পর এ বছরের ৭ জানুয়ারি দ্বিতীয় দফায় মুক্তি পান। নির্বাচিত হওয়ার পর মেয়র এম এ মান্নান দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছেন মাত্র ১৮ মাস। আর জেলে কাটিয়েছেন ২২ মাস। তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ২৯টি। সরকার তাকে দুই দফা সাময়িক বরখাস্ত করেছে। সম্প্রতি তিনি কারামুক্ত হয়েছেন। কিন্তু এখনো মেয়রের চেয়ার ফিরে পাননি।
২০১৩ সালের ১৫ জুন ৬০ হাজার ভোটের ব্যবধানে খুলনার মেয়র নির্বাচিত হন বিএনপির মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মনি। নাশকতার দু’টি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র গৃহীত হওয়ায় ২০১৫ সালের ২ নভেম্বর মনিরুজ্জামানকে বরখাস্ত করে সরকার।
উচ্চ আদালতের আদেশে মেয়রের পদ ফিরে পেলে দীর্ঘ এক বছর ১৯ দিন পর মেয়রের চেয়ারে বসার সুযোগ পান মনিরুজ্জামান মনি।
শুধু সিটি করপোরেশনের মেয়রই নন, রাজনৈতিক মতভিন্নতা থাকায় সরকার বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত প্রায় ৪০০ উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, পৌরমেয়র, কাউন্সিলর, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বারকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। তাদের অনেককে বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে। আবার অনেককে নির্বাচিত হওয়ার পর শপথ নেয়ার সুযোগও দেয়া হয়নি। শপথ নিতে গেলে পথিমধ্যেই তাদের আটক করা হয়। অনেকে জেল খেটে বের হয়ে আবার দায়িত্ব নিতে গেলে আবার বরখাস্ত করা হয়েছে।
জানা যায়, বিদ্যমান স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন), স্থানীয় সরকার (পৌরসভা), স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ) এবং স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন অনুযায়ী কোনো জনপ্রতিনিধি যেকোনো ধরনের ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হলে (আদালতে চার্জশিট গৃহীত হলে) কিংবা ওই প্রতিনিধি শারীরিকভাবে সক্ষমতা হারালে কিংবা পরিষদের সভায় পরপর তিনবার অনুপস্থিত থাকলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করতে পারে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের পর ডাকা হরতাল-অবরোধের সময় নাশকতা ও বোমাবাজির ঘটনায় বহু জনপ্রতিনিধিকে আসামি করে মামলা করা হয়। এসব মামলা তদন্ত শেষে পাঁচ শতাধিক জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। আদালতে চার্জশিট গৃহীত হওয়ার পরপরই সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিদের সাময়িক বরখাস্ত করা শুরু হয়। স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত বছর বিভিন্ন মামলায় তিন শতাধিক জনপ্রতিনিধিকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরবর্তীকালে আরো প্রায় ১০০ জনপ্রতিনিধি বরখাস্ত হন। তাদের অনেককে কারারুদ্ধ করা হয়। তাদের অনেকে এখনো কারান্তরীণ রয়েছেন। তবে বরখাস্তকৃতদের অনেকে উচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে দায়িত্ব ফিরেও পেয়েছেন। আবার দায়িত্ব ফিরে পেলেও অনেকে চেয়ারে বসতে পারছেন না।
বগুড়ার গাবতলীর মেয়র থাকাবস্থায় ২০১৩ সালে নাশকতার মামলায় চার্জশিট হওয়ায় চেয়ারম্যান মোর্শেদ মিল্টনকে বরখাস্ত করা হয়। আদালতের মাধ্যমে তিনি চেয়ার ফিরে পেলেও গত বছরের আগস্টে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলে ফেরারি হন তিনি। এই সুযোগে উপজেলা পরিষদের পরপর তিনটি বৈঠকও করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। তিন বৈঠকে অনুপস্থিত থাকার বিষয় নিশ্চিত করে আইনগত ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় সরকার বিভাগে চিঠি দেন তিনি। এ কারণে এ উপজেলা চেয়ারম্যানকে আবারো সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ২০১৩ সালের গাড়ি পোড়ানোর একটি মামলায় সাতক্ষীরা পৌরসভার মেয়র বিএনপির তাজকিন আহমেদের বিরুদ্ধে চার্জশিট হয়। এ কারণে দায়িত্ব নেয়ার আড়াই মাসের মাথায় তিনি সাময়িক বরখাস্ত হন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সাময়িক বরখাস্ত হওয়া জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে দিনাজপুরে ১৮ জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৩, সাতক্ষীরায় ১৮, কক্সবাজারে ১৯, বগুড়ায় ২৭, রাজশাহীতে ১৭, কুষ্টিয়ায় ১১, চট্টগ্রামে ১৯, পাবনায় ১২, সিরাজগঞ্জে ৭, গাইবান্ধায় ২৪, রংপুরে ২৩, পিরোজপুরে ৪, হবিগঞ্জে ৭, নাটোরে ৯, জয়পুরহাটে ৫, ঠাকুরগাঁওয়ে ৮, পঞ্চগড়ে ৬, খাগড়াছড়িতে ৩, বান্দরবানে ৪, চাঁদপুরে ৪, ময়মনসিংহে ৩, শরীয়তপুরে ১, নড়াইলে ১, সিলেটে ২ জন এবং মাগুরায় একজন রয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, নির্বাচিত হওয়ার পর একজন জনপ্রতিনিধি যদি অপরাধ করেন তাহলে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলায় কেউ চার্জশিটভুক্ত আসামি হলে বরখাস্ত হওয়া মানে ওই এলাকার মানুষকে শাস্তি দেয়া। এভাবে গণবরখাস্তের কারণে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অর্থহীন হয়ে পড়ছে। স্থানীয় সরকারের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা নষ্ট হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের ইমেজ ুণœ হচ্ছে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/209419