১৭ জুন ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১:১৯

সিএমএসডির কেনাকাটায় অনিয়ম থেমে নেই

কোথাও কোনো সমস্যা থাকলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে -স্বাস্থ্যমন্ত্রী

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরস ডিপোতে (সিএমএসডি) কেনাকাটায় অনিয়ম থেমে নেই। অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার জন্য ১৫০টি আইসিইউ শয্যা কিনতে ব্যতিক্রমধর্মী কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। উচ্চমূল্যে এগুলো কেনার সব প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে চূড়ান্ত। সরকারি ক্রয় তালিকায় আইসিইউ শয্যার সর্বোচ্চ দাম ধরা আছে চার লাখ টাকা।

কিন্তু প্রতিটি চার লাখ সাত হাজার টাকায় কেনা হচ্ছে। এছাড়া ডিপিএম (ডিরেক্ট প্রকিউরমেন্ট মেথড) পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কেনা হচ্ছে পিসিআর কিটস, মাস্ক, পিপি, হ্যান্ড গ্লাবসসহ সুরক্ষা সামগ্রী। এতে সরকারি নিয়মের ব্যত্যয় ঘটছে। আর্থিক ক্ষতিতে পড়ছে সরকার।

জানা গেছে, সম্প্রতি ১৫০টি আইসিইউ শয্যা (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের বিশেষ শয্যা) কেনার প্রক্রিয়া শুরু করে সিএমএসডি। যেখানে ২৮টি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান টেন্ডারে অংশ নিয়েছিল। সব কাগজপত্র ঠিক থাকলেও সর্বনিম্ন দরদাতাদের কাজ দেওয়া হচ্ছে না। তাদের বাদ দিয়ে উচ্চ দরদাতা একটি প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচিত করা হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। এর আগে ডিপিএম পদ্ধতিতে ৫০০ আইসিইউ শয্যা কেনায় এক সরবরাহকারীকে কার্যাদেশ দিয়ে তা ফের বাতিল করা হয়।

সিএমএসডির এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, প্রতিষ্ঠানের সাবেক এক কর্মকর্তা ফৌজদারি অপরাধ সংঘটিত করায় তাকে ২০১৮ সালে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়। বর্তমান পরিচালক তাকে সিএমএসডিতে পুনর্বহাল করে কেনাকাটার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেন। দায়িত্ব পেয়ে তিনি আইসিইউ শয্যা কেনাকাটায় অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছেন।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টেন্ডারে একটি শর্ত ছিল সরবরহকারী প্রতিষ্ঠানের গত ৫ বছরের মধ্যে অন্তত একই ধরনের একটা ৭ লাখ ডলারের সিঙ্গেল ওয়ার্ডার থাকতে হবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এমন অভিজ্ঞতা রয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠানকেও বাদ দেওয়া হয়েছে। এমনকি আন্তর্জাতিক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সিই সনদও আমলে নেওয়া হয়নি। তারা জানান, এতে সরকারের বিপুল আর্থিক ক্ষতিসাধিত হবে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানের পরিচালক আবু হেনা মোরশেদ জামান যুগান্তরকে বলেন, ১৫০টি আইসিইউ শয্যা কেনার জন্য একটি টেকনিক্যাল এক্সপার্ট কমিটি রয়েছে। বিষয়টি আমি জানতাম না। আজ নজরে আসার পর আমি কমিটির কাছে জানতে চাই এতগুলো বিডার কীভাবে বাদ পড়েছে। তারা আমাকে জানিয়েছেন, সঙ্গত কারণেই বাদ পড়েছে। তার পরও আমি এ সংক্রান্ত ফাইলটি এনেছি। পুরো ফাইলটি দেখব, কোথাও কেনা সমস্যা থাকলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এর আগের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. শহিদউল্লাহ কোভিডের শুরুর দিকে সুরক্ষা সরঞ্জাম দিতে অর্ধশত সরবরাহকারীকে অনুরোধ জানান। তখন কোথাও সুরক্ষা সরঞ্জাম পাওয়া যাচ্ছিল না। তার অনুরোধে সেই দুর্যোগকালে ৭৬০ টাকা করে পিপিই সরবরাহ করা হয়। কিন্তু বর্তমানে একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ডিপিএম পদ্ধতিতে ৯০০ টাকা করে কেনা হচ্ছে। আগের পরিচালকের সময় হ্যান্ডগ্লাবস কেনা হয়েছে ১৮ টাকা পিস হিসাবে ৩৬ টাকা জোড়ায়। বর্তমানে কেনা হচ্ছে ৩৮ টাকা জোড়ায়। আগে পিসিআর কিট কেনা হয়েছে ২৭৩০ টাকা করে, বর্তমান পরিচালক এখানে যোগদানের পরপরই কিনছেন ২৩৫০ টাকায় (ভ্যাট ট্যাক্স ছাড়া)।

এর সঙ্গে সাড়ে ১২ শতাংশ ভ্যাট ও ট্যাক্স যোগ হলে আগের দামের সমান হবে। তবে বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে কিটের দাম অস্বাভাবিক হারে কমে গেছে। সম্প্রতি ৮৮০ টাকায় কেনা হচ্ছে ভ্যাট-ট্যাক্স ছাড়া। সার্জিক্যাল ফেস মাস্ক আগের পরিচালক কেনেন ২১ টাকা দামে, বর্তমানে কেনা হচ্ছে ২৩ টাকায়। এগুলো সবই কেনা হচ্ছে ডিপিএম (ডিরেক্ট প্রকিউরমেন্ট মেথড) পদ্ধতিতে।

এ প্রসঙ্গে সিএমএসডি পরিচালক আবু হেনা মোরশেদ জামান যুগান্তরকে বলেন, মন্ত্রিপরিষদের ক্রয়সংক্রান্ত কমিটি ডিপিএম পদ্ধতিতে সুরক্ষা সরঞ্জাম কিনতে অনুমোদন দিয়েছে। তাই এটা বৈধ পদ্ধতি। এসব কেনাকাটায় ৭ সদস্যের একটি কমিটি রয়েছে যেখানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন মহাপরিচালক, ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষসহ গুরুত্বপূর্ণ বিশেষজ্ঞরা আছেন। যে কোনো কেনাকাটার আগে তারা নমুনা পরীক্ষা করেন, তারপর দরকষাকষি করে কার্যাদেশ প্রদান করেন।

বিল পেতে ৫৭ সরবরাহকারী আবেদন : কোভিড-১৯ মোকাবিলায় ২০২০ সালের কেনা বিভিন্ন জরুরি সামগ্রীর বিলসংক্রান্ত জটিলতা সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছেন ৫৭ সরবরাহকারী। গত ১১ মে তারা এই আবেদন করেন। সেখানে তারা বলেন, গত বছরের ২০ মার্চ দেশে করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে (সিএমএসডি) পিপিই, মাস্ক, গ্লাভস, স্যানিটাইজার, ফেউসশিল্ড, পিসিআর মেশিন, পিসিআর কিটসসহ বিভিন্ন সুরুক্ষা সামগ্রী জরুরি ভিত্তিতে সরবরাহ করা হয়। যা চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা দিয়েছে। কোভিডের প্রথম ধাক্কা মোকাবিলায় যা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

বিগত ২০২০ সালে ২ জুন তারিখে এক স্মারকে তৎকালীন পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহিদউল্লাহ এসব পণ্যের বিল প্রদানে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেন। তবে ৩ জুন নতুন পরিচালক দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে এ পর্যন্ত ওই বিলগুলো পরিশোধের কোনো উদ্যোন নেননি। তারা বলেন, ৫৭ জন সরবরাহকারী ৫৭টি প্যাকেজের বিপরীতে ৩৪৩ কোটি টাকা সিএমএসডিকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এই ৫৭ সরবরাহকারী প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকেও এ বিষয় জানিয়ে চিঠি দেন।

কেন বিল প্রদান করা হচ্ছে না, জানতে চাইলে সিএমএসডির পরিচালক আবু হেনা মোরশেদ জামান যুগান্তরকে বলেন, ৫৭ জনের বিলে ৮ ধরনের সমস্যা রয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে পিপিআর (পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুল) বিধি মেনে বিল পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। তাই ৮ ধরনের সমস্যার সমাধান চেয়ে গত ২৩ মে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি।

তবে এখনো কোনো নির্দেশনা পাইনি। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেলে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।

এ প্রসঙ্গ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক যুগান্তরকে বলেন, কেনাকাটায় কোথাও অনিয়ম হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া সরবরাহকারীদের বকেয়া বিল প্রদান সম্পর্কে তিনি বলেন, তারা সুরক্ষা সরঞ্জাম দিয়েছে, মন্ত্রণালয় সেটি ব্যবহার করেছে। বিল তাদের প্রাপ্য অধিকার। এটি অবশ্যই দ্রুত পরিশোধ করা উচিত।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/432386/