১৩ জুন ২০২১, রবিবার, ৩:২৪

অর্থমন্ত্রী, টাকা পাচারের একটি প্রাথমিক বিবরণ দেয়া হল: দয়া করে দেখুন

আ হ ম মোস্তফা কামাল শুধুমাত্র বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীই নন, তিনি বাংলাদেশের একজন জাঁদরেল ব্যবসায়ীও বটে। অর্থমন্ত্রী হওয়ার আগে তিনি অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন। তারও আগে তিনি লোটাস কামাল নামে আওয়ামী লীগের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন। তখন আওয়ামী লীগের একজন বড় নেতা ছাড়াও তাঁর আর একটি বড় পরিচয় ছিল একজন বড় ব্যবসায়ী হিসাবে। আওয়ামী লীগ নেতা এবং ব্যবসায়ী হিসাবে দেশের অর্থনীতি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের খবরাখবর তিনি রাখবেন এটাই স্বাভাবিক। আমরাও মনেকরি যে ব্যবসা বাণিজ্যের সদর অন্দরের সব খবরই তিনি রাখেন। এহেন গুণী ব্যক্তি যখন জাতীয় সংসদে বলেন যে দুর্নীতি এবং অর্থ পাচারের খবর তিনি জানেন না, তখন অবাক হই। জাতীয় সংসদে ক্ষুদ্র বিরোধীদল যখন দুর্নীতি এবং মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ তোলেন তখন অর্থমন্ত্রী মোস্তফা কামাল বলেন যে আপনারা, অর্থাৎ বিরোধীদলীয় সদস্যরা অর্থ পাচারকারীদের তালিকা তাঁর কাছে দিন, তখন হতভম্ব হতে হয়। দুর্নীতিবাজদের তালিকা কে দেবে? বিরোধী দল? নাকি সরকারই তাদেরকে খুঁজে বের করবেন? এই কথার অর্থ কি হয় সেটা মন্ত্রী বোঝেন? এই কথার পরিষ্কার অর্থ এই যে বিদেশে অর্থ পাচারের ব্যাপারে সরকার হয় উদাসীন। না হয় অজ্ঞ। গত ৬ জুন রবিবার একজন সরকারদলীয় সদস্যও অভিযোগ করেছেন যে সরকার দুর্নীতি দমনে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি আরো অভিযোগ করেন যে এই দুর্নীতি সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের অভ্যন্তরেও ঢুকে পড়েছে। ব্যবস-বাণিজ্য সম্পর্কে তার মতো অভিজ্ঞ ব্যক্তির পক্ষে বিরোধী দলের কাছ থেকে অর্থ পাচারকারীদের তালিকা চাওয়াটা মোটেই শোভন নয়। বরং তাঁর কাজ হচ্ছে সরকারের যতগুলো এজেন্সি আছে সেই সব এজেন্সির নিকট থেকে তালিকা সংগ্রহ করা, তাদেরকে আইনের আওতায় আনা এবং পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরৎ আনা। মন্ত্রী সম্ভবত ভুলে গেছেন যে সরকারের একটি সংস্থা রয়েছে। নাম ফিনান্সিয়ার ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। তাদের কাছে সন্দেহভাজন ক্যাশ ট্র্যানজ্যাকশনের একটি তালিকা আছে। এই তালিকা হয়তো অসম্পূর্ণ। তবুও এই তালিকা থেকেও পাচারকারীদের খুঁজে বের করা যায়। এছাড়াও দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদকসহ আরো অনেক সরকারি এজেন্সি আছে, যাদের কাছে এই ধরনের তালিকা পাওয়া যাবে।

অর্থমন্ত্রী বিরোধী দলের নিকট থেকে তালিকা চেয়েছেন। আমরা বিরোধীদল নই। আমরা সংবাদপত্র, রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। আমরা এখানে তালিকা নয়, কিছু তথ্য দিচ্ছি। অর্থমন্ত্রী এই তথ্যের ভিত্তিতে অনুসন্ধান করতে পারেন।

॥দুই॥
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টসমূহ সংকলন করলে যে চিত্র বেরিয়ে আসে সেই চিত্র থেকে দেখা যায় যে বিগত ৫ বছরে আলোচ্য ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ১ হাজার ২৪টি ক্যাশ ট্র্যানজ্যাকশন শনাক্ত করেছে যেগুলো সন্দেহজনক। সন্দেহ করা হয়েছে যে এই বিপুল ট্র্যানজ্যাকশনের অন্তত অর্ধেক লেনদেনের সাথে জড়িত রয়েছে বিদেশে অর্থ পাচার। গত ৯ জুন বুধবার একটি ইংরেজি দৈনিকের প্রধান সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে যে যারা এসব লেনদেন করেছে তাদের নামধামসহ বিস্তারিত দুদক, পুলিশ এবং অন্যান্য সরকারি এজেন্সির নিকট পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিকটও তালিকার একটি কপি পাঠানো হয়েছে। আলোচ্য কলামে বলা হয়েছে যে, ঐ তালিকায় নামধাম ছাড়াও ঐসব ব্যক্তি বিদেশে যেসব বাড়িঘরসহ সহায়সম্পত্তি ক্রয় করেছেন তার বিবরণ রয়েছে। আরও রয়েছে, বিদেশে তারা যে বিনিয়োগ করেছেন তার রেকর্ড ও ডকুমেন্ট। সরকারের কাছে শুধুমাত্র এই তালিকাই নয়, রয়েছে ঋণ খেলাপীদের তালিকা। এই ঋণ খেলাপীদের মধ্যেও অনেকে রয়েছে যারা অর্থ পাচারকারী। অসংখ্য বার অভিযোগ করা হয়েছে যে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে সেই টাকা শোধ না করে ঐ ঋণের টাকা বিদেশে পাচার করে সেই টাকা দিয়ে বিদেশে বাড়ি ক্রয় করা হয়েছে। রিয়াল এস্টেটে বিনিয়োগ করা হয়েছে এবং অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) সরাসরি অভিযোগ করেছে যে সরকার এই তালিকা ধরে পাচারকারী ও দুর্নীতিবাজদের পাকড়াও করার পরিবর্তে পরিবেশিত তথ্যাবলী গোপন করতেই বেশি ব্যস্ত বলে মনে হচ্ছে।

অভিযোগ রয়েছে আলোচ্য তালিকায় ক্ষমতাধর রাজনীতিবিদ, সরকারি আমলা এবং ধনাঢ্য কিন্তু ক্ষমতাধর ব্যবসায়ীদেরও নামধাম রয়েছে। পাঠকদের হয়তো স্মরণ আছে যে গত বছরের নবেম্বর মাসে মাননীয় হাইকোর্ট সরকার এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রতি একটি নির্দেশ জারি করেছিল। ঐ নির্দেশে বলা হয়েছিল যে সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং অন্যরা যারা বিদেশে অর্থ পাচার করেছে, তাদের তালিকা ঐ বছরেরই অর্থাৎ ২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে হাইকোর্টের নিকট দাখিল করতে হবে। এখন পর্যন্ত সেই তালিকা সরকার পাঠায়নি। পাঠিয়ে থাকলেও সে সম্পর্কে আর কোনো উচ্চবাচ্য শোনা যায়নি।

হাইকোর্টের এই নির্দেশ থেকে বোঝা যায় যে, সরকারের কাছে এমন একটি তালিকা আছে। না থাকলে হাইকোর্ট এই নির্দেশ দিত না। হাইকোর্টের কাছে সেই তালিকা দাখিল করা হয়ে থাক বা না থাক, সরকার সেই তালিকা নিয়ে কি করেছে? তালিকার ওপর অলসভাবে বসে আছে? নাকি সেই তালিকা তথা ফাইল কিছুটা নড়াচড়া করেছে? করলে কতদূর কি হয়েছে?

॥তিন॥
অর্থমন্ত্রী মোস্তফা কামাল দুর্নীতিবাজ এবং অর্থ পাচারকারীদের তালিকা চেয়েছেন। ওপরে যা বলা হলো তার মধ্য দিয়ে একটি তালিকাই শুধু নয়, একটি বড় এবং রাঘব বোয়ালদের তালিকাই দেয়া হলো। এখন হাল আমলের কয়েকটি তথ্য আপনার সমীপে পেশ করছি।

২০১৮ সালের নৈশ ভোটে (বিএনপির রিজভীর ভাষায় মিড্ নাইট ভোটিং) সংসদ সদস্য হয়েছেন মোহাম্মদ শহীদ হোসেন পাপুল। তিনি এমপি হয়েছেন লক্ষ্মীপুর-২ আসন থেকে। কিভাবে তিনি এমপি হলেন? গত ৭ জুন সোমবার ‘প্রথম আলোর’ অনলাইন সংস্করণে এ সম্পর্কে কিছু তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়, ২০১৮ সালে টাকার জোরে মোহাম্মদ শহীদ ইসলাম কেবল এমপিই হননি, তাঁর স্ত্রীকেও সংরক্ষিত আসনের সদস্য বানিয়েছেন। এ ব্যাপারে বিপুল অর্থ লেনদেনের তথ্য সে সময়েই বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছিল। এই অর্থ লেনদেনের সাথে কারা জড়িত সেই তথ্যও সবার জানা। কিন্তু একের পর এক তথ্য প্রকাশিত হলেও সরকার বা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ছিল সেই ব্যবস্থা নিতে হলো কুয়েত সরকারকে। কিন্তু সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায় অর্থ পাচার, মানব পাচার ও ভিসা জালিয়াতির অভিযোগে কুয়েতে তাকে গ্রেফতার করে কুয়েতি পুলিশ। তার বিরুদ্ধে মানবপাচার ও প্রায় ৫৩ মিলিয়ন কুয়েতি দিনার (বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা) পাচারের অভিযোগে কুয়েতে মামলা হয়। মামলায় তিনি দোষী সাব্যস্ত হন এবং ৪ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। এখন তিনি কুয়েতে জেল খাটছেন। প্রথম আলোর আলোচ্য রিপোর্টটির মতে কুয়েতে যদি তার অপরাধ ফাঁস না হতো এবং জেল না হতো তাহলে আজ জাতীয় সংসদে বসে অর্থমন্ত্রীর ঐ বক্তব্য তিনি শুনতেন এবং মুচকি হাসতেন। হয়তোবা টাকা পাচারের বিরুদ্ধে বক্তব্যও দিতেন।

দেশে টাকা পাচারের কথা উঠলেই তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমান কোকোর কথা ওঠে। তারেক রহমানের অর্থ পাচার অভিযোগের তদন্তের জন্য মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইকেও অনুরোধ করা হয়। কত কোটি টাকা মানি লন্ডারিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে? সরকার এ ব্যাপারে পরিষ্কার কোনো চিত্র দেশবাসীকে দেয়নি। তর্কের ছলে ধরলাম ২০ কোাটি। আরো বেশি করে না হয় ৩০ কোটি বা ৪০ কোটি। কিন্তু আওয়ামী লীগের এই বিগত ১৩ বছরে যে ২/৪ কোটি নয়, ২/১ শত কোটি নয়, হাজার হাজার লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে তার বেলা? দুর্নীতির কথা উঠলেই এই সরকার ছেঁড়া গেঞ্জির কথা আওড়ায়। বলে, দুর্নীতি করে নাকি তারেক এবং কোকো লঞ্চ স্টিমার বানিয়েছেন। লঞ্চ স্টিমার বানাতে কত কোটি টাকা লাগে? আর আওয়ামী লীগ নেতা ও মন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর (মখা আলমগীর) যে আস্ত একটি ব্যাংক খেয়ে ফেললেন, তার কি হলো? তাকে কেন কাঠিখানায় তোলা হলো না? তাকে কেন কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হলো না?

একটি দুটি নয়। দুর্নীতি ও টাকা পাচারের লম্বা লিস্ট আছে। কানাডার স্কারবোরো শহরে হেয়ারউড রোডের ৭৩ নং বাড়িটি কার? সেটি কি শামীমা সুলতানা ওরফে জান্নাতির নয়? কে এই জান্নাতি? তিনি কি নাটোরের এমপি শফিকুল ইসলাম ওরফে শিমুলের স্ত্রী নন? বাংলাদেশী টাকায় ১২ কোটি টাকা দিয়ে এমন আলিশান বাড়ি কেনার টাকা শামীমা সুলতানা কোথায় পেলেন? তিনি তো শুধুই একজন গৃহবধূ। তার তো কোনো ইনকাম নাই। তাহলে তাঁর এমপি স্বামী কি বেনামে ঐ বাড়ি কেনেন নাই? এটি ৭ জুন প্রথম আলোর খবর। আরো খবর আছে। অর্থমন্ত্রী, যেসব তথ্য দেয়া হলো, সেগুলোর ওপরেই আগে এ্যাকশন নিন।

https://dailysangram.com/post/455366