১৪ জুন ২০২১, সোমবার, ৩:৩৪

কুষ্টিয়ায় কেন এই বর্বরতা?

স্বজনের আহাজারি

ব্যস্ত বিপণিবিতানে মানুষের ভিড়। হঠাৎ গুলির শব্দ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একজন নারী ও এক যুবক গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। তাদের সঙ্গে থাকা একটি শিশুর প্রাণ রক্ষায় দৌড়ে পালানোর চেষ্টা। কিন্তু পিশাচ ঘাতকের পিস্তলের নিশানা সরেনি ওই নিষ্পাপ শিশুর ওপর থেকেও। শিশুটির পিঠে গুলি করে তাকে মাটিতে ফেলে দেয় ঘাতক। পরে তার মাথায় গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। নিষ্ঠুর, বর্বর এই ঘটনাটি কুষ্টিয়া জেলা শহরের।

গতকাল দুপুরে পুলিশের এএসআই সৌমেন রায় বর্বরোচিত এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেন। নিহত নারী আসমাকে নিজের দ্বিতীয় স্ত্রী দাবি করেছেন সৌমেন। তার সঙ্গে থাকা শাকিল নামের যুবকের সঙ্গে আসমার অনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে এমন সন্দেহে তাদের হত্যা করার কথা স্বীকার করেছে সৌমেন। নিহত শিশু রবিন আসমার আগের সংসারের ছেলে।

প্রকাশ্যে নারী, শিশু ও যুবককে গুলি করে হত্যার ঘটনায় হতবাক জেলা সদরের মানুষ। বর্বর এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে কী তা জানার চেষ্টা করছেন অনেকে। ঘটনার পর উত্তেজিত জনতা এএসআই সৌমেন রায়কে আটকে রেখে পুলিশে দিয়েছে। আটকের পর পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সৌমেন জানিয়েছেন, নিহত নারী আসমা তার দ্বিতীয় স্ত্রী। তার প্রথম স্ত্রী এবং এক সন্তান অন্যত্র থাকেন। কেন হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন এমন প্রশ্নে সৌমেন জানিয়েছেন, বিকাশকর্মী শাকিলের সঙ্গে আসমার অনৈতিক সম্পর্কের কারণে তিনি এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। তবে আসমাকে নিজের স্ত্রী দাবি করলেও কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেননি সৌমেন। আসমার প্রথম স্বামীর সঙ্গে বছর দেড়েক আগে ডিভোর্স হয়। এরপর তিনি কুষ্টিয়া শহরে ছেলেকে নিয়ে মায়ের সঙ্গে থাকতেন। এ সময় সৌমেন রায় কুষ্টিয়ার হালসা পুলিশ কেন্দ্রে দায়িত্বরত ছিলেন। সেসময় তার বিরুদ্ধে নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ ওঠে। হালসায় থাকা অবস্থায় আসমার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে সৌমেনের। তবে দুইজন দুই ধর্মের হওয়ায় তাদের বিয়ে হয়েছে কিনা তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। নানা অভিযোগের কারণে সৌমেনকে হালসা থেকে খুলনার ফুলতলায় বদলি করা হয়। এরপর থেকে আসমার সঙ্গে শাকিলের সম্পর্ক গড়ে ওঠে বলে আলোচনা রয়েছে। গতকাল বেলা ১১টার পর শহরের পিটিআই সড়কের কাস্টমস মোড়ে আসমা, তার ছয় বছরের ছেলে রবিন ও শাকিল নামের আরেক যুবককে গুলি করে হত্যা করে এএসআই সৌমেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, প্রথমে আসমা তার সন্তানকে নিয়ে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়কের কাস্টমস মোড়ে তিনতলা একটি ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরে বিকাশ এজেন্ট শাকিলও সেখানে যান। একপর্যায়ে এএসআই সৌমেন সেখানে হাজির হন। তিনজনের কথা বলার একপর্যায়ে সৌমেন আসমার মাথায় পিস্তল দিয়ে গুলি করেন। পরে শাকিলকে গুলি করার সময় পাশে থাকা আসমার ছেলে রবিন দৌড়ে পাশের একটি মসজিদের দিকে যেতে থাকে। সৌমেন তাকে গুলি করলে শিশুটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পরে সেখানে উপস্থিত জনতা সৌমেনকে আটক করতে ধাওয়া করে। তখন তিনি পাশের মার্কেটের উপরে উঠে যান। সেখানে জনতা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। একপর্যায়ে পুলিশ এসে তাকে আটক করে নিয়ে যায়।

গুলিতে নিহতরা হলেন- কুমারখালী উপজেলার বাগুলাট ইউনিয়নের নাতুড়িয়া গ্রামের আমির আলীর মেয়ে আসমা খাতুন (৩৪) ও তার শিশুপুত্র রবিন (৭) এবং চাপড়া ইউনিয়নের সাওতা গ্রামের বাসিন্দা মেজবার খানের ছেলে বিকাশ কর্মী শাকিল খান (২৮)। শাকিল অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী বলে পরিবার জানিয়েছে। পাশাপাশি সে বিকাশে চাকরি করতেন। ঘাতক পুলিশের এএসআই সৌমেন খুলনার ফুলতলা থানায় কর্মরত। এর আগে তিনি হালসা পুলিশ ক্যাম্পে ছিলেন। নিহতদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়টি এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে পুলিশ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, নিহত আসমা খাতুনকে ২য় স্ত্রী দাবি করেছে এএসআই সৌমেন। তবে এর স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি তিনি। নিহত শিশু রবিন (৭) আসমার ১ম পক্ষের ছেলে এবং বিকাশ কর্মী শাকিল আসমার আরেক প্রেমিক। তিনি আরও বলেন, এর আগে সৌমেন হালসা পুলিশ ক্যাম্পে ছিলেন। সেখানে বিভিন্ন অপকর্মের কারণে তাকে খুলনায় বদলি করা হয়। সৌমেনের প্রথম স্ত্রীর ১৩/১৪ বছর বয়সী একটি কন্যা আছে বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল পৌনে ১১টার দিকে মার্কেটের সিঁড়ির সামনে নিহত আসমা ও তার পুত্র রবিনকে সঙ্গে নিয়ে গল্প করছিল বিকাশ কর্মী শাকিল। এ সময় সেখানে এএসআই সৌমেন আসে এবং উচ্চস্বরে তাদের কথাকাটাকাটির শব্দ শোনা যায়। এর পরপরই গুলিবর্ষণের শব্দ শুনে আশপাশের লোকজন জড়ো হয়ে মার্কেটের সিঁড়ি ঘরের মেঝেতে নারী ও পুরুষের লাশ দেখতে পায়। এ সময় দৌড়ে পালানোর সময় শিশু রবিনকে পেছন থেকে গুলি করে এএসআই সৌমেন। রবিন মাটিতে লুটিয়ে পড়ার পর আরও কয়েক রাউন্ড গুলি হয়। এরপর ব্যবসায়ীরা একজোট হয়ে সৌমেনকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে মার্কেটের ভেতর লুকালে খবর পেয়ে পুলিশ এসে কড়া প্রহরায় নিয়ে যায় সৌমেনকে।

রাস্তার বিপরীত পাশের এক চা দোকানি বলেন, হঠাৎ গুলির শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখি মার্কেটের ভেতর থেকে একটা ছোট্ট শিশু ছুটে বের হয়ে আসলো, ওর পেছনে পিস্তল ধরা লোকটি ছুটে এসে শিশুটিকে ধরে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করলো। তখনই শিশুটি মাটিতে পড়ে যায়। এরপর আমরা হৈচৈ শুরু করলে সে আবার গুলি ছুড়তে শুরু করে। নিহত আসমার মা হাসিনা খাতুন বলেন, গত শনিবার রাতে সৌমেন খুলনা থেকে এসেছে। সকালে আসমাকে নিয়ে খুলনা যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়। তবে হিন্দু সৌমেন কীভাবে তার মেয়েকে বিয়ে করেছে- এ প্রশ্ন এড়িয়ে যান তিনি। শাকিলের ব্যাপারে তিনি বলেন, তার মেয়ের (আসমা) সঙ্গে ফোনে কথা বলতো শাকিল।

নিহত শাকিলের কুমারখালী উপজেলার সাওতা গ্রামের বাড়িতে কথা হয় তার ভাবী লতা খাতুনের সঙ্গে। তিনি জানান, আসমার সঙ্গে শাকিলের চেনাজানা ছিল। তাদের ভাইবোনের সম্পর্ক ছিল। এর বাইরে কোনো গোপন সম্পর্ক তাদের মধ্যে ছিল বলে আমার জানা নেই। তবে সৌমেন দেড় মাস আগে আমাদের বাড়িতে এসে জানায়, তার স্ত্রী আসমার সঙ্গে শাকিলের গোপন সম্পর্ক রয়েছে। সে যেন তার সঙ্গে মেলামেশা না করে।
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. তাপস কুমার সরকার জানান, গতকাল গুলিবিদ্ধ এক মহিলা, শিশু ও একজন পুরুষ ব্যক্তিকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক পরীক্ষা করে তিনজনকেই মৃত পান। নিহতদের মাথাসহ শরীরের অন্য স্থানে গুলি করা হয়েছে। খুব কাছ থেকে গুলি চালানো হয়।

এ ব্যাপারে জানতে কুষ্টিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাব্বিরুল আলমের মোবাইলে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার মো. খাইরুল আলম জানান, অস্ত্র ও গুলিসহ সৌমেনকে আটক করা হয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জেলা পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনা প্রকাশের পর সৌমেনকে পুলিশ বাহিনী থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

https://mzamin.com/article.php?mzamin=278467&cat=2