৪ এপ্রিল ২০১৭, মঙ্গলবার, ১০:১৮

উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীদের মত

সক্ষমতা না বাড়িয়ে ভারতকে বন্দর ব্যবহারের সুযোগ নয়

এখনই চুক্তি হলে পরিস্থিতি জটিল হবে * দিল্লি নিজস্ব বিনিয়োগে আলাদা পোর্ট করলে সুযোগ দেয়া যেতে পারে

সক্ষমতা না বাড়িয়ে ভারতকে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দেয়ার পক্ষে নন ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, বর্তমানে দুই বন্দর বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দরে যে অবকাঠামো সুবিধা আছে তাতে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি পণ্য হ্যান্ডলিং ও পরিবহন করতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ অবস্থায় কোনো দেশকে গুরুত্বপূর্ণ দুই বন্দর ব্যবহারের সুবিধা দেয়া হলে পরিস্থিতি জটিল হবে। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে বর্তমানে যে অবকাঠামো সুবিধা আছে, তা দ্বিগুণ করেই শুধু অন্য দেশকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়া যেতে পারে। আবার ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ বলছেন, ভারত চাইলে নিজস্ব বিনিয়োগে বাংলাদেশে সুবিধামতো স্থানে আলাদা পোর্ট স্থাপন করতে পারে। শর্তসাপেক্ষে নির্দিষ্ট চুক্তির মাধ্যমে প্রতিবেশী এ দেশটিকে এমন সুযোগ দেয়া যেতে পারে। আর সে পোর্ট ব্যবহার করেই ভারত তাদের পণ্য নিয়ে যেতে পারবে। এটা হলে পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের জটিলতা তৈরি হবে না। এর মধ্য দিয়ে উভয় দেশই অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। চট্টগ্রাম বন্দরও চাপে পড়বে না।


৭ থেকে ১০ এপ্রিল চার দিনের সফরে ভারত যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিতব্য দুই দেশের সরকারের মধ্যে বৈঠকে অন্য এজেন্ডার সঙ্গে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারে ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা প্রদানের বিষয়টিও রয়েছে। ভারত তাদের পণ্য ওঠানামার জন্য দুই বন্দরে বিশেষায়িত ইয়ার্ড ও শেড পেতে চায়। এ ব্যাপারে একটি খসড়া চুক্তিও তৈরি হয়েছে। তাই বিষয়টি আবার সামনে চলে এসেছে। কী আছে সেই খসড়া চুক্তিতে, তা যেমন জানার জন্য উদগ্রীব সংশ্লিষ্টরা, তেমনি ভারতীয় পণ্য হ্যান্ডলিং ও পরিবহনের ক্ষেত্রে কী ধরনের মাসুল ধার্য করা হচ্ছে বা আদৌ মাসুল ধরা হচ্ছে কিনা, কোন ধাপে ভারতকে কী ধরনের সুবিধা দেয়া হবে, বাংলাদেশই বা এতে কী ধরনের লাভবান হবে- এসব বিষয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা। মোটকথা, ট্রানজিট নিয়ে তাদের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাজ করছে।

সূত্র জানায়, ভারত তাদের পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের জন্য চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে ‘বিশেষায়িত জেটি বা ইয়ার্ড চায়।’ একই সঙ্গে চায় ট্যারিফ সুবিধাও। ট্রানজিট সুবিধায় বন্দর ব্যবহার সম্পর্কিত ‘স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর’ বা এসওপি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এর আগেই দুই দেশের মধ্যে এ বিষয়ে চুক্তির তোড়জোড় শুরু হয়েছে।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম যুগান্তরকে বলেন, ‘বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে এক দেশ আরেক দেশের ওপর নির্ভরশীল। এক দেশের বন্দর আরেক দেশ ব্যবহার করবে। এক্ষেত্রে দেশগুলো পরস্পরের নিজেদের লাভ-ক্ষতির বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনায় রাখবে। বাংলাদেশও যদি ভারতকে চট্টগ্রাম বা মংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ বা ট্রানজিট সুবিধা দেয়, তবে সেক্ষেত্রে বাংলাদেশও নিজের স্বার্থ আগে দেখবে- এটাই আমার বিশ্বাস।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দরের যে অবকাঠামো সুবিধা রয়েছে তাতে অন্য দেশকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার মতো পরিস্থিতি নেই। এক্ষেত্রে বন্দরের অবকাঠামো সুবিধা দ্বিগুণ করতে হবে। ভারতের সেভেন সিস্টারের জন্য মূলত ট্রানজিট সুবিধা চাওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে সেখানে। ট্রানজিট হলে বাংলাদেশের জন্যও লাভ। কিন্তু এর আগেই চট্টগ্রাম বন্দরের হ্যান্ডলিং ক্ষমতা দ্বিগুণ করতে হবে। পতেঙ্গায় বে-টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। এখানে নির্দ্বিধায় ১২-১৩ মিটার ড্রাফটের ৫০-৬০ হাজার টন পণ্যবাহী জাহাজ প্রবেশের সুযোগ রয়েছে। বে-টার্মিনাল থেকে নদী, সড়ক ও রেলপথে সারা দেশে পণ্য পরিবহনের সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি সড়ক ও রেলযোগাযোগের পরিধিও বাড়াতে হবে। ’

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক (বন্দর ও কাস্টমস) খাইরুল আলম সুজন যুগান্তরকে বলেন, চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে ভারতকে ট্রানজিট না দিয়ে বাংলাদেশে তাদের আলাদা পোর্ট স্থাপনের সুযোগ দেয়া যেতে পারে। শর্তসাপেক্ষে নির্দিষ্ট চুক্তির মাধ্যমে স্থাপন করা এ পোর্ট ব্যবহার করে ভারত যেমন অধিক লাভবান হতে পারবে, তেমনি বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড চট্টগ্রাম বন্দরকেও নতুন করে চাপে পড়তে হবে না। এক্ষেত্রে তিনি মালয়েশিয়ার ‘তানজুং পালাপাস’ বন্দরের উদাহরণ দেন। তিনি বলেন, ‘মার্কস লাইন নামে ভিন দেশের একটি বেসরকারি কোম্পানি নিজেদের বিনিয়োগে এ বন্দর উন্নয়ন করে তা ব্যবহার করছে। বিনিময়ে নির্দিষ্ট হারে রাজস্ব পাচ্ছে মালয়েশিয়া।’

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বার সিনিয়র সহসভাপতি এএম মাহবুব চৌধুরী বলেন, ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার আগে দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হবে। একটি হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করে দ্রুত সময়ের মধ্যে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় বে-টার্মিনাল নির্মাণ করতে হবে। একই সঙ্গে বন্দরের সামনে যে রাস্তা, সে রাস্তায় সাধারণ মানুষ ও যানবাহন চলাচল বন্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। দেয়ানহাট থেকে বারিক কাটগড় পর্যন্ত ফ্লাইওভার নির্মাণ করতে হবে। বন্দরের পণ্য পরিবহনে ডেডিকেটেড সড়কের ব্যবস্থা করতে হবে। এ দুটি কাজ হলেই শুধু ভারতকে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দেয়া যেতে পারে। এর আগে যদি এ ধরনের কোনো চুক্তি হয়, তাহলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের অর্থনীতি।

সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দর দেশের ৮৫ শতাংশ আমদানি-রফতানি পণ্য হ্যান্ডলিং করছে। আর আমদানি-রফতানি দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্দরের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি এখন ১৪-১৫ শতাংশ। কিন্তু সে অনুপাতে জেটি-বার্থ, টার্মিনাল, ইয়ার্ড, ইকুইপমেন্ট নেই। বরং প্রবৃদ্ধি বাড়ার বিপরীতে বন্দরের সক্ষমতা দিন দিন কমছে। এ কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার ও জাহাজ জট এখন নিত্যদিনের ঘটনা। গত বছর চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা হয়েছে ২৩ লাখ ৪৬ হাজার ৯০৯ টিইইউএস। যেভাবে আমদানি-রফতানি বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে ২০২০ সালে ২৮ লাখ টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং করতে হবে। অথচ চট্টগ্রাম বন্দর এখনও এ ২৮ লাখ টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা অর্জন করেনি। এ অবস্থায় ভারতকে ট্রানজিট সুবিধার আওতায় চট্টগ্রাম বন্দরে তাদের জেটি ব্যবহার ও পণ্য পরিবহনে সুনির্দিষ্ট ইয়ার্ড বা জেটি ব্যবহারের সুযোগ দিলে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় এক শিল্পোদ্যোক্তা যুগান্তরকে বলেন, ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দিলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অনগ্রসর ৭টি রাজ্যে বাংলাদেশে উৎপাদিত শিল্পপণ্যের যে বাজার রয়েছে এবং এ বাজার আরও সম্প্রসারণের সম্ভাবনা রয়েছে, সেই সম্ভাবনাও নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কারণ ট্রানজিট চুক্তি হলে তখন ভারত বাংলাদেশের পরিবর্তে অন্য দেশ থেকেও ৭ রাজ্যে পণ্য নিয়ে যেতে পারবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত শিল্পপ্রতিষ্ঠান রুগ্ণ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধ, খাদ্যপণ্য, সিমেন্ট, স্টিল ও আয়রন, আইটি-সামগ্রী, রাসায়নিক-সামগ্রী, জুয়েলারি দ্রব্যাদি, তৈরি পোশাক, সিরামিক, প্লাস্টিকজাত পণ্য, খেলনা, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পপণ্য ইত্যাদির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে ভারতের ত্রিপুরা, আসাম, মিজোরাম, অরুণাচল, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড ও মনিপুরে।

ভারতকে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুযোগ বা ট্রানজিট দেয়া প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের মুখপাত্র ও পরিচালক (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) মো. জাফর আলম যুগান্তরকে বলেন, ট্রানিজটের বিষয়ে যদি ভারতের সঙ্গে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো চুক্তি হয়, তা অনুসরণ ও যথাযথ বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকবে বন্দর কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম বন্দরে অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে- এ কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, সরকার চাইলে এসব সীমাবদ্ধতা দূর করা সম্ভব। সুযোগ-সুবিধাও বৃদ্ধি করা সম্ভব।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/04/04/114837/