১৭ জুন ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১:১২

‘টিকা কূটনীতি’র উপাখ্যান

অন্য দৃষ্টি

করোনার ভয়াবহ থাবার পরও মানুষ বিনীত হয়নি। ব্যক্তি থেকে সরকার কারো সংশোধন হতে দেখা যায়নি। এ দিকে করোনা নিজেই হয়ে উঠছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সবচেয়ে বড় উপাদান। ধনী দেশগুলো নিজেদের প্রয়োজনের কয়েক গুণ বেশি করোনার টিকা নিশ্চিত করেছে নিজেদের জন্য। আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা আর এশিয়ার দরিদ্র লোকদের কী হবে, এনিয়ে একটুও তারা ভাবেনি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে দরিদ্রদের জন্য টিকা সংগ্রহে ধনী দেশগুলোর প্রতি কাকুতি মিনতি করা হয়েছে। কে শোনে কার কথা? শেষ পর্যন্ত ধনী দেশগুলোর সংস্থা জি-৭ দরিদ্রদের জন্য টিকা নিশ্চিত করার প্রেরণা পেল রাজনীতির উপাদান হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মনে হয়েছে, বিশ্ব পরিসরে চীনকে ঠেকানো দরকার। সে জন্য তারা দরিদ্রদের সৌজন্যে টিকা দেয়ার প্রয়োজন অনুভব করেছে। জাপান, কানাডা এবং ইউরোপের নেতৃস্থানীয় দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রচারণায় অভাবীদের টিকা সরবরাহে এগিয়ে এসেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরে সেটি আগে পারেনি।

আরো কিছু পরিকল্পনা ধনী দেশগুলো নিয়েছে যেগুলো উদার মনে আরো আগে নেয়া যেত। এর মধ্যে রয়েছেÑ করোনার টিকা উৎপাদনের লাইসেন্স উন্মুক্ত করে দেয়া। এ সুযোগ শুরু থেকে পেলে ফাইজার, মডার্না ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার মতো কোম্পানির টিকা হয়তো এতদিনে সবার জন্য সহজলভ্য হয়ে উঠত। এ ছাড়া রোগ শণাক্ত ও চিকিৎসা পদ্ধতি বের করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে শক্তিশালী ও পুনর্গঠন করার পরিকল্পনা নিয়েছেন তারা। অথচ করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠানটিকে কঠোর কঠিন ভাষায় বকেছে। ‘চীনের প্রতি সহনশীল’ হিসেবে এটিকে অভিযুক্ত করেছে। এর অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র সংস্থাটি থেকে নিজের পদ প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। জি-৭এর বাকি দেশগুলো সেই সময় বিশ্ব সংস্থার পাশে দাঁড়ায়নি। যাই হোক, নতুন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের নেতৃত্বে দেশটি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থায় ফিরে এসেছে।
২০২০ সালের শুরুতে চীন যখন করোনায় আক্রান্ত, ট্রাম্পের শাসনাধীন যুক্তরাষ্ট্র তখন চীনের কঠোর সমালোচনা করেছে। এই সুযোগে দেশটিকে চাপের মুখে ফেলার জন্য সব ধরনের অস্ত্র তারা প্রয়োগ করেছেন। করোনা মহামারী আকারে নিজেদের দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে, এমন আশঙ্কা ট্রাম্প প্রশাসন মোটেও করেনি। রাজনৈতিক ফায়দা নেয়ার ঘোরে তিনি সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। তাদের বক্তব্যে মনে হয়েছিল, করোনা শুধু চীনের জন্য একটি অভিশাপ। চলতি বছরের জুনের মাঝামাঝিতে দেখা যায়, করোনায় যুক্তরাষ্ট্র্রে ছয় লাখ ১৫ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, আক্রান্ত হয়েছেন তিন কোটি ৪৩ লাখের বেশি মানুষ।

করোনা বা কোভিড মহামারীর প্রকোপ যুক্তরাষ্ট্রে সর্বোচ্চ মাত্রায় হয়েছে, ভোগান্তির দিক দিয়ে অন্য কোনো দেশ তাদের ধারে কাছে নেই। তাদের পরের অবস্থানে থাকা ১৩০ কোটি মানুষের দেশ ভারতে এ পর্যন্ত তিন লাখ ৬৭ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। দেশটির করোনা পরিসংখ্যান নির্ভরযোগ্য নয়। তার পরও যুক্তরাষ্ট্রের মৃত্যুর চেয়ে এটিকে অনেক কম বলতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র্রের সর্বোন্নত চিকিৎসাব্যবস্থা করোনার মোকাবেলায় কোনো কাজে আসেনি। একই মাত্রায় করোনা বাংলাদেশে ছড়ালে কমপক্ষে সাড়ে তিন লাখ মানুষ প্রাণ হারানোর কথা। অনুন্নত চিকিৎসা এবং করোনা মোকাবেলায় ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে এ সংখ্যা আরো অনেক বেশিও হতে পারত। দেড় বছর পর দেখা যায়, বাংলাদেশে করোনায় ১২ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।

ব্যাপার হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র যে চীনকে ‘অভিশপ্ত’ ভেবেছিল করোনা তাদের দেশে আঘাত হেনেছে তুলনামূলকভাবে মৃদু। গত ১৪ জুন পর্যন্ত চীনে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৯১ হাজার ৪২৮ জন। একই সময়ে মারা গেছেন সর্বমোট চার হাজার ৬৩৬ জন। চীনের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় ১৩২ গুণ বেশি মানুষ মারা গেছেন। আক্রান্ত ৩৭৩ গুণ বেশি। প্রথম দিকে চীনা ব্যবস্থাপনাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয়েছিল, মহামারীর উৎপত্তিস্থল হিসেবে তাদের ঘৃণা করা হয়েছিল। অথচ মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে তারা মহামারী সামলে উঠতে পেরেছে। করোনাকে সবচেয়ে উত্তমভাবে সামাল দেয়ার জন্য যদি কোনো দেশকে কৃতিত্ব দিতে হয় তাহলে দেশটির নাম ‘চীন’। সারা বিশ্বে এ পর্যন্ত ১৭ কোটি ৮০ লাখ মানুষ করোনায় আক্রান্ত। এতে প্রাণ হারিয়েছেন ৩৮ লাখ মানুষ। করোনা নিয়ে চীনকে কতটা দায়ী করা যায় এ অবস্থায়? সেই বিবেচনায় না এনে করোনাকে ‘চীন ঠেকানোর অস্ত্র’ হিসেবে আমেরিকার নেতৃত্বে একটি জোট করা হচ্ছে।

করোনার টিকা নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এক অনন্য সম্পর্ক দেখা গেল। সেখানেও চীনকে ঠেকানোর আভাস পাওয়া গেছে। ভারত অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা উৎপাদনের অনুমতি পাওয়ার পর মোদি সরকারের কর্মকাণ্ডে লক্ষ করার মতো পরিবর্তন দেখা গেল। তারা সেকেন্ড হ্যান্ড অবস্থান থেকে সারা বিশ্বে টিকা বিতরণের একধরনের মহা কর্তব্য হাতে নিয়ে নিলেন। দেশে দেশে টিকা সরবরাহের বিপুল প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেড়াতে থাকলেন। মোদি ‘টিকা মৈত্রী’ নামে এক নতুন পরিভাষা প্রয়োগ করলেন। ভারতীয় প্রচারবিদরা একে নাম দিলেন ‘টিকা কূটনীতি’। এর আওতায় বিভিন্ন দেশে অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভারতীয় ব্র্যান্ড পাঠানো শুরু হলো। ‘প্রতিবেশী প্রথম’ হিসেবে টিকা উপহার পাঠানোর হিড়িক পড়ে গেল। বাংলাদেশ উপহার হিসেবে তিন দফায় ভারত থেকে টিকা পেয়েছে। সৌজন্য প্রদর্শনের গুরুত্ব রয়েছে। মূল ব্যাপার হলোÑ এ দেশের এক-চতুর্থাংশ মানুষকে টিকা দিতে হলে প্রয়োজন প্রায় ৯ কোটি ডোজ। সে জন্য উপহার পাওয়ার চেয়ে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে টিকা পাওয়ার নিশ্চয়তা পাওয়া অনেক বেশি জরুরি।

ভারত উৎসাহের সাথে যখন এভাবে টিকা উপহার দিচ্ছিল নিজের দেশের পরিস্থিতি আমলে নেয়ার কোনো প্রয়োজন মনে করেনি। ভারতীয় বুদ্ধিজীবীরা বিভিন্ন দেশে টিকা সরবরাহের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চীনের বিপরীতে ভারত কতটা প্রভাবশালী হয়ে উঠছিল সে হিসাব-নিকাশ করছিলেন। উচ্চ প্রচারণায় মোদি সরকার আহ্লাদিত। দেশের অভ্যন্তরে ভোটের রাজনীতি নিয়ে তুমুল ব্যস্ত। শীর্ষ নেতা মোদি থেকে শুরু করে বিজেপি নেতাদের একটিই বক্তব্যÑ আমরা করোনাকে পরাজিত করেছি। মোদি ও অমিত শাহ যেভাবে সব কিছু ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন তাতে মনে হয়েছে পৃথিবীর একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির বিজয়। এর মধ্যে খবর আসতে শুরু করে করোনার সীমাহীন বিস্তারের। এতে নতুন মাত্রা যোগ করে ‘ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট’। নরেন্দ্র মোদির হুঁশ ফেরার আগেই দিনে গড়ে চার লাখ আক্রান্ত আর দৈনিক চার হাজার মৃত্যুর রেকর্ড গড়ে ভারত। কথাগুলো আমরা এ জন্য উল্লেখ করলাম যে, ভারতের কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণের কারণে বাংলাদেশও মহা বিপদে পড়েছে।

ভারতীয় ‘টিকা কূটনীতি’র খপ্পরে পড়ে গেল বাংলাদেশ। তারা আমাদের কয়েক দফায় উপহার দিলেন, কিন্তু যে টিকার জন্য অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে সেটি দিতে পারলেন না। একই অবস্থা বন্ধুপ্রতিম অনেকগুলো দেশের সাথেই ঘটেছে। টিকাদাতা থেকে দেশটি অল্প কিছু দিনের মধ্যে যেন টিকা ভিখারি দেশে পরিণত হলো। বাংলাদেশে এমন একসময় ভারতের এ দুর্বলতার ব্যাপার টের পেল যখন আর কিছু করার থাকল না। আমরা দেখেছি, টিকার ট্রায়ালের জন্য চীনারা আমাদের দেশে ঘুরেছেন। এমনকি কয়েক মাস তারা ধর্ণা দিয়েছেন। অথচ চীনা কোম্পানি টাকা চাচ্ছে বলে প্রচারণা চালানো হলো। শেষ পর্যন্ত তারা আমাদের দেশে টিকার ট্রায়াল চালাতে পারেননি। ওই ট্রায়াল চালাতে পারলে আমরা উপহার হিসেবে তাদের কাছ থেকে শুরুতেই করোনার টিকা পেতাম এবং যৌথভাবে উৎপাদন করতে পারতাম। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে, অগ্রাধিকার হিসেবে তাদের সথে চুক্তি করতে পারতাম। অগ্রিম টাকা পরিশোধ করেও আমরা যখন ভারত থেকে টিকা পাচ্ছি না, বাধ্য হয়ে আমরা আবার চীনমুখী হয়েছি। আবার জানাও গেছে ভারত থেকে টিকা কেনা ছাড়া বাংলাদেশের জন্য কোনো বিকল্প রাখা যায়নি। এই হচ্ছে ভারতের টিকা কূটনীতি।

চীন থেকে টিকা সংগ্রহ করতে গিয়ে নানা ধরনের বাধাবিপত্তি সৃষ্টি হলো। সে কারণে চীনা রাষ্ট্রদূত বলেছেন, সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করলে পস্তাতে হবে। কেন আমরা চীনের সাথে কাজ করতে গিয়ে নানা ধরনের জড়তার মধ্যে পড়ে যাই? চীনের ব্যাপারে যেকোনো প্রকল্প গ্রহণ করতে গেলেই ‘প্রতিবন্ধকতা’ দেখা যায়। বাংলাদেশের প্রতি চীনের আগ্রহ থাকার ব্যাপার বোঝা যায়। ভারত আমাদের টিকা ব্যবস্থাপনা এলোমেলো করে দিয়ে সটকে পড়ল। অন্য দিকে চীন আমাদের কম মূল্যে টিকা দিয়েছে। একই টিকা তারা শ্রীলঙ্কা ও ইন্দোনেশিয়া এবং অন্যান্য দেশে এর চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করেছেন। তাই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সেটি গোপন রাখার অঙ্গীকার করেছিল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের আমলারা একেবারে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছেন। অথচ সেরামের সাথে যখন বাংলাদেশী একটি কোম্পানির টিকা প্রাপ্তি নিয়ে চুক্তি হচ্ছিল ন্যায্য তথ্য-উপাত্তগুলো তারা নিজেরাও জানতে পারেননি। কিংবা জানলেও সেটি জানানোর দুঃসাহস তারা দেখাননি। ভারত ও চীনকে নিয়ে বাংলাদেশের ত্রিমাত্রিক সম্পর্কের স্বরূপ টিকা ইস্যুতে স্পষ্ট হয়ে দেখা দিলো।

টিকা নিয়ে আমাদের সঙ্কটের সময়ের ঘটনাটি পর্যালোচনা করা দরকার। চীনা কোম্পানির সাথে আমরা শুরুতে সঠিক আচরণ করিনি। আমাদের বৈরিতার কারণে তারা এ দেশ থেকে ফিরে গেছেন। অন্য দিকে আমরা যখন কোথাও থেকে টিকা পাওয়ার সুযোগ পাচ্ছি না, চীন তখন আমাদের সহজে টিকা সরবরাহ করছে। সঙ্কটের সুযোগ গ্রহণ না করে বরং তারা আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে কম দামে সেটি করছে। অন্য দিকে আমরা তাদের সাথে আবারো প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে গোপনীয়তা ফাঁস করে দিলাম। এতে করে অনেক দেশের সাথে চীনেরর সম্পর্ক খারাপ হওয়ার শঙ্কা সৃষ্টি হল। এ কারণে তাদের ব্যবসায়ও ক্ষতিগ্রস্ত হল। এ অবস্থায় বাংলাদেশকে নিজের স্বার্থে কোনো এক দিকে হেলে পড়া নয় বরং এ দুটো বড় দেশের সাথে ভারসাম্যমলক সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। হ
jjshim146@yahoo.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/588806/