১৫ জুন ২০২১, মঙ্গলবার, ১:০৭

প্রশাসনের সমন্বয়হীনতায় উপেক্ষিত বিধি-নিষেধ

উচ্চ ঝুঁকির জেলা বিচ্ছিন্ন না করলে বিস্তার ঠেকানো যাবে না, সংক্রমণ ঢাকামুখী

করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির মুখে প্রতিদিনই বাড়ছে জেলাভিত্তিক লকডাউনও। সীমান্তবর্তী জেলা ছাড়িয়ে এখন অন্য জেলাও আসছে লকডাউনের আওতায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে সংক্রমণ অন্য জেলায় বিস্তার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা না থাকার কারণেই তা ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে ঢিলেঢালা লকডাউন বা বিধি-নিষেধের ফলে মানুষ ওই জেলাগুলো থেকে অন্য জেলায় যাতায়াত করছে। তবে যেখানে লকডাউন তুলনামূলক ভালোভাবে পালিত হচ্ছে সেখানে সংক্রমণের হার কমে আসছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে এরই মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জে শনাক্ত হার ৬২ শতাংশ থেকে ১৬ শতাংশে নেমে এসেছে।

স্বাস্থ্য বিভাগ বা জনস্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন প্রশাসনের পক্ষ থেকে বেশির ভাগ জেলায়ই কঠোরভাবে লকডাউন বা বিধি-নিষেধ বাস্তবায়ন করতে না পারার কারণেই করোনা ছড়াচ্ছে। তবে কেন কঠোরভাবে তা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না এর কোনো পরিষ্কার ব্যাখ্যা মিলছে না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে। অনেকের ধারণা, স্বাস্থ্য প্রশাসন ও সিভিল প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্বহীনতার কারণেই সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়িত হচ্ছে না।

গতকাল সোমবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক তাঁর মায়ের মৃত্যুতে রাজধানীর বিসিপিএসে এক দোয়া অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের বলেন, আবারও দেশে সংক্রমণ বৃদ্ধির পথে। যদি এখনো সবাই সাবধান না হন, স্বাস্থ্যবিধি না মানেন তবে হাসপাতাল বা বেড বাড়িয়েও কুলানো যাবে না।

জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, সীমান্তের কিছু জেলায় সংক্রমণ বাড়ছে। এই ভাইরাসটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যেখানে কেউ আক্রান্ত হয়, সেখানে একটা সময় পর্যন্ত বাড়ে। এরপর নানা উদ্যোগ নেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে কমে যায়। এবার সীমান্ত জেলার গ্রামগুলোতেও অনেক আক্রান্ত হচ্ছে। তিনি নিজের জেলার কথা জানিয়ে বলেন, মেহেরপুরের গাংনীতে একটি ইউনিয়নে ৪০ জন পর্যন্ত রোগী পাওয়া গেছে। এভাবে দর্শনা ও মুজিবনগরেও অবস্থার অবনতি হচ্ছে। আগামীকাল (আজ মঙ্গলবার) থেকে গাংনীর তিনটি ইউনিয়নে লকডাউন দেওয়া হচ্ছে।

প্রশ্নের জবাবে ফরহাদ হোসেন বলেন, করোনার যে বৈশিষ্ট্য তাতে প্রশাসনের ব্যর্থতা আছে বলা যাবে না। কারণ রোগটি ছড়ানোর একটা পর্যায়ে গিয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে। কোথায় কী অবস্থা হবে, আগে থেকে বলা যায় না। আর চাইলেই হঠাৎ করে লকডাউন দিয়ে দেওয়া যায় না। এলাকার মানুষকে বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন করার মাধ্যমে পদক্ষেপ নিতে হয়।

এদিকে সংক্রমণ বিস্তারের বিষয়ে সরকার গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা বারবার বলেছি স্থানীয়ভাবে কোনো জেলায় লকডাউনের পাশাপাশি ওই জেলার সঙ্গে অন্য জেলার যোগাযোগ কমপক্ষে দুই সপ্তাহের জন্য সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন রাখতে হবে। কিন্তু সেটিও যেমন হলো না, আবার ওই জেলার মধ্যেও লকডাউন ঢিলেঢালাভাবে চলে। ফলে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। এ ছাড়া ঢাকাসহ অন্য সব জেলায়ই এখন আবার জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। পরিবহন, মার্কেটসহ কোথাও শর্ত অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না।’ এই বিশেষজ্ঞ বলেন, এরই মধ্যে অনেক জেলায় বিস্তার ঘটেছে ডেল্টা ভেরিয়েন্টের। ঢাকায়ও এই ভেরিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে আগেই। এখন যদি ঢাকায় অন্য জেলার মতো ঊর্ধ্বগতি দেখা দেয় তবে কিন্তু বিপদের শেষ থাকবে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টা ডা. আবু জামিল ফয়সাল কালের কণ্ঠকে সরাসরি বলেন, স্বাস্থ্য প্রশাসন ও সিভিল প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্বহীনতার কারণেই সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। স্বাস্থ্য বিভাগ যা চায় বা পরামর্শ দেয়, সেটা সিভিল প্রশাসন বাস্তবায়ন করতে পারছে না বা করছে না। আবার সংসদ সদস্য ও অন্যান্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও দায়িত্ব নিয়ে সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়নে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসছেন না। ফলে লকডাউন বা বিধি-নিষেধ যা-ই হোক না কেন, তা প্রত্যাশিত মাত্রায় কার্যকর হচ্ছে না। যেটা কিছুটা চাঁপাইনবাবগঞ্জে হয়েছিল বলেই সুফল দেখা যাচ্ছে।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাঠ প্রশাসন) রফিকুল ইসলাম গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, যশোর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্ত জেলা হওয়া সত্ত্বেও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে। আবার অন্য দু-একটিতে সংক্রমণ একটু বাড়তির দিকে। ঠিক কেন এমন হচ্ছে তার নির্দিষ্ট কারণ বের করা কঠিন। তবে স্বাস্থ্যবিধি মানা এবং সম্ভাব্য সব ধরনের সতর্কতা গ্রহণে কোনো ধরনের শৈথিল্য হচ্ছে না। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নতুন উদ্যোগ হিসেবে সীমান্তে যারা মালামাল পরিবহন ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছি আমরা। আজই (গতকাল সোমবার) এসংক্রান্ত চিঠি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, জননিরাপত্তা বিভাগ, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সবার কাছে পাঠানো হয়েছে। সেই সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভারতেও যাতে এসব কাজের সঙ্গে যুক্তদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকার আওতায় আনার ব্যবস্থা নেওয়া হয়, সেই অনুরোধ কূটনৈতিক চ্যানেলে জানানো হচ্ছে।’

দেশের বিভিন্ন স্থানে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় প্রশাসনের তরফে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা ও দিনাজপুর সদরে আজ মঙ্গলবার থেকে শুরু হচ্ছে বিশেষ লকডাউন। খুলনায় বিধি-নিষেধ কঠোরভাবে বাস্তবায়নের জন্য মাঠে নেমেছেন ২৪ জন ম্যাজিস্ট্রেট। আর মোংলা ইপিজেডে এক চীনা নাগরিকের করোনা শনাক্তের পর স্থানীয় প্রশাসন বিধি-নিষেধে নতুন শর্ত আরোপ করেছে।

চুয়াডাঙ্গার সীমান্তবর্তী উপজেলা দামুড়হুদার সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল জরুরি সভা করে উপজেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটি। সেখানে জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার আজ মঙ্গলবার থেকে উপজেলায় ১৪ দিনের বিশেষ লকডাউনের ঘোষণা দেন। দামুড়হুদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দিলারা রহমানের সভাপতিত্বে সভায় উপস্থিত ছিলেন পুলিশ সুপার মো. জাহিদুল ইসলাম, দামুড়হুদা উপজেলা চেয়ারম্যান আলী মুনছুর বাবু, দামুড়হুদা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সুদীপ্ত কুমার সিংহ, সিভিল সার্জন অফিসের মেডিক্যাল অফিসার (ডিসি) ডা. আওলিয়ার রহমান প্রমুখ।

আজ থেকে সাত দিনের লকডাউন শুরু হচ্ছে দিনাজপুর সদরে। গত রবিবার রাতে দিনাজপুর জেলা প্রশাসক খালেদ মোহাম্মদ জাকি এ বিধি-নিষেধ আরোপ করেন। এর আওতায় আজ সকাল ৬টা থেকে জরুরি পরিষেবা ছাড়া সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। খাবার ও ওষুধের দোকান ছাড়া সব দোকান ও শপিং মল বন্ধ থাকবে।

সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি থামাতে কুড়িগ্রাম পৌর এলাকার ২, ৩ ও ৭ নম্বর ওয়ার্ডে চলাচল নিয়ন্ত্রণে বিধি-নিষেধ জারি করেছে জেলা প্রশাসন। আজ মঙ্গলবার বিকেল ৫টা থেকে এই বিধি-নিষেধ কার্যকর হবে। বিধি-নিষেধের আওতাভুক্ত এলাকায় হাসপাতাল ও দুটি কাঁচাবাজার রয়েছে। এসব এলাকায় অটোরিকশাসহ অন্যান্য যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হবে। কয়েকটি পয়েন্টে পুলিশ ও আনসার মোতায়েন থাকবে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা স্বাস্থ্যবিধি ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে তাত্ক্ষণিকভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবেন।

বিধি-নিষেধ কঠোরভাবে বাস্তবায়নের জন্য খুলনা মহানগর ও জেলায় নেমেছেন ২৪ জন ম্যাজিস্ট্রেট। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সহায়তায় তাঁরা মহানগর ও জেলায় আলাদা আলাদা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছেন। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দেবাশীষ বসাক বলেন, করোনার সংক্রমণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গত ১১ জুন জারীকৃত গণবিজ্ঞপ্তির নির্দেশনাগুলো সঠিকভাবে প্রতিপালিত হচ্ছে কি না, তা তদারকি করতেই মূলত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। এতে এপিবিএন, আনসার, র‌্যাব ও পুলিশ সদস্যরা সহযোগিতা করছেন।

বাগেরহাটের মোংলা ইপিজেডে গত রবিবার এক চীনা নাগরিকের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এরপর গতকাল স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিধি-নিষেধে নতুন শর্ত আরোপ করা হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কমলেশ মজুমদার জানান, আগামীকাল বুধবার ও পরদিন বৃহস্পতিবার কাঁচাবাজার ও মাংসের বাজার বন্ধ থাকবে। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল পর্যন্ত নদী পারাপার বন্ধ থাকবে। তবে স্বাভাবিক থাকবে মাছের বাজার।

এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় সীমান্তবর্তী জেলা যশোরে তিনজন ও নওগাঁয় একজনের প্রাণ কেড়েছে করোনা। আর বাগেরহাটে এক দিনের ব্যবধানে সংক্রমণের হার কমেছে ১৯ শতাংশ। গেল ২৪ ঘণ্টায় সেখানে ৩২৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করে শনাক্ত হয়েছে ১০২ জন। (এ প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার কালের কণ্ঠ’র প্রতিনিধিরা)

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2021/06/15/1043341