১১ জুন ২০২১, শুক্রবার, ১:১৯

পরিকল্পিত নগরীর পরিকল্পনায় গলদ

বিশ্বে বাসযোগ্য শহরের তালিকায় এবারও একদম লেজে অবস্থান করছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। নিচের দিক থেকে ঢাকার অবস্থান চতুর্থ। অধিক জনসংখ্যার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশদূষণ, অপরিকল্পিত অবকাঠামো তৈরি, বর্জ্যের অব্যবস্থাপনা, জলাবদ্ধতা, অনুন্নত পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার কারণে এখন এই নগরী অনেকটাই বাসের অনুপযোগী। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পরিকল্পিত নগরী গড়তে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার গলদ থাকায় ধুঁকছে ঢাকা। এলাকাভিত্তিক মানুষের ভারসাম্য না থাকাও ঢাকার এমন নাজুক পরিস্থিতির অন্যতম কারণ। করোনা অতিমারির কারণে নগরীর সংস্কৃতি, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও এখন অনেকটাই ভঙ্গুর। ফলে এখনই এর লাগাম না টানলে ভবিষ্যতে এই নগরীর চেহারা আরো ভয়ংকর হবে বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। তাঁদের পরামর্শ, ঢাকার রূপ কিছুটা পাল্টে দিতে নতুন ওয়ার্ডগুলোকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি ওয়ার্ডগুলোর পরিকল্পনার ক্ষেত্রে বৈশ্বিক মান বজায় রাখতে হবে।

গত বুধবার বাসযোগ্যতার দিক থেকে বিশ্বের ১৪০ শহরের তালিকা প্রকাশ করে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)। এই তালিকায় বাসযোগ্য শহরের তালিকায় বিশ্বে ঢাকার অবস্থান ১৩৭তম। অর্থাৎ বিশ্বের অযোগ্য শহর হিসেবে চতুর্থ অবস্থানে রাজধানী ঢাকা। এই তালিকায় বাসযোগ্য শহরের একেবারে তলানিতে অর্থাৎ ১৪০তম অবস্থানে রয়েছে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক। ১৩৯তম অবস্থানে নাইজেরিয়ার

লাগোস এবং ১৩৮তম অবস্থানে পাপুয়া নিউগিনির পোর্ট মোরেসবির অবস্থান। অন্যদিকে বাসযোগ্য শহরের তালিকার শীর্ষে রয়েছে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে জাপানের ওসাকা এবং তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেড। করোনা মহামারির কারণে ২০২১ সালের তালিকায় বেশ পরিবর্তন এসেছে।

স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, স্থিতিশীলতা, শিক্ষা এবং অবকাঠামো এই পাঁচটি সূচকের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবছর বিশ্বের ১৪০টি প্রধান শহরের ওপর জরিপ চালিয়ে থাকে ইআইইউ। এ বছর মোট পাঁচটি সূচকের ১০০ নম্বরের মধ্যে ঢাকা পেয়েছে ৩৩.৫ নম্বর। এর মধ্যে স্বাস্থ্যসেবার দিক থেকে ১৬.৭, সংস্কৃতি ও পরিবেশে ৩০.৮, স্থিতিশীলতায় ৫৫, শিক্ষায় ৩৩.৩ এবং অবকাঠামোতে ২৬.৮ নম্বর পেয়েছে ঢাকা।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম মনে করেন, ‘ঢাকাকে নিয়ে তাঁর যে মাস্টারপ্ল্যান আছে, সেগুলোর কাজ শেষ করতে পারলে অচিরেই নগরবাসী একটি বাসযোগ্য শহর পাবে। তিনি বলেন, দখল আর দূষণ এই নগরের প্রধান শত্রু। অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলছে। আমরা খালগুলোকে দূষণমুক্ত করব।’

যদিও এ ক্ষেত্রে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) রাজধানীর জনসংখ্যার ঘনত্বকে বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছে। বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ের এই তালিকাকে আমলে নিয়ে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ বলেন, ‘পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে দেড় থেকে দুই হাজার লোক বাস করে। সেখানে এই জনসংখ্যার জন্য যে সেবা দেওয়া হয়, আমাকে এই শহরে ৪৯ হাজার মানুষের জন্য সেই একই সেবা দিতে হয়। ফলে আমাদের জন্য ঢাকার জনসংখ্যা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ফলে সিডনির সঙ্গে ঢাকাকে তুলনা করলে তো হবে না। এ ক্ষেত্রে ঢাকার জনসংখ্যার ঘনত্বকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু তার পরও আমরা আমাদের সেবার মান এবং পরিধি বাড়াতে পরিকল্পিতভাবে কাজ করছি। আমরা জলাবদ্ধতা, মশক নিধন এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আগামী দুই বছরের মধ্যে এর ফল নিশ্চয়ই নগরবাসীর কাছে দৃশ্যমান হবে।’

তবে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) বলছে, তারা পূর্বাচল, উত্তরা ও তুরাগ নদের পারে পরিকল্পিত নগরী করার কাজ শুরু করেছে। পরিকল্পিত ও বসবাসযোগ্য নগরী গড়ার বিষয়ে রাজউকের পরিকল্পনা কী জানতে চাইলে চেয়ারম্যান এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরী বলেন, ‘আমরা ঢাকাকে পরিকল্পিত নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করছি। এটা তো এক দিনের কাজ না, সময় লাগবে। এখানে আমরা জলাশয়বান্ধব নগর, কৃষিবান্ধব নগর গড়ে তোলার প্রকল্প হাতে নিয়েছি। এ ছাড়া পুরান ঢাকাকে পরিকল্পিতভাবে সাজাতেও আমরা উদ্যোগ নিয়েছি।

ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক এবং নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, একটি বাসযোগ্য শহরের জন্য ২০ শতাংশ সবুজ এলাকা, ৫ থেকে ১৫ শতাংশ জলাশয় এবং ২০ থেকে ২৫ শতাংশ রাস্তাঘাট দরকার। এ ক্ষেত্রে আগের ঢাকাকে তো আর ঢেলে সাজানোর তেমন সুযোগ নেই। তবে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সঙ্গে নতুন যে ৩৬টি ওয়ার্ড যুক্ত করা হয়েছে, সেগুলোকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে হবে। সেখানে পরিকল্পনার ক্ষেত্রে বৈশ্বিক মান মেনে কাজ করতে হবে

এদিকে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক ও ক্যাপসের পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, ‘এই তালিকায় অবস্থানের দিক থেকে আমরা এক ধাপ এগোলেও গতবারের চেয়ে স্কোরের দিক থেকে আমাদের অবনতি হয়েছে। এর একটি কারণ রাজধানীতে সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব।’ ঢাকার মাতুয়াইল ও আমিনবাজার ল্যান্ডফিল্ড থেকে দৈনিক চার লাখ টন মিথেন গ্যাসের নিঃসরণ ঘটে। কানাডাভিত্তিক একটি গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের এমন গবেষণা তুলে ধরে কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, ‘মিথেন গ্যাস নিঃসরণের এই তথ্য প্রমাণ করে আমাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিস্থিতি কতটা দুর্বল। এই বর্জ্য বায়ু দূষণ করে এবং নদীতে গিয়ে যখন মেশে, তখন নদীর পানিও দূষিত হয়।’

তবে বাসযোগ্য শহরের তালিকায় বিশ্বে ঢাকার ১৩৭তম অবস্থানের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে বিদেশিদের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, ‘মূলত আমাদের দেশে যেসব বিনিয়োগকারী আসেন, তাঁরা আমাদের আবাসন ব্যবস্থা, পরিবহন খাত, পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার ঘাটতি সম্পর্কে কমবেশি জানেন। ফলে এই দিক থেকে বৈশ্বিক এই র্যাংকিংটা শুধু আমাদের অবস্থান প্রকাশ করছে। তবে এটা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে না।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2021/06/11/1041990