১৫ জুন ২০২১, মঙ্গলবার, ১:০৭

জ্বর কাশির উপসর্গ এখন ঘরে ঘরে

ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোতে করোনার উচ্চহারের সংক্রমণ

গত কিছুদিন করোনাভাইরাসের ডেল্টা ভেরিয়েন্ট সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে সীমাবদ্ধ ছিল, এখন তা দ্রুতই প্রতিদিন নতুন নতুন জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে। এমনকি রাজধানী ঢাকার কাছাকাছি জেলাগুলোতেও চলে এসেছে উচ্চহারের সংক্রমণ। বিশেষ করে ঢাকার কাছে টাঙ্গাইলে উচ্চহারের সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে, অর্থাৎ গত এক সপ্তাহে এ জেলায় শনাক্ত হার ২৫ শতাংশের ওপরে। এর পাশাপাশি অনেক এলাকায়ই এখন ঘরে ঘরে দেখা দিচ্ছে জ্বর, সর্দি-কাশি, গলা ব্যথার মতো উপসর্গ। ফলে কোনটি করোনা আর কোনটি সাধারণ মৌসুমি উপসর্গ তা বুঝতে পারছেন না অনেকেই।

সরকারের পক্ষ থেকে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর মানুষকে বেশি বেশি নমুনা পরীক্ষার পরামর্শ দেওয়া হলেও অনেক এলাকায়ই মানুষ পরীক্ষায় আগ্রহী হচ্ছে না। এমনকি বিনা মূল্যে পরীক্ষার ব্যবস্থা করার পরও তাতে আশানুরূপ সাড়া মিলছে না। তবে যারা পরীক্ষা করাচ্ছে তাদের মধ্যে উচ্চহারে শনাক্ত হচ্ছে করোনা। এরই মধ্যে কোথাও কোথাও ৫০-৭০ শতাংশ পর্যন্ত শনাক্তের হার দেখা গেছে। যদিও সারা দেশের পরীক্ষার অনুপাতে দৈনিক গড় হার প্রায় এক সপ্তাহ ধরেই ১৩-১৪ শতাংশে থাকছে। সে হিসাবে বাকি ৮৬-৮৭ শতাংশের পরীক্ষার রিপোর্ট নেগেটিভ আসছে, যাদের বেশির ভাগের কোনো না কোনো উপসর্গ রয়েছে। ফলে যাদের রেজাল্ট নেগেটিভ হয়েছে তাদের উপসর্গ কেন হলো, সেই প্রশ্নও উঠছে। এমন পরিস্থিতির দিকে নজর রেখে জ্বর বা অন্যান্য উপসর্গ দেখা গেলেই হেলাফেলা না করে পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

জানতে চাইলে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, ইউজিসি অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, এখন মৌসুমি জ্বরসহ আরো কিছু রোগের প্রকোপ থাকলেও যেহেতু করোনাভাইরাসের মহামারি চলছে, তাই উপসর্গ থাকলেই প্রথমত করোনাকে গুরুত্ব দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে জরুরিভাবেই পরীক্ষা করাতে হবে এবং আইসোলেশনে থাকতে হবে রেজাল্ট নেগেটিভ না হওয়া পর্যন্ত।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলামও রবিবারের বুলেটিনে উপসর্গ দেখা দিলেই নমুনা পরীক্ষার অনুরোধ জানিয়েছেন সবার প্রতি। সীমান্ত এলাকায় মানুষের সুবিধার জন্য মোবাইল স্যাম্পল সংগ্রহ ও ফ্রি টেস্টের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলেও তিনি জানান।

তবে বিভিন্ন জেলায় উপসর্গ থাকলেও মানুষ পরীক্ষা করাতে না যাওয়ার কারণ হিসেবে সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, হয়রানি ও কর্মহীন হওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন অনেকেই।

সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের গ্রামে গ্রামে বহু মানুষের জ্বরসহ বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। সেখানে নমুনা সংগ্রহের জন্য ভ্রাম্যমাণ টিম কাজ করছে। তবু উপসর্গধারী মানুষ পরীক্ষার জন্য নমুনা দিতে আগ্রহী হচ্ছে না। শিবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সায়েরা খান বলেন, এখানে শিক্ষিত সচেতন ব্যক্তিরা নমুনা দিচ্ছেন। গ্রামের মানুষের নমুনা দিতে তেমন আগ্রহ নেই। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সিভিল সার্জন ডা. জাহিদ নজরুল কালের কণ্ঠকে জানান, বর্তমানে জেলাটিতে শনাক্তের হার নিম্নমুখী। সর্বশেষ গত রবিবার ১৬ শতাংশে এসেছে। এর আগে ৬২ শতাংশ পর্যন্তও সংক্রমণ ছিল। তিনি বলেন, ‘গ্রামের অসহায় মানুষের এক ধরনের ভীতি রয়েছে যে পরীক্ষার রিপোর্ট পজিটিভ এলে ১৪ দিনের আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হবে। তারা কাজে যেতে পারবে না, আয় কমে যাবে। তাই অনেকে উপসর্গ থাকলেও গোপন রাখার চেষ্টা করছে। তবে আমরা খবর পেলে নমুনা সংগ্রহের চেষ্টা করছি।’

মাগুরায় বাড়ছে করোনা রোগীর সংখ্যা। মাগুরা সিভিল সার্জন শহিদুল্লাহ দেওয়ান জানান, স্বাস্থ্য বিভাগ, পৌরসভা, জেলা প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালনো হচ্ছে পরীক্ষার জন্য। কিন্তু অনেকে জ্বর, সর্দি, কাশিকে এখনো মৌসুমি অসুখ হিসেবে ভেবে পরীক্ষা করাতে আগ্রহী হচ্ছে না। খুব জটিল পর্যায়ে না গেলে তারা করোনার নমুনা পরীক্ষার বিষয়ে আগ্রহী হচ্ছে না।

যশোরের সীমান্তবর্তী বেনাপোল পোর্ট থানা ও শার্শা উপজেলায় সর্দি-কাশি-জ্বরে আক্রান্ত রোগী হঠাৎ বেড়ে গেছে বলে স্থানীয় স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন। এসব রোগীর মধ্যে জ্বর নিয়ে ভীতি থাকলেও করোনা পরীক্ষায় তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। বাগআঁচড়া সাত মাইলের রুবা ক্লিনিকের পরিচালক ডা. আহসান হাবিব রানা বলেন, সামান্য সর্দি, জ্বর বা গলা ব্যথার উপসর্গ দেখা দিলেই গ্রামের সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটি করছে। ফার্মেসিতে সর্দি-কাশি-জ্বরের ওষুধ বিক্রি ব্যাপক বেড়ে গেছে জানিয়ে বেনাপোল কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির সাধারণ সম্পাদক বজলুর রহমান বলেন, এখন বেনাপোলের বেশির ভাগ বাড়িতেই কেউ না কেউ জ্বর-কাশিতে আক্রান্ত। তাদের বেশির ভাগই বিভিন্ন ফার্মেসি থেকে উপসর্গের কথা বলে ওষুধ কিনে খাচ্ছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ইউসুফ আলী জানান, এ পর্যন্ত উপজেলায় ৪৫১ জন করোনা রোগী পাওয়া গেছে, যাদের হোম কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে।

চুয়াডাঙ্গা স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত ৭ থেকে ১৩ জুন পর্যন্ত এই সাত দিনে জেলায় করোনা সংক্রমিত হয়েছে ২০৯ জন। নমুনা পরীক্ষা হয়েছে প্রায় ৬০০ জনের। এই হিসাবে গড়ে প্রতিদিন ১০০ জনেরও কমসংখ্যক মানুষ নমুনা দিয়েছে। চুয়াডাঙ্গার সিভিল সার্জন ডা. এ এস এম মারুফ হাসান বলেন, ‘মানুষ করোনা পরীক্ষার ব্যাপারে আগ্রহী নয়। নিজ উদ্যোগে নমুনা দিতে আসা মানুষের সংখ্যা কম। বেশি সংক্রমিত এলাকায় আমরা এন্টিজেন পরীক্ষা করছি।’

নওগাঁর সীমান্তবর্তী এলাকায় করোনা পরীক্ষায় জনগণের তেমন সাড়া মিলছে না। পত্নীতলা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. খালিদ সাইফুল্লাহ বলেন, জনগণের করোনা পরীক্ষায় তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।

রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলায় করোনা আক্রান্তের হার শতকরা ৫০ ভাগের ওপরে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মাহাবুবা খাতুন বলেন, দুর্গাপুরে দিন দিন করোনার প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষ করোনা পরীক্ষা করাতেই চাচ্ছে না। এমনকি ভর্তি রোগীদের পরীক্ষার জন্য বলা হলে তারা হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহসীন মৃধা বলেন, ‘আমরা সরকারি আদেশ অনুয়ায়ী সবাইকে সচেতন করছি।’

নাটোরের সিভিল সার্জন ডা. কাজী মিজানুর রহমান বলেন, ‘ফ্রি করার পরে নুমনা দেওয়ার হার বেড়েছে। আমরা প্রায়োরিটি ভিত্তিতে যাদের ন্যূনতম উপসর্গ রয়েছে, তাদের ফ্রি পরীক্ষা করাব। আশা করছি দু-এক দিনের মধ্যেই আমরা এই জেলার সাতটি উপজেলাতেই ফ্রি র‌্যাপিড এন্টিজেন পরীক্ষা করাতে পারব।’

রাজশাহী সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে প্রতিদিন নগরীর ১২টি পয়েন্টে করোনার র‌্যাপিড এন্টিজেন পরীক্ষা করা হচ্ছে। এতে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে এক হাজার। কিন্তু প্রতিদিনই সেটি ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে দুপুর ১টার আগেই পরীক্ষা বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। আবার রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকার বাসিন্দারা নগর স্বাস্থ্য কর্মকর্তার সুপারিশ নিয়ে যে হারে প্রতিদিন ল্যাবে পরীক্ষা করাতে চাচ্ছে, সেই হারেও পরীক্ষা করানো যাচ্ছে না। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ করোনা ল্যাবের ইনচার্জ সাবেরা গুলনাহার জানান, এখানে প্রতিদিন এখন পাঁচ শিফটে ৪৭০ জনের করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে, যার অন্তত অর্ধেক রাজশাহী শহরের বাসিন্দা। এর বাইরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ, পাবনা থেকেও নমুনা আসছে। কিন্তু প্রতিদিন নমুনা আসছে ৬০০-৮০০ পর্যন্ত।

রংপুর বিভাগের সীমান্ত জেলাগুলোতে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটিই বেড়েছে। সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে চোরাকারবারিদের অবাধ যাতায়াতের কারণে এই সংক্রমণ বলে মনে করছে বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিপ্তরের উপপরিচালক ডা. মো. জাকিরুল ইসলাম জানান, বিভাগীয় নগরী রংপুরে দৈনিক হাজারো ভাসমান মানুষের আনাগোনা থাকলেও অন্য সব জেলার তুলনায় এই শহরে করোনা সংক্রমণের হার তুলনামূলক অনেক কম। কিন্তু সীমান্ত লাগোয়া নীলফামারী, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামে সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটিই বেশি।

শেরপুরেও সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। নমুনা পরীক্ষা যত বাড়ছে, আক্রান্তের হারও তত বাড়ছে। জেলা হাসপাতালে গতকাল ৫২ জনের নমুনা পরীক্ষায় ১৭ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়। টেস্ট বেশি হওয়ায় আক্রান্তও বেশি ধরা পড়ছে বলে জানিয়েছেন জেলা হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. খায়রুল কবীর সুমন।

সাতক্ষীরা সীমান্তের গ্রামগুলোতে জ্বর-সর্দিসহ করোনা উপসর্গ নিয়ে গ্রাম্য চিকিৎসক ও কবিরাজদের কাছে চিকিৎসা নিচ্ছে শত শত নারী-পুরুষ। গ্রাম থেকে অনেক দূরে জেলা ও উপজেলা সদর, করোনা ধরা পড়লে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত একঘরে হয়ে থাকাসহ নানা প্রতিবন্ধকতায় জ্বর হলেও টেস্ট করছে না অনেকে। কলারোয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম লাল্টু বলেন, সীমান্তঘেঁষা গ্রামগুলোর প্রতিটি বাড়িতেই জ্বর-সর্দি নিয়ে কেউ না কেউ চিকিৎসা নিচ্ছে। অসুস্থ শরীরে কেউ উপজেলা সদরে বা জেলা সদরে চিকিৎসা করাতে যায় না। উপসর্গ দেখা দিলেই যে করোনা পরীক্ষা করাতে হবে, এ বিষয়ে স্বাস্থ্য বিভাগে ওয়ার্ড পর্যায়ের কর্মীরা প্রচার চালাচ্ছেন না।

ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রামের মানুষের মধ্যে করোনা উপসর্গ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ঘরে ঘরে ঠাণ্ডা, কাশি, জ্বরে ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। উপসর্গ থাকলেও নমুনা পরীক্ষার ব্যাপারে এক ধরনের অনীহা রয়েছে অনেকের।

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক রাজশাহী ও রংপুর এবং যশোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, ঝিনাইদহ, শেরপুর, সাতক্ষীরা, নওগাঁ, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা প্রতিনিধি)

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2021/06/15/1043352